০৮. হে স্বপন!
ভাল মন্দ যাই হয় হোক,
সুখের সুস্মিত হাসি দেখা দেয় যদি,
অথবা উদ্বেল হয় দুঃখ-পারাবার,
সবারি আপন অংশ আছে অভিনয়ে,
কারও হাসি কারও কান্না, যখন যেমন,
রয়েছে আপন সাজ প্রত্যেকের তরে—
রৌদ্র জলে আবর্তিয়া চলে দৃশ্যান্তর।
হে স্বপন! সার্থক স্বপন!
কাছে দূরে প্রসারিত কর মায়াজাল,
পেলব কোমল কর তীব্র রেখা যত,
সব রুক্ষতারে তুমি নম্র করে তোলো।
তোমারি মাঝারে আছে সব ইন্দ্রজাল।
তোমারি পরশে
প্রাণপুষ্পে হিল্লোলিত
জাগে মরুভূমি,
মধুর সঙ্গীতে ভরে
ঘনঘোর অশনি-গর্জন,
মৃত্যু আনে মধুময় মুক্তির আস্বাদ।
০৯. অকালে ফোটা একটি ফুলের প্রতি
তুষার-কঠিন মাটিই না হয় হোক না তোমার শয্যা,
আবরণ তব শীতার্ত ঝঞ্ঝার,
জীবনের পথে নাই বা জুটিল বন্ধুজনার হর্ষ,
ব্যর্থ তোমার সৌরভ-বিস্তার;
প্রেম যদি হয় নিজেই ব্যর্থ তবু কী-বা আসে যায়
না হয় ব্যর্থ সৌরভসঞ্চার—
অকল্যাণের জয় যদি হয়, কল্যাণ পরাজিত,
পুণ্যের ’পরে পাপের অত্যাচার;
তবু প্রশান্ত বিকশিত থাক, পবিত্র মধুময়
থাক অবিচল আপনার মহিমায়,
দাও, ঢেলে দাও স্নিগ্ধ উদার মধু সৌরভ তব
চির-প্রসন্ন অযাচিত করুণায়।
১০. কে জানে মায়ের খেলা!
কে জানে—হয়তো তুমি ক্রান্তদর্শী ঋষি!
সাধ্য কার স্পর্শ করে সে অতল গভীর গহন,
যেখানে লুকান রয় মা’র হাতে অমোঘ অশনি!
হয়তো পড়েছে ধরা উৎসুক করুণনেত্র শিশুর দৃষ্টিতে,
দৃশ্যের আড়ালে কোন ছায়ার সঙ্কেত,
মুহূর্তে যা হতে পারে দুর্নিবার ঘটনাপ্রবাহ।
আসে তারা কখন কোথায়, মা ছাড়া কে জানে!
হয়তো বা জ্ঞানদীপ্ত মহান্ তাপস,
বলেছেন যতটুকু,
তারও বেশী পেয়েছেন প্রাণে।
কে জানে কখন,
কার হৃদি-সিংহাসনে
মা আমার পাতেন আসন।
মুক্তিরে বাঁধিবে কোন্ নিয়মশৃঙ্খলে,
ইচ্ছারে ফিরাবে তাঁর কোন্ পুণ্যবলে,
সংসারের শ্রেষ্ঠ বিধি—খেয়াল তাঁহার
ইচ্ছামাত্র অমোঘ বিধান।
হয়তো শিশুর চোখে দিব্যদৃষ্টি জাগে,
স্বপ্নেও ভাবেনি যাহা পিতার হৃদয়,
হয়তো সহস্র শক্তি কন্যার অন্তরে
রেখেছেন বিশ্বমাতা সযত্ন সঞ্চয়।
১১. পানপাত্র
এই তব পানপাত্র, তোমারি উদ্দেশে
সৃষ্টির উন্মেষ হতে এ পাত্র-রচনা।
জানি জানি এ পানীয় কালকূট ঘোর,
তোমারি মন্থিত সুরা—দূর অতীতের
বাসনা বেদনা ভ্রান্তি যুগযুগান্তের।
দুর্গম দুঃসহ পন্থা—এই তব পথ,
প্রতি পদে অবিশ্রান্ত উপল-সঙ্ঘাত
সে আমারি দান। দিয়েছি বন্ধুরে তব
স্নিগ্ধ স্বচ্ছ পত্রখানি সানন্দযাত্রার।
তোমারি মতন সেও পাবে মোর বক্ষে
পরম আশ্রয়। তোমারে চলিতে হবে
এই পথ ধরে—এ নির্মম নিরানন্দ
নিঃসঙ্গ সাধন—আর কারও তরে নয়,
এ শুধু তোমার। মোর বিশ্বরচনায়
আছে তারও স্থান। লও এই পানপাত্র—
বুঝিতে বলিনি আমি, কি অর্থ ইহার,
শুধু চোখ বুঝে দেখ স্বরূপ আমার।
১২. জাগ্রত দেবতা
সেই এক বিরাজিত অন্তরে বাহিরে,
সব হাতে তাঁরি কাজ,
সব পায়ে তাঁরি চলা,
তাঁরি দেহ তোমরা সবাই,
কর তাঁর উপাসনা,
ভেঙে ফেলো আর সব পুতুল প্রতিমা।
মহামহীয়ান যিনি, দীন হতে দীন,
একাধারে কীট ও দেবতা যিনি,
পাপী পুণ্যবান,
দৃশ্যমান, জ্ঞানগম্য, সর্বব্যাপী, প্রত্যক্ষ মহান্,
কর তাঁর উপাসনা,
ভেঙে ফেলো আর সব পুতুল প্রতিমা।
অতীত জীবনধারা নাই তাঁর মাঝে,
অথবা আগামী কোন জনম মরণ,
নিয়ত ছিলাম মোরা তাঁহাতে বিলীন,
চিরকাল এক হয়ে রব তাঁরি বুকে।
কর তাঁর উপাসনা,
ভেঙে ফেলো আর সব পুতুল প্রতিমা।
ওরে মূর্খদল!
জীবন্ত দেবতা ঠেলি’,
অবহেলা করি’
অনন্ত প্রকাশ তাঁর এ ভুবনময়,
চলেছিস ছুটে মিথ্যা মায়ার পিছনে
বৃথা দ্বন্দ্ব কলহের পানে—
কর তাঁর উপাসনা, একমাত্র প্রত্যক্ষ দেবতা,
ভেঙে ফেলো আর সব পুতুল প্রতিমা।
৩. আলোক
সম্মুখে পশ্চাতে চেয়ে দেখি—
সব ঠিক, সকলি সার্থক।
বেদনার গভীর আমার
জ্বলে এক চিন্ময় আলোক।
১৪. শান্তিতে সে লভুক বিশ্রাম
চল আত্মা, শীঘ্রগতি, তারকা-খচিত তব পথে,
ধাও হে আনন্দময়, যেথা নাহি বাঁধে মনোরথে;
দেশকাল দৃষ্টিপথ যেথা নাহি করে আবরণ!
চিরশান্তি আশীর্বাদ যেথা করে তোমারে বরণ!
সার্থক তোমার সেবা, পরিপূর্ণ তব আত্মদান,
অপার্থিব প্রেমপূর্ণ হৃদয়েতে হোক তব স্থান;
মধুময় তব স্মৃতি দেশকাল দিয়াছে মিলায়ে,
বেদীতলে পুষ্পসম রেখে গেলে সৌরভ বিছায়ে!
টুটেছে বন্ধন তব, পেয়েছ সে আনন্দ-সন্ধান,
জন্মমৃত্যুরূপে যিনি, তাঁর সাথে হলে একপ্রাণ,
তুমি যে সহায় ছিলে, স্বার্থত্যাগী চির এ ধরায়,
আগে চল, সংসার-সংগ্রামে আনো প্রীতির সহায়
চল আত্মা, শীঘ্রগতি, তারকা-খচিত তব পথে,
ধাও হে আনন্দময়, যেথা নাহি বাঁধে মনোরথে;
দেশকাল দৃষ্টিপথ যেথা নাহি করে আবরণ!
চিরশান্তি আশীর্বাদ যেথা করে তোমারে বরণ!
সার্থক তোমার সেবা, পরিপূর্ণ তব আত্মদান,
অপার্থিব প্রেমপূর্ণ হৃদয়েতে হোক তব স্থান;
মধুময় তব স্মৃতি দেশকাল দিয়াছে মিলায়ে,
বেদীতলে পুষ্পসম রেখে গেলে সৌরভ বিছায়ে!
টুটেছে বন্ধন তব, পেয়েছ সে আনন্দ-সন্ধান,
জন্মমৃত্যুরূপে যিনি, তাঁর সাথে হলে একপ্রাণ,
তুমি যে সহায় ছিলে, স্বার্থত্যাগী চির এ ধরায়,
আগে চল, সংসার-সংগ্রামে আনো প্রীতির সহায়