এ দেশে গরমীর দিনে সকলে দরিয়ার কিনারায় যায়—আমিও গিয়েছিলাম, অবশ্য পরের স্কন্ধে। এদের নৌকা আর জাহাজ চালাবার বড়ই বাতিক। ইয়াট বলে ছোট ছোট জাহাজ ছেলে-বুড়ো যার পয়সা আছে, তারই একটা আছে। তাইতে পাল তুলে দরিয়ায় যায় আর ঘরে আসে, খায় দায়—নাচে কোঁদে—গান বাজনা তো দিবারাত্র। পিয়ানোর জ্বালায় ঘরে তিষ্ঠাবার যো নাই।
ঐ যে G. W. Hale (হেল)-এর ঠিকানায় চিঠি দাও, তাদের কথা কিছু বলি। হেল আর তার স্ত্রী, বুড়ো-বুড়ী। আর দুই মেয়ে, দুই ভাইঝি, এক ছেলে। ছেলে রোজগার করতে দোসরা জায়গায় থাকে। মেয়েরা ঘরে থাকে। এদের দেশে মেয়ের সম্বন্ধেই সম্বন্ধ। ছেলে বে করে পর হয়ে যায়—মেয়ের স্বামী ঘন ঘন স্ত্রীর বাপের বাড়ী যায়। এরা বলে—
‘Son is son till he gets a wife
The daughter is daughter all her life.’২
চারজনেই যুবতী—বে থা করেনি। বে হওয়া এদেশে বড়ই হাঙ্গাম। প্রথম মনের মত বর চাই। দ্বিতীয় পয়সা চাই। ছোঁড়া বেটারা ইয়ারকি দিতে বড়ই মজবুত—ধরা দেবার বেলা পগার পার। ছুঁড়ীরা নেচে কুঁদে একটা স্বামী যোগাড় করে, ছোঁড়া বেটারা ফাঁদে পা দিতে বড়ই নারাজ। এই রকম করতে করতে একটা ‘লভ্’ হয়ে পড়ে—তখন সাদি হয়। এই হল সাধারণ—তবে হেলের মেয়েরা রূপসী, বড়মানষের ঝি, ইউনিভার্সিটি ‘গার্ল’ (বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী)—নাচতে গাইতে পিয়ানো বাজাতে অদ্বিতীয়া—অনেক ছোঁড়া ফেঁ ফেঁ করে—তাদের বড় পসন্দয় আসে না। তারা বোধ হয় বে থা করবে না—তার উপর আমার সংস্রবে ঘোর বৈরিগ্যি উপস্থিত। তারা এখন ব্রহ্মচিন্তায় ব্যস্ত।
মেরী আর হ্যারিয়েট হল মেয়ে, আর এক হ্যারিয়েট আর ইসাবেল হল ভাইঝি। মেয়ে দুইটির চুল সোনালী অর্থাৎ [তারা] ব্লণ্ড, আর ভাইঝি দুটি brunette [ব্রানেট] অর্থাৎ কালো চুল। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—এরা সব জানে। ভাইঝিদের তত পয়সা নেই—তারা একটা Kindergarten School (কিণ্ডারগার্টেন স্কুল) করে, মেয়েরা কিছু রোজগার করে না। এদের দেশের অনেক মেয়ে রোজগার করে। কেউ কারুর উপর নির্ভর করে না। ক্রোড়পতির ছেলেও রোজগার করে, তবে বে করে, আর আপনার বাড়ী ভাড়া করে থাকে। মেয়েরা আমাকে দাদা বলে, আমি তাদের মাকে মা বলি। আমার মালপত্র সব তাদের বাড়ীতে—আমি যেখানেই কেন যাই না। তারা সব ঠিকানা করে। এদেশের ছেলেরা ছোটবেলা থেকেই রোজগার করতে যায়, আর মেয়েরা ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া শেখে—তাইতে করে একটা সভায় দেখবে যে 90 per cent. (শতকরা ৯০ জন) মেয়ে। ছোঁড়ারা তাদের কাছে কলকেও পায় না।
এদেশে ভূতুড়ে অনেক। মিডিয়ম (Medium) হল যে ভূত আনে। মিডিয়ম একটা পর্দার আড়ালে যায়, আর পর্দার ভেতর থেকে ভূত বেরুতে আরম্ভ করে—বড় ছোট, হর-রঙের। আমি গোটাকতক দেখলাম বটে, কিন্তু ঠকবাজি বলেই বোধ হল। আর গোটাকতক দেখে তবে ঠিক সিদ্ধান্ত করব। ভূতুড়েরা অনেকে আমাকে শ্রদ্ধাভক্তি করে।
দোসরা হচ্ছেন ক্রিশ্চিয়ান সায়ান্স—এরাই হচ্চে আজকালকার বড় দল—সর্ব ঘটে। বড়ই ছড়াচ্ছে—গোঁড়া বেটাদের বুকে শেল বিঁধছে। এরা হচ্চে বেদান্তী অর্থাৎ গোটাকতক অদ্বৈতবাদের মত যোগাড় করে তাকে বাইবেলের মধ্যে ঢুকিয়েছে আর ‘সোঽহং সোঽহং’ বলে রোগ ভাল করে দেয়—মনের জোরে। এরা সকলেই আমাকে বড় খাতির করে।
আজকাল গোঁড়া বেটাদের ত্রাহি-ত্রাহি এদেশে। Devil worship৩ আর বড় একখানা চলছে না। আমাকে বেটারা যমের মত দেখে। বলে, কোথা থেকে এ বেটা এল, রাজ্যির মেয়ে-মদ্দ ওর পিছু পিছু ফেরে—গোঁড়ামির জড় মারবার যোগাড়ে আছে। আগুন ধরে গেছে বাবা! গুরুর কৃপায় যে আগুন ধরে গেছে, তা নিববার নয়। কালে গোঁড়াদের দম নিকলে যাবে। কি বাঘ ঘরে ঢুকিয়েছেন, তা বাছাধনেরা টের পাচ্ছেন। থিওসফিষ্টদের জোর বড় একটা নাই। তবে তারাও গোঁড়াদের খুব পিছু লেগে আছে।
এই ক্রিশ্চিয়ান সায়ান্স ঠিক আমাদের কর্তাভজা। বল ‘রোগ নেই’—বস্, ভাল হয়ে গেল, আর বল্ ‘সোঽহং’, বস্—ছুটি, চরে খাওগে। দেশ ঘোর materialist (জড়বাদী)। এই ক্রিশ্চিয়ান দেশের লোক—ব্যামো ভাল কর, আজগুবি কর; পয়সার রাস্তা হয়, তবে ধর্ম মানে—অন্য কিছু বড় বোঝে না। তবে কেউ কেউ বেশ আছে। যত বেটা দুষ্টু বজ্জাত, ঠক-জোচ্চোর মিশনরীরা তাদের ঘাড় ভাঙে আর তাদের পাপ মোচন করে। … এরা আমাতে এক নূতন ডৌলের মানুষ দেখেছে। গোঁড়া বেটাদের পর্যন্ত আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে, আর এখন সকলে বড়ই ভক্তি করছে—বাবা ব্রহ্মচর্যের চেয়ে কি আর বল আছে?
আমি এখন মান্দ্রাজীদের Address (অভিনন্দন), যা এখানকার সব কাগজে ছেপে ধূমক্ষেত্র মোচে গিয়েছিল, তারই জবাব লিখতে ব্যস্ত। যদি সস্তা হয় তো ছাপিয়ে পাঠাব, যদি মাগগি হয় তো type-writing (টাইপ) করে পাঠিয়ে দেব। তোমাদেরও এক কপি পাঠাব—‘ইণ্ডিয়ান মিররে’ ছাপিয়ে দিও।
এদেশের অবিবাহিত মেয়েরা বড়ই ভাল, তারা ভয় ডর করে। … এরা হল বিরোচনের জাত। শরীর হল এদের ধর্ম, তাই মাজা, তাই ঘষা—তাই নিয়ে আছে। নখ কাটবার হাজার যন্ত্র, চুল কাটবার দশ হাজার, আর কাপড়-পোষাক গন্ধ-মসলার ঠিক-ঠিকানা কি! … এরা ভাল মানুষ, দয়াবান্ সত্যবাদী। সব ভাল, কিন্তু ঐ যে ‘ভোগ’, ঐ ওদের ভগবান্—টাকার নদী, রূপের তরঙ্গ, বিদ্যার ঢেউ, বিলাসের ছড়াছড়ি।
কাঙ্ক্ষন্তঃ কর্মণাং সিদ্ধিং যজন্ত ইহ দেবতাঃ।
ক্ষিপ্রং হি মানুষে লোকে সিদ্ধির্ভবতি কর্মজা॥—গীতা, ৪।১২