৩৭৩*
(স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত)
শ্রীনগর, কাশ্মীর
৩০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
তোমার স্নেহপূর্ণ চিঠিখানি পেয়েছি, মঠের চিঠিও পেয়েছি। দু-তিন দিনের মধ্যেই আমি পাঞ্জাব রওনা হচ্ছি। বিলাতী ডাক এসেছে। মিস নোব্ল্ তার পত্রে যে-সব প্রশ্ন করেছে সেগুলি সম্বন্ধে আমার উত্তর এইঃ
(১) প্রায় সব শাখা-কেন্দ্রই খোলা হয়েছে, তবে এখনও আন্দোলনের আরম্ভ মাত্র।
(২) সন্ন্যাসীদের অধিকাংশই শিক্ষিত, যারা তা নয় তারাও লৌকিক শিক্ষা পাচ্ছে। কিন্তু অকপট নিঃস্বার্থপরতাই সৎকার্যের জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। সে উদ্দেশ্যে অন্য সব শিক্ষার চেয়ে আধ্যাত্মিক শিক্ষার দিকেই সমধিক মনোযোগ দেওয়া হয়।
(৩) লৌকিক বিদ্যার শিক্ষকবৃন্দঃ আমরা যাদের কর্মিরূপে পাচ্ছি তাদের অধিকাংশই শিক্ষিত। এক্ষণে আবশ্যক—শুধু তাহাদিগকে আমাদের কার্য-প্রণালী শেখান এবং চরিত্র গঠন করা। শিক্ষার উদ্দেশ্য—তাহাদিগকে আজ্ঞানুবর্তী ও নির্ভীক করা; আর তার প্রণালী হচ্ছে—প্রথমতঃ গরীবদের জীবনযাত্রার ব্যবস্থা করা এবং ক্রমে মানসিক উচ্চতর স্তরগুলির দিকে এগিয়ে যাওয়া।
শিল্প ও কলাঃ অর্থাভাবহেতু আমাদের কর্মতালিকার অন্তর্গত এই অংশ এখনও আরম্ভ করতে পারছি না। বর্তমানে যে সোজা কাজটুকু করা চলে, তা হচ্ছে—ভারতবাসীদিগকে স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা এবং ভারতীয় শিল্পদ্রব্যাদি যাতে ভারতের বাইরে বিক্রয় হয়, তার জন্য বাজার সৃষ্টি করা। যারা নিজেরা দালাল নয়, পরন্তু এই শাখার সমস্ত লভ্যাংশ শিল্পীদের উপকারের জন্য ব্যয় করতে প্রস্তুত, কেবল তাদের দ্বারাই এ কাজ করান উচিত।
(৪) জায়গায় জায়গায় ঘুরে বেড়ান ততদিনই প্রয়োজন হবে, যতদিন না জনসাধারণ শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়। অন্য সব কিছু অপেক্ষা পরিব্রাজক সন্ন্যাসীদের ধর্মভাব ও ধর্মজীবন সমধিক কার্যকর হবে।
(৫) সকল জাতির মধ্যে আমাদের প্রভাব বিস্তারিত হবে। এ পর্যন্ত উচ্চ স্তরের মধ্যেই কেবল কাজ হয়েছে; কিন্তু দুর্ভিক্ষ-সাহায্যকেন্দ্রগুলিতে আমাদের কর্মবিভাগের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে নিম্নতর জাতিগুলিকেও আমরা প্রভাবিত করতে পারছি।
(৬) প্রায় সকল হিন্দুই আমাদের কাজ সমর্থন করেন; কিন্তু এই জাতীয় কার্যে প্রত্যক্ষ সহায়তা করতে তাঁরা অভ্যস্ত নহেন।
(৭) হাঁ, আমরা গোড়া থেকেই আমাদের দান ও অন্যান্য সৎকার্যে ভারতীয় বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মধ্যে ইতরবিশেষ করি না।১২৯
এই সূত্র আনুসারে মিস নোব্ল্কে চিঠি লিখলেই হবে। যোগেনের চিকিৎসার যেন কোন ত্রুটি না হয়—আসল ভেঙেও টাকা খরচ করবে। ভবনাথের স্ত্রীকে দেখতে গিয়েছিলে কি?
ব্রহ্মচারী হরিপ্রসন্ন যদি আসতে পারে তো বড় ভাল হয়। মিঃ সেভিয়ার একটা স্থানের জন্য বড়ই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে—যা হয় একটা শীঘ্র করে ফেলতে পারলে হয়। হরিপ্রসন্ন ইঞ্জিনীয়ার মানুষ, ঝট করে কিছু করতে পারবে। আর জায়গা-টায়গা সে ব্যক্তি বোঝেও ভাল। দেরাদুন মসূরীর নিকট একটা জায়গা হওয়া তাদের পছন্দ—অর্থাৎ যেখানে বেশী শীত না হয় এবং বার মাস থাকা চলে। হরিপ্রসন্নকে অতএব একদম আম্বালায় শ্যামাপদ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ী, মেডিকেল হল, আম্বালা ক্যাণ্টনমেণ্ট-এ পাঠাবে পত্রপাঠ। আমি পাঞ্জাবে নেমেই সেভিয়ারকে তার সঙ্গে দিয়ে পাঠাব। আমি ঝাঁ করে পাঞ্জাবটা হয়ে করাচি দিয়ে কাথিয়াওয়াড় গুজরাট না হয়ে রাজপুতানার ভিতর দিয়ে নেপাল হয়ে চট করে চলে আসছি। তুলসী যে মধ্যভারতে গেছে—সে কি দুর্ভিক্ষকার্যের জন্য? এখানে আমরা সব ভাল আছি …। সাধারণ স্বাস্থ্য খুব ভাল ও ডায়েবেটিস অনেকদিন ভাগলওয়া হয়েছেন—আর কোন ভয় করব না। সকলকে আমার আশীর্বাদ, প্রণাম ও ভালবাসা দিও। কালী নিউ ইয়র্কে পৌঁছিয়াছে, খবর পাইয়াছি; কিন্তু সে কোন চিঠিপত্র লিখে নাই। স্টার্ডি লিখছে, তার Work (কাজ) এত বেড়ে উঠেছিল যে, লোকে অবাক হয়ে যায়—আবার দু-চারজন তার খুব প্রশংসা করে চিঠিও লিখেছে। যা হোক, আমেরিকাতে অত গোল নাই—এক রকম চলে যাবে। শুদ্ধানন্দ এবং তার ভাইকেও হরিপ্রসন্নর সঙ্গে পাঠাবে—এ দলের মধ্যে খালি গুপ্ত আর অচ্যুত আমার সঙ্গে থাকবে। ইতি
বিবেকানন্দ
৩৭৪*
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
শ্রীনগর, কাশ্মীর
৩০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৭
প্রিয় মিস ম্যাকলাউড,
তোমার আসার যদি ইচ্ছাই থাকে, তবে তাড়াতাড়ি চলে এস। নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুআরীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতে ঠাণ্ডা, তারপরে গরম। তুমি যা দেখতে চাও, তা ঐ সময়ের মধ্যেই হয়ে যাবে; কিন্তু সব কিছু দেখতে গেলে অবশ্য বছর-কয়েক লাগবে।
সময় বড় অল্প; তাই তাড়াতাড়ি এই কার্ড লেখার জন্য মনে কিছু করো না। অনুগ্রহ করে মিসেস বুলকে আমার আন্তরিক ভালবাসা জানাবে এবং গুডউইন যেন শীঘ্র সেরে ওঠে, সেজন্য আমার শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক প্রার্থনা জানাচ্ছি। মা, এলবার্টা, ছোট্ট শিশুটি ও হলিস্টারকে আমার ভালবাসা জানাবে; এবং সর্বশেষে, কিন্তু তাই বলে সব চেয়ে কম নয়, ফ্র্যাঙ্কিকেও আমার অনুরূপ ভালবাসাই জানাবে। ইতি
সতত ভগবদাশ্রিত
বিবেকানন্দ
০২. কবিতা (অনুবাদ)
০১. সন্ন্যাসীর গীতি
উঠাও সন্ন্যাসি, উঠাও সে তান,
হিমাদ্রিশিখরে উঠিল যে গান—
গভীর অরণ্যে পর্বত-প্রদেশে
সংসারের তাপ যথা নাহি পশে,
যে সঙ্গীত-ধ্বনি-প্রশান্ত-লহরী
সংসারের রোল উঠে ভেদ করি;
কাঞ্চন কি কাম কিম্বা যশ-আশ
যাইতে না পারে কভু যার পাশ;
যথা সত্য-জ্ঞান-আনন্দ-ত্রিবেণী
—সাধু যায় স্নান করে ধন্য মানি,
উঠাও সন্ন্যাসি, উঠাও সে তান,
গাও গাও গাও, গাও সেই গান—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ১
ভেঙে ফেল শীঘ্র চরণ-শৃঙ্খল—
সোনার নির্মিত হলে কি দুর্বল,
হে ধীমান্, তারা তোমার বন্ধনে?
ভাঙ শীঘ্র তাই ভাঙ প্রাণপণে।
ভালবাসা-ঘৃণা, ভাল-মন্দ-দ্বন্দ্ব,
ত্যজহ উভয়ে, উভয়েই মন্দ।
আদর’ দাসেরে, কশাঘাত কর,
দাসত্ব-তিলক ভালের উপর;
স্বাধীনতা-বস্তু কখনও জানে না,
স্বাধীন আনন্দ কভু তো বুঝে না।
তাই বলি, ওহে সন্ন্যাসিপ্রবর,
দূর কর দুয়ে অতীব সত্বর;
কর কর গান, কর নিরন্তর—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ২
যাক অন্ধকার, যাক সেই তমঃ,
আলেয়ার মত বুদ্ধির বিভ্রম
ঘটায়ে আঁধার হইতে আঁধারে
লয়ে যায় এই ভ্রান্ত জীবাত্মারে।
জীবনের এই তৃষা চিরতরে
মিটাও জ্ঞানের বারি পান করে।
এই তম-রজ্জু জীবাত্মা-পশুরে
জন্মমৃত্যু-মাঝে আকর্ষণ করে।
সে-ই সব জিনে—নিজে জিনে যেই,
ফাঁদে পা দিও না—জেনে তত্ত্ব এই।
বলহ সন্ন্যাসি, বল বীর্যবান্—
করহ আনন্দে কর এই গান—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৩
‘কৃত কর্মফল ভুঞ্জিতে হইবে’
বলে লোকে, ‘হেতু কার্য প্রসবিবে,
শুভ কর্মে—শুভ, মন্দে—মন্দ ফল,
এ নিয়ম রোধে নাহি কারও বল।
এ মর-জগতে সাকার যে জন,
শৃঙ্খল তাহার অঙ্গের ভূষণ।’
সত্য সব, কিন্তু নামরূপ-পারে
নিত্যমুক্ত আত্মা আনন্দে বিহরে।
জান ‘তত্ত্বমসি’, করো না ভাবনা‚
করহ সন্ন্যাসি, সদাই ঘোষণা—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৪
সত্য কিবা তারা জানে না কখনও,
সবাই যাহারা দেখয়ে স্বপন—
পিতা মাতা জায়া অপত্য বান্ধব—
আত্মা তো কখনও নহে এই সব;
নাহি তাহে কোন লিঙ্গালিঙ্গভেদ,
নাহিক জনম, নাহি খেদাখেদ।
কার পিতা তবে, কাহার সন্তান?
কার বন্ধু শত্রু কাহার ধীমান?
একমাত্র যেবা—যেবা সর্বময়,
যাহা বিনা কোন অস্তিত্বই নয়,
‘তত্ত্বমসি’ ওহে সন্ন্যাসিপ্রবর,
উচ্চরবে তাই এই তান ধর—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৫
একমাত্র মুক্ত জ্ঞাতা আত্মা হয়,
অনাম অরূপ অক্লেদ নিশ্চয়;
তাঁহার আশ্রয়ে এ মোহিনী মায়া
দেখিছে এ সব স্বপনের ছায়া;
সাক্ষীর স্বরূপ—সদাই বিদিত,
প্রকৃতি-জীবাত্মারূপে প্রকাশিত;
‘তত্ত্বমসি’ ওহে সন্ন্যাসিপ্রবর,
ধর ধর ধর, উচ্চ তান ধর—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৬
অন্বেষিছ মুক্তি কোথা বন্ধুবর?
পাবে না তো হেথা, কিম্বা এর পর;
শাস্ত্রে বা মন্দিরে বৃথা অন্বেষণ;
নিজ হস্তে রজ্জু—যাহে আকর্ষণ।
ত্যজ অতএব বৃথা শোকরাশি,
ছেড়ে দাও রজ্জু, বল হে সন্ন্যাসি—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৭
দাও দাও দাও সবারে অভয়,
বল—‘প্রাণিজাত, করো নাকো ভয়;
ত্রিদিব পাতাল থাক যে যেখান,
সকলের আত্মা আমি বিদ্যমান;
স্বরগ নরক, ইহামুত্রফল
আশা ভয় আমি ত্যজিনু সকল।’
এইরূপে কাটো মায়ার বন্ধন,
গাও গাও গাও করে প্রাণপণ—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৮
ভেবো না দেহের হয় কিবা গতি,
থাকে কিম্বা যায়—অনন্ত নিয়তি;
কার্য অবশেষ হয়েছে উহার,
এবে ওতে প্রারব্ধের অধিকার;
কেহ বা উহারে মালা পরাইবে,
কেহ বা উহারে পদ প্রহারিবে;
চিত্তের প্রশান্তি ভেঙো না কখনও,
সদাই আনন্দে রহিবে মগন;
কোথা অপযশ—কোথা বা সুখ্যাতি?
স্তাবক-স্তাব্যে একত্ব-প্রতীতি,
অথবা নিন্দুক-নিন্দ্যের যেমতি।
জানি এ একত্ব আনন্দ-অন্তরে,
গাও হে সন্ন্যাসি, নির্ভীক অন্তরে—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৯
পশিতে পারে না কভু তথা সত্য,
কাম-লোভ-বশে যেই হৃদি মত্ত;
কামিনীতে করে স্ত্রীবুদ্ধি যে জন,
হয় না তাহার বন্ধন-মোচন;
কিম্বা কিছু দ্রব্যে যার অধিকার,
হউক সামান্য—বন্ধন অপার;
ক্রোধের শৃঙ্খল কিম্বা পায়ে যার,
হইতে না পারে কভু মায়া পার।
ত্যজ অতএব এ সব বাসনা,
আনন্দে সদাই কর হে ঘোষণা—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ১০
সুখ তরে গৃহ করো না নির্মাণ,
কোন্ গৃহ তোমা ধরে, হে মহান্?
গৃহছাদ তব অনন্ত আকাশ,
শয়ন তোমার সুবিস্তৃত ঘাস;
দৈববশে প্রাপ্ত যাহা তুমি হও,
সেই খাদ্যে তুমি পরিতৃপ্ত রও;
হউক কুৎসিত, কিম্বা সুরন্ধিত,
ভুঞ্জহ সকলি হয়ে অবিকৃত।
শুদ্ধ আত্মা যেই জানে আপনারে,
কোন্ খাদ্য-পেয় অপবিত্র করে?
হও তুমি চল-স্রোতস্বতী মত,
স্বাধীন উন্মুক্ত নিত্য-প্রবাহিত।
উঠাও আনন্দে উঠাও সে তান,
গাও গাও গাও সদা এই গান—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ১১
তত্ত্বজ্ঞের সংখ্যা মুষ্টিমেয় হয়,
অ-তত্ত্বজ্ঞ তোমা হাসিবে নিশ্চয়;
হে মহান্, তোমা করিবেক ঘৃণা,
তাহাদের দিকে চেয়েও দেখো না।
স্বাধীন উন্মুক্ত—যাও স্থানে স্থানে,
অজ্ঞান হইতে উদ্ধারো অজ্ঞানে—
মায়া-আবরণে ঘোর অন্ধকারে,
নিয়তই যারা যন্ত্রণায় মরে।
বিপদের ভয় করো না গণনা,
সুখ অন্বেষণে যেন হে মেতো না;
যাও এ উভয় দ্বন্দ্ব-ভূমিপারে,
গাও গাও গাও, গাও উচ্চস্বরে—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ১২
এইরূপে বন্ধো, দিন পর দিন,
করমের শক্তি হয়ে যাবে ক্ষীণ;
আত্মার বন্ধন ঘুচিয়া যাইবে,
জনম তাহার আর না হইবে;
‘আমি’ বা ‘আমার’ কোথায় তখন?
ঈশ্বর—মানব—তুমি—পরিজন—
সকলেতে ‘আমি’, আমাতে সকল—
আনন্দ, আনন্দ, আনন্দ কেবল।
সে আনন্দ তুমি, ওহে বন্ধুবর,
তাই হে আনন্দে ধর তান ধর—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ১৩