তোমার এক পত্রে সকল সমাচার জ্ঞাত হইলাম। নিরঞ্জন, লাটু, কৃষ্ণলাল, দীননাথ, গুপ্ত ও অচ্যুত আমার সঙ্গে কাশ্মীর যাইতেছে।
মান্দ্রাজ হইতে যে ব্যক্তি famine work-এ (দুর্ভিক্ষ-সেবাকার্যে) ১৫০০ টাকা দিয়াছে, সে চায় যে তাহার বিশেষ টাকা কি কি খরচে গেল—তাহার একটি তালিকা। উহা তাহাকে পাঠাইবে। আমরা এক রকম আছি ভাল। ইতি
বিবেকানন্দ
পুঃ—মঠের সকলকে আমার ভালবাসা দিবে।
৩৬৭
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
C/o ঋষিবর মুখোপাধ্যায়
প্রধান বিচারপতি, শ্রীনগর, কাশ্মীর
১৩ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
এক্ষণে কাশ্মীর। এদেশ সম্বন্ধে যে প্রশংসা শুনিয়াছ, তাহা সত্য। এমন সুন্দর দেশ আর নাই, আর লোকগুলিও সুন্দর, তবে ভাল চক্ষু হয় না। কিন্তু এমন নরককুণ্ডের মত ময়লা গ্রাম ও শহর আর কোথাও নাই। শ্রীনগরে ঋষিবরবাবুর বাড়ীতে ওঠা গেছে। তিনি বিশেষ যত্নও করছেন। আমার চিঠিপত্র তাঁর ঠিকানায় পাঠাইবে। আমি দু-এক দিনের মধ্যে অন্যত্র বেড়াইতে যাইব; কিন্তু আসিবার সময় পুনরায় শ্রীনগর হইয়া আসিব এবং চিঠিপত্রও পাইব। গঙ্গাধর সম্বন্ধে যে চিঠি পাঠাইয়াছ, তা দেখিলাম। তাহাকে লিখিবে যে মধ্যপ্রদেশে অনেক orphan (অনাথ) রহিয়াছে ও গোরখপুরে। সেখান হইতে পাঞ্জাবীরা অনেক ছেলেপুলে আনাইতেছে। মহেন্দ্রবাবুকে বলিয়া কহিয়া একটা এ-বিষয়ে agitation (আন্দোলন) করা উচিত—যাহাতে কলিকাতার লোকে ঐ-সকল orphan-এর charge (ভার) নেয়, সে বিষয়ে একটা আন্দোলন হওয়া উচিত—বিশেষতঃ যাহাতে মিশনরীরা যে-সকল orphan (অনাথ) লইয়াছে, তাহাদের যেন ফিরাইয়া দেয়—সে-বিষয়ে গভর্ণমেণ্টকে Memorial (স্মারকলিপি) দেওয়া উচিত। গঙ্গাধরকে আসিতে বল এবং রামকৃষ্ণ-সভার তরফ হইতে এ-বিষয়ে একটা বিষম হুজ্জুক করা উচিত। কোমর বেঁধে বাড়ী বাড়ী গিয়ে হুজ্জুক কর। Mass meeting (জনসভা) করাও ইত্যাদি। সিদ্ধি হউক না হউক—একটা বিষম গোলমাল কর। Central Province (মধ্যপ্রদেশ) এবং গোরখপুর ইত্যাদিতে যে-সব প্রধান বাঙালী আছে, তাদের পত্র লিখে সব facts (বিবরণ) জানাও এবং তুমুল আন্দোলন কর। রামকৃষ্ণ-সভা একদম জেঁকে যাক। হুজুকের উপর হুজ্জুক—বিরাম না যেন হয়, এই হল secret (রহস্য)। সারদার কার্যের পরিপাটি দেখে খুব খুশী হলাম। গঙ্গাধর এবং সারদা যেখানে যেখানে গেছে, সেই সেই জেলায় এক একটা centre (কেন্দ্র) না করে আর যেন বিরত না হয়।
এইমাত্র গঙ্গাধরের পত্র পাইলাম। সে ঐ জেলায় centre (কেন্দ্র) করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ—বেশ কথা। তাহাকে লিখিও যে, তাহার বন্ধু ম্যাজিষ্ট্রেট আমার পত্রের অতি সুন্দর উত্তর দিয়াছেন। কাশ্মীর হইতে নামিয়াই লাটু, নিরঞ্জন, দীনু ও খোকাকে পাঠাইয়া দিব; কারণ উহাদের এখানে আর কোন কার্য সম্ভব নয়, এবং কুড়ি-পঁচিশ দিনের মধ্যে শুদ্ধানন্দ, সুশীল ও আর একজনকে পাঠাইবে। তাহাদের আম্বালায় ক্যাণ্টনমেণ্ট মেডিকেল হল, শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়ের বাটীতে পাঠাইবে। আমি সেখান হতে লাহোরে যাইব। দুটো করে গেরুয়া রঙের মোটা গেঞ্জি, পাতবার আর মুড়ি দেবার দুই দুই কম্বল, আর গায়ে দেবার একটা করে গরম কাপড় ইত্যাদি লাহোরে কিনিয়া দিব। যদি ‘রাজযোগ’ বইয়ের অনুবাদ হইয়া গিয়া থাকে তো তাহা ছাপাইবে ঘরের পয়সায়। … ভাষা যেখানে দুরূহ আছে, তাহা অতি সরল করিবে এবং যদি পারে—তুলসী তাহার একটা হিন্দী তর্জমা করুক। ঐ বইগুলি বাহির হইলে মঠের অনেক সাহায্য হয়।
তোমার শরীর—বোধ হয় এক্ষণে বেশ আছে। আমার শরীর ধর্মশালা … যাওয়া অবধি এখনও বেশ আছে। ঠাণ্ডাটিই বেশ লাগে এবং শরীর ভাল থাকে। কাশ্মীরের দু-একটা জায়গা দেখিয়া একটা উত্তম স্থানে চুপ করিয়া বসিব—এই প্রকার ইচ্ছা, অথবা জলে জলে ঘুরিব। যাহা ডাক্তারবাবু বলেন, তাহাই করিব। এখানে রাজা এখন নাই। তাঁহার মেজভাই সেনাপতি আছেন। তাঁহার সম্পাদকতায় একটা বক্তৃতা হইবার উদ্যোগ হইতেছে। যাহা হয় পরে লিখিব। দু-এক দিনের মধ্যে যদি হয় তো থাকিব; নহিলে আমি বেড়াইতে চলিলাম। সেভিয়ার মরীতেই রহিল। তাহার শরীর বড়ই অসুস্থ—টাঙ্গার ঝটকায়। মরীর বাঙালী বাবুরা বড়ই ভাল এবং ভদ্র।
জি. সি. ঘোষ, অতুল, মাষ্টার মহাশয় প্রভৃতি সকলকে আমার সাষ্টাঙ্গ দিবে ও সকলকে তাতাইয়া রাখিবে। যোগেন যে বাটী কিনিবার কথা বলিয়াছিল, তাহার খবর কি? আমি এখান হইতে অক্টোবর মাসে নামিয়া পাঞ্জাবে দু-চারটি লেকচার দিব। তাহার পর সিন্ধু হইয়া কচ্ছ, ভুজ ও কাথিয়াওয়াড়—সুবিধা হইলে পুণা পর্যন্ত, নহিলে বরোদা হইয়া রাজপুতানা। রাজপুতানা হইয়া N. W. P (উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ) ও নেপাল, তারপর কলিকাতা—এই তো প্রোগ্রাম এখন; পরে প্রভু জানেন। সকলকে আমার প্রণাম আশীর্বাদ ইত্যাদি।
বিবেকানন্দ
৩৬৮*
[মেরী হেলবয়েস্টারকে লিখিত]
C/o ঋষিবর মুখোপাধ্যায়
প্রধান বিচারপতি, শ্রীনগর, কাশ্মীর
১৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৭
প্রিয় শুদ্ধানন্দ,
অবশেষে আমরা কাশ্মীরে এসে পড়েছি। এ জায়গার সব সৌন্দর্যের কথা তোমায় লিখে আর কি হবে? আমার মতে এই হচ্ছে একমাত্র দেশ, যা যোগীদের অনুকূল। কিন্তু এদেশের যারা বর্তমান অধিবাসী, তাদের অপূর্ব দৈহিক সৌন্দর্য থাকলেও তারা অত্যন্ত অপরিষ্কার! এদেশের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখবার জন্য এবং শারীরিক শক্তিলাভের জন্য আমি এক মাস জলে জলে ঘুরে বেড়াব। কিন্তু নগরটিতে এখন ভয়ানক ম্যালেরিয়া এবং সদানন্দ ও কৃষ্ণলালের জ্বর হয়েছে। সদানন্দ আজ ভাল আছে, কিন্তু কৃষ্ণলালের এখনও জ্বর আছে। ডাক্তার আজ এসে তার জোলাপের ব্যবস্থা করে গেছেন। আমরা আশা করি, সে কালকের মধ্যে সেরে উঠবে এবং আমরা যাত্রাও করব কাল। কাশ্মীর গভর্ণমেণ্ট আমাকে তাঁদের একখানি বজরা ব্যবহার করতে দিয়েছেন, বজরাটি বেশ সুন্দর, আরামপ্রদ। তাঁরা জেলার তহশিলদারদের উপরও আদেশ জারি করেছেন। এদেশের লোকেরা আমাদের দেখবার জন্য দল বেঁধে আসছে; আমাদের সুখে রাখার জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবই করছে।