০২. প্রবুদ্ধ ভারতের প্রতি
জাগো আরও একবার!
মৃত্যু নহে, এ যে নিদ্রা তব,
জাগরণে পুনঃ সঞ্চারিতে
নবীন জীবন, আরও উচ্চ
লক্ষ্য ধ্যান তরে, প্রদানিতে
বিরাম পঙ্কজ-আঁখি-যুগে।
হে সত্য! তোমার তরে হের
প্রতীক্ষায় আছে বিশ্বজন,
—তব মৃত্যু নাহি কদাচন। ১
হও পুনঃ অগ্রসর,
তব সেই ধীর পদক্ষেপে
নাহি যাহে হরে শান্তি তার,
নিরুদ্বেগে পথিপার্শ্বে স্থিত
দীন হীন ধূলি-কণিকার;
শক্তিমান্ তবু, মতি স্থির,
আনন্দ-মগন, মুক্ত, বীর;
হে সুপ্তিনাশন, চিরাগ্রণি!
ব্যক্ত কর তব বজ্রবাণী। ২
লুপ্ত সে জনম-গৃহ,
যেথা বহু স্নেহসিক্ত হিয়া
পালিলা শৈশবে, হর্ষভরে
নিরখিলা যৌবন-উন্মেষ;
কিন্তু হের নিয়তি সে ধরে অমোঘ প্রভাব—সৃষ্ট যাহা
প্রকৃতি-নিয়মে সবে-ফিরে
যেথা স্থান উদ্ভব-কারণ
লভিবারে প্রাণশক্তি পুনঃ। ৩
উরহ আবার তবে,
সেই তব জন্মস্থান হতে,
হিম-স্তূপ অভ্রকটিহার
আশীষিবে যেথায় সতত,
শক্তি দিবে করিয়া সঞ্চার
নব নব অসাধ্য সাধনে;
যেথা সুরনদী তব স্বর
বাঁধিবে অমর গীতি-সুরে;
দেবদারু ছায়া বিধানিবে
নিত্য শান্তি যেথা তব শিরে। ৪
সর্বোপরি, যিনি উমা
শান্তপূতা হিমগিরিসুতা
শক্তিরূপে প্রাণরূপে আর
জননী যে সর্বভূতে স্থিতা,
কার্য যাহা সবি কার্য যাঁর,
এক ব্রহ্ম করে প্রপঞ্চিত,
কৃপা যাঁর সত্যের দুয়ার
খুলি এক বহুতে দেখায়,
দিবে শক্তি সে জননী তোমা
ক্লান্তিহীন, স্বরূপ যাঁহার
অসীম, সে প্রেম পারাবার। ৫
আশীষিবে তোমা তাঁরা,
পরমর্ষি সবে, যাঁহাদের
কোন দেশ, কোন কাল নারে
শুধু আপনার বলিবারে,
—এ জাতির জনয়িতৃগণ—
সত্যের মরম যাঁরা সবে,
একই রূপ করি অনুভব,
নিঃসঙ্কোচে প্রচারিল ভবে ভাল মন্দ যেমন ভাষায়,
তুমি দাস তাঁহাদের, তায়
লভিয়াছ রহস্য সে মূল।
—বস্তু এক, ইথে নাহি ভুল। ৬
হে প্রেম! কহ সে তব
শান্ত স্নিগ্ধবাণী, মায়া-সৃষ্টি
যাহার স্পন্দনে লয় পায়,
স্তরে স্তরে ছায়াস্বপ্ন আর
হের সব শূন্যেতে মিলায়,
অবশেষে সত্য নিরমল
‘স্বে মহিম্নি’ বিরাজে কেবল। ৭
কহ আর বিশ্বজনে …
উঠ, জাগ, স্বপ্ন নহে আর।
স্বপন-রচনা শুধু ভবে—
কর্ম হেথা গাঁথে মালা যার
নাহি সূত্র বৃন্তমূলহীন
ভাল মন্দ পুষ্প ভাবনার,
জন্ম লভে, গর্ভে অসতের,
সত্যের মৃদুল শ্বাসে ধায়
আদিতে যে শূন্য ছিল তায়!
অভী হও, দাঁড়াও নির্ভয়ে
সত্যগ্রাহী, সত্যের আশ্রয়ে,
মিশি সত্যে যাও এক হয়ে,
মিথ্যা কর্ম-স্বপ্ন ঘুচে যাক—
কিম্বা থাকে স্বপ্নলীলা যদি,
হের সেই, সত্যে গতি যার,
থাক স্বপ্ন নিষ্কাম সেবার
আর থাক প্রেম নিরবধি। ৮
০৩. মৃত্যুরূপা মাতা
নিঃশেষে নিভেছে তারাদল, মেঘ এসে আবরিছে মেঘে,
স্পন্দিত ধ্বনিত অন্ধকার, গরজিছে ঘূর্ণ-বায়ুবেগে!
লক্ষ লক্ষ উন্মাদ পরাণ, বহির্গত বন্দীশালা হতে,
মহাবৃক্ষ সমূলে উপাড়ি’ ফুৎকারে উড়ায়ে চলে পথে!
সমুদ্র সংগ্রামে দিল হানা, উঠে ঢেউ গিরিচূড়া জিনি’
নভস্তল পরশিতে চায়! ঘোররূপা হাসিছে দামিনী,
প্রকাশিছে দিকে দিকে তার মৃত্যুর কালিমা মাখা গায়।
লক্ষ লক্ষ ছায়ার শরীর! দুঃখরাশি জগতে ছড়ায়,
নাচে তারা উন্মাদ তাণ্ডবে; মৃত্যুরূপা মা আমার আয়!
করালি! করাল তোর নাম, মৃত্যু তোর নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে
তোর ভীম চরণ-নিক্ষেপ প্রতিপদে ব্রহ্মাণ্ড বিনাশে!
কালি, তুই প্রলয়রূপিণী, আয় মা গো আয় মোর পাশে।
সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়, মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে,
কাল-নৃত্য করে উপভোগ, মাতৃরূপা তারি কাছে আসে।
০৪. খেলা মোর হল শেষ
কভু উঠি, কখনও বা পড়ি কালের তরঙ্গ সনে
গড়াইয়া চলিয়াছি হায়,
ক্ষণস্থায়ী এক দৃশ্য হতে স্বল্পস্থায়ী দৃশ্যান্তরে
জীবনের জোয়ার-ভাঁটায়।
অন্তহীন এই প্রহসনে তিক্ত আজি প্রাণ মোর;
আর ইহা নাহি লাগে ভাল,
মিছে ছোটা, পাব নাতো কভু, দেখা নাহি যায় দূরে,
সাগরের পারে তীর কালো!
জন্ম হতে জন্মান্তরাবধি দুয়ারে দাঁড়ায়ে আছি,
কভু দ্বার খুলিল না হায়,
আঁখি মম ক্ষীণ হল তবু, বৃথা আশা ধরিবারে
সে আলোর একটি ছটায়।
অতি ক্ষুদ্র এই জীবনের সমুচ্চ সঙ্কীর্ণ সেই
সেতু ’পরে দাঁড়াইয়া চাহি—
অগণিত জনগণ নীচে যুঝিছে, কাঁদিছে কেহ
হাসিতেছে—কেন জানি নাহি,
সম্মুখেতে ভীষণ কপাট ভ্রূভঙ্গে চাহিয়া বলে,
‘আর নাহি হও অগ্রসর,
এই সীমা অদৃষ্টের তব; প্রলুদ্ধ করো না আর,
যত পার সব সহ্য কর।
মিশে যাও ইহাদের সাথে পান কর হলাহল
নাচো গাও উহাদের সনে
জানিবারে বাসনা যাহার, দুঃখ আছে তার ভালে,
অতএব রহ এই স্থানে।’
আমি কিন্তু থাকিতে না চাই, জলবুদ্বুদের সম
ভাসমান এই পৃথ্বীতল,
শূন্যগর্ভ গঠন ইহার, শূন্যগর্ভ নাম তার,
জন্মমৃত্যু-শূন্য সে সকল।
মোর কাছে মিছা এই সব, আমি চাই ভেদিবারে
নামরূপ মিথ্যা অবয়বে,
খুলিবারে চাহি আমি ওই সম্মুখের প্রশস্ত কপাট—
মোর লাগি খুলিতেই হবে।
দুয়ার খুলিয়া দাও মাতঃ! হেরি পথ আলোক-ছটায়
খেলা মোর হইয়াছে শেষ—
অতি শ্রান্ত পুত্র তব মা গো, আকুল আকাঙ্ক্ষা হৃদে
গৃহে আজি করিবে প্রবেশ।
ঘন ঘোর অন্ধকার মাঝে খেলিতে ছাড়িয়া দিয়ে
বিভীষিকা দেখাও আমারে,
আশা মোর হল আজি শেষ, ভয় আসি দেখা দিল
খেলার আনন্দ গেল দূরে।
তপ্ত স্ফীত সাগর সমান গভীর দুঃখের মাঝে
রিপুদল প্রবল তাড়নে,
তরঙ্গে বিক্ষিপ্ত হেথা সেথা কত কষ্ট পাই মা গো
ভবিষ্যৎ সুখের ছলনে।
জীবনের অর্থ হেথা হায় জীবন্ত মরণ, আর
মরণ যে কেবা বলো জানে—
সুখদুঃখ নিয়ত-চক্রের পুনঃ সেই প্রবর্তন
নব আবর্তন নাহি আনে।
শিশু দেখে মধুর স্বপন— স্বর্ণসম সমুজ্জ্বল,
ধূলিতে তা হয় পরিণত,
পশ্চাতে ফিরিয়া দেখে হায়— ভগ্ন তার শত আশা,
পুঞ্জীভূত মরিচার মত।
জীবনের শেষপ্রান্তে যবে বিলম্বে লভিয়া জ্ঞান
চক্র ছাড়ি যাই মোরা চলি,
অন্যজন নবতেজ লয়ে সে চক্র ঘুরাতে আসে
দিন যায় বর্ষ পড়ে ঢলি।
ঘোরে চক্র অবিরত বেগে মায়া-ক্রীড়নক মাত্র
কামনা ইহার কেন্দ্রস্থল,
বৃথা আশা দেয় গতিবেগ এ চক্রের দণ্ড যত
সুখ দুঃখ অনিত্য কেবল।
ভাসিয়া চলেছি আজ আমি, কোথা তাহা নাহি জানি,
এ অনলে বাঁচাও গো আসি,
করুণা-আধার তুমি মা গো, রক্ষা কর মোরে, যেন
কামনা-সাগরে নাহি ভাসি।
ফিরায়ো না দেখায়ো না মোরে, ভয়ঙ্কর মুখ তব
সহিতে পারি না আমি এত,
ক্ষমা কর দেহ মা অভয় সদয়া হও গো আজি
দোষ মম নাহি ধর মাতঃ!
নিয়ে যাও জননি গো মোরে সেই দূরে পরপারে,
যেথায় সকল দ্বন্দ্ব শেষ,
সকল দুঃখের পারে, অশ্রু যেথা নাহি দেখা দেয়
পার্থিব সুখেরও নাহি লেশ।
যাহার গরিমা রবি শশী, অনন্ত তারকারাজি
উজলিত আকাশের পটে,
ক্ষণপ্রভা রূপের ছটায় প্রকাশিতে নাহি পারে
মাত্র তার প্রতিবিম্ব রটে।
দেখো যেন মিছা স্বপ্নে মা গো তোমার মু’খানি হতে
আমারে আড়াল নাহি করে,
খেলা মোর হল আজি শেষ, শৃঙ্খল ভাঙিয়া দাও,
মুক্ত আজি কর মা আমারে।