… আমার বন্ধুগণকে বলবে, যাঁরা আমার নিন্দাবাদ করছেন, তাঁদের জন্য আমার একমাত্র উত্তর—একদম চুপ থাকা। আমি তাঁদের ঢিলটি খেয়ে যদি তাঁদের পাটকেল মারতে যাই, তবে তো আমি তাঁদের সঙ্গে এক দরের হয়ে পড়লুম। তাদের বলবে—সত্য নিজের প্রতিষ্ঠা নিজেই করবে, আমার জন্যে তাদের কারও সঙ্গে বিরোধ করতে হবে না। তাদের (আমার বন্ধুদের) এখনও ঢের শিখতে হবে, তারা তো এখনও শিশুতুল্য। তারা বালক—তারা এখনও আহাম্মকের মত সোনার স্বপন দেখছে!
… সাধারণের সহিত জড়িত এই বাজে জীবনে এবং খবরের কাগজের হুজুকে আমি একেবারে বিরক্ত হয়ে গিয়েছি। এখন প্রাণের ভেতর আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে—হিমালয়ের সেই শান্তিময় ক্রোড়ে ফিরে যাই।
তোমার প্রতি চিরস্নেহপূর্ণ
বিবেকানন্দ
১২১*
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
২৯ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
তুমি যে-সকল কাগজ পাঠাইয়াছিলে, তাহা যথাসময়ে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। আর এত দিনে তুমিও নিশ্চয় আমেরিকার কাগজে যে-সকল মন্তব্য প্রকাশিত হইয়াছে, তাহার কিছু কিছু পাইয়া থাকিবে। এখন সব ঠিক হইয়াছে। সর্বদা কলিকাতায় চিঠিপত্র লিখিবে। বৎস, এ পর্যন্ত তুমি সাহস দেখাইয়া আপনাকে গৌরবমণ্ডিত করিয়াছ। জি. জি-ও বড়ই অদ্ভুত ও সুন্দর কার্য করিয়াছে। হে আমার সাহসী নিঃস্বার্থ সন্তানগণ, তোমরা সকলেই বড় সুন্দর কার্য করিয়াছ। আমি তোমাদের কথা স্মরণ করিয়া বড়ই গৌরব অনুভব করিতেছি। ভারত তোমাদের লইয়া গৌরব অনুভব করিতেছে। তোমাদের যে খবরের কাগজ বাহির করিবার সঙ্কল্প ছিল, তাহা ছাড়িও না। খেতড়ির রাজা ও কাঠিয়াওয়াড়স্থ লিমডির ঠাকুর সাহেব—যাহাতে আমার কার্যের বিষয় সর্বদা সংবাদ পান, তাহা করিবে। আমি মান্দ্রাজ অভিনন্দনের একটি সংক্ষিপ্ত উত্তর লিখিতেছি। যদি সস্তায় হয়, এখান হইতেই ছাপাইয়া পাঠাইয়া দিব, নতুবা টাইপ করিয়া পাঠাইয়া দিব। ভরসায় বুক বাঁধ—নিরাশ হইও না। এরূপ সুন্দরভাবে কার্য সম্পন্ন হওয়ার পর যদি আবার তোমার নৈরাশ্য আসে, তাহা হইলে তুমি মূর্খ। আমাদের কার্যের আরম্ভ যেরূপ সুন্দর হইয়াছে, আর কোন কার্যের আরম্ভ সেরূপ দেখা যায় না; আমাদের কার্য ভারতে ও তাহার বাহিরে যেরূপ দ্রুত বিস্তৃত হইয়াছে, এ পর্যন্ত ভারতে আর কোন আন্দোলন সেরূপ হয় নাই।
আমি ভারতের বাহিরে কোনরূপ প্রণালীবদ্ধ কার্য বা সভাসমিতি করিতে ইচ্ছা করি না। ঐরূপ করিবার কোন উপকারিতা বুঝি না। ভারতই আমাদের কার্যক্ষেত্র, আর বিদেশে আমাদের কার্য সমাদৃত হওয়ার এইটুকু মূল্য যে, উহাতে ভারত জাগিবে; এই পর্যন্ত। আমেরিকার ব্যাপারে ভারতে আমাদের কার্য করিবার অধিকার ও সুযোগ উপস্থিত হইয়াছে। এখন ভাববিস্তারের জন্য আমাদের দৃঢ় ভিত্তির প্রয়োজন। মান্দ্রাজ ও কলিকাতা—এখন এই দুইটি কেন্দ্র হইয়াছে। অতি শীঘ্রই ভারতে আরও শত শত কেন্দ্র হইবে।
যদি পার তবে সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র উভয়ই বাহির কর। আমার যে-সকল ভ্রাতা চারিদিকে ঘুরিতেছেন, তাঁহারা গ্রাহক সংগ্রহ করিবেন; আমিও অনেক গ্রাহক যোগাড় করিব এবং মধ্যে মধ্যে কিছু কিছু টাকা পাঠাইব। মুহূর্তের জন্যও বিচলিত হইও না, সব ঠিক হইয়া যাইবে।
আপনার গাঁটের ব্যথা এখন প্রায় সম্পূর্ণ আরোগ্য হয়েছে জেনে খুব সুখী হলাম। দয়া করে আপনার ভাইকে আমার প্রতিজ্ঞাভঙ্গের জন্য মাপ করতে বলবেন। আমি এখানে কিছু সংস্কৃত বই পেয়েছি এবং অধ্যায়নের সাহায্যও জুটেছে। অন্যত্র এরূপ পাবার আশা নাই; সুতরাং শেষ করে যাবার আগ্রহ হয়েছে। কাল আপনার বন্ধু শ্রীযুক্ত মনঃসুখারামের সঙ্গে দেখা হল; তিনি তাঁর এক সন্ন্যাসী বন্ধুকে বাড়ীতে রেখেছেন। তিনি আমার প্রতি খুব সহৃদয়; তাঁর পুত্রও তাই।
ইচ্ছাশক্তিই জগৎকে পরিচালিত করিয়া থাকে। হে বৎস, যুবকগণ খ্রীষ্টান হইয়া যাইতেছে বলিয়া দুঃখিত হইও না। আমাদের নিজেদের দোষেই ইহা ঘটিতেছে।
এইমাত্র রাশীকৃত সংবাদপত্র ও পরমহংসদেবের জীবনী আসিল—আমি সমুদয় পড়িয়া তারপর আবার কলম ধরিতেছি। আমাদের সমাজে, বিশেষতঃ মান্দ্রাজে এখন যে প্রকার অযথা নিয়ম ও আচারবন্ধন রহিয়াছে, তাহাতে তাহারা ঐরূপ না হইয়াই বা করে কি? উন্নতির জন্য প্রথম চাই স্বাধীনতা। তোমাদের পূর্বপুরুষেরা আত্মার স্বাধীনতা দিয়াছিলেন, তাই (এদেশে) ধর্মের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ও বিকাশ হইয়াছে। কিন্তু তাঁহারা দেহকে যতপ্রকার বন্ধনের মধ্যে ফেলিলেন, কাজে কাজেই সমাজের বিকাশ হইল না। পাশ্চাত্য দেশে ঠিক ইহার বিপরীত—সমাজে যথেষ্ট স্বাধীনতা, ধর্মে কিছুমাত্র নাই। ইহার ফলে তথায় ধর্ম নিতান্ত অপরিণত এবং সমাজ সুন্দর উন্নত হইয়া গড়িয়া উঠিয়াছে। এক্ষণে প্রাচ্যদেশীয় সমাজের চরণ হইতে বন্ধন-শৃঙ্খল ক্রমশঃ দূর হইতেছে, পাশ্চাত্যে ধর্মেরও ঠিক তাহাই হইতেছে। তোমাদিগকে অপেক্ষা করিতে হইবে এবং সহিষ্ণুতার সহিত কাজ করিয়া যাইতে হইবে।
প্রত্যেকের আদর্শ ভিন্ন ভিন্ন। ভারতের আদর্শ ধর্মমুখী বা অন্তর্মুখী, পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক বা বহির্মুখী। পাশ্চাত্য এতটুকু আধ্যাত্মিক উন্নতিও সমাজের উন্নতির ভিতর দিয়া করিতে চায়, আর প্রাচ্য এতটুকু সামাজিক শক্তিও আধ্যাত্মিকতার মধ্য দিয়া লাভ করিতে চায়।
এই জন্য আধুনিক সংস্কারকগণ প্রথমেই ভারতের ধর্মকে নষ্ট না করিয়া সংস্কারের আর কোন উপায় দেখিতে পান না। তাঁহারা উহার চেষ্টা করিয়াছেন, কিন্তু বিফলমনোরথ হইয়াছেন। ইহার কারণ কি? কারণ—তাঁহাদের মধ্যে অতি অল্পসংখ্যক ব্যক্তিই তাঁহাদের নিজের ধর্ম উত্তমরূপে অধ্যয়ন ও আলোচনা করিয়াছেন; আর তাঁহাদের একজনও ‘সকল ধর্মের প্রসূতি’কে বুঝিবার জন্য যে সাধনার প্রয়োজন, সেই সাধনার মধ্য দিয়া যান নাই! ঈশ্বরেচ্ছায় আমি এই সমস্যার মীমাংসা করিয়াছি বলিয়া দাবী করি। আমি দৃঢ়ভাবে বলিতেছি, হিন্দুসমাজের উন্নতির জন্য ধর্মকে নষ্ট করিবার কোন প্রয়োজন নাই এবং ধর্মের জন্যই যে সমাজের এই অবস্থা তাহা নহে, বরং ধর্মকে সামাজিক ব্যাপারে যেভাবে কাজে লাগান উচিত, তাহা হয় নাই বলিয়াই সমাজের এই অবস্থা। আমি আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রসমূহ হইতে ইহার প্রত্যেকটি কথা প্রমাণ করিতে প্রস্তুত। আমি ইহাই শিক্ষা দিতেছি, আর আমাদিগকে ইহা কার্যে পরিণত করিবার জন্য সারা জীবন চেষ্টা করিয়া যাইতে হইবে। কিন্তু ইহাতে সময় লাগিবে—অনেক সময় ও দীর্ঘকালব্যাপী আলোচনার প্রয়োজন। সহিষ্ণুতা অবলম্বন কর এবং কাজ করিয়া যাও। ‘উদ্ধরেদাত্মনাত্মানম্’।