মিসেস সেভিয়ার নারীকুলের রত্নবিশেষ; এত ভাল, এত স্নেহময়ী তিনি! সেভিয়ার-দম্পতিই একমাত্র ইংরেজ, যাঁরা এদেশীয়দের ঘৃণা করেন না; এমন কি স্টার্ডিকেও বাদ দেওয়া চলে না। একমাত্র সেভিয়াররাই আমাদের উপর মুরুব্বিয়ানা করতে এদেশে আসেননি। কিন্তু তাঁদের এখনও কোন নির্দিষ্ট কার্যপ্রণালী নেই। তুমি এলে তোমার সহকর্মীরূপে তাঁদের পেতে পার এবং তাতে তোমার ও তাঁদের—উভয়েরই সুবিধা হবে। কিন্তু আসল কথা এই যে, নিজের পায়ে অবশ্যই দাঁড়াতে হবে।
আমেরিকার সংবাদে জানলাম যে, আমার দুজন বন্ধু—মিস ম্যাকলাউড ও বোষ্টনের মিসেস বুল এই শরৎকালেই ভারত-পরিভ্রমণে আসছেন। মিস ম্যাকলাউডকে তুমি লণ্ডনেই দেখছ—সেই পারি-ফ্যাশনের পোষাক-পরিহিতা মহিলাটি! মিসেস বুলের বয়স প্রায় পঞ্চাশ এবং তিনি আমেরিকায় আমার বিশেষ উপকারী বন্ধু ছিলেন। তাঁরা ইওরোপের হয়ে এদেশে আসছেন; সুতরাং আমার পরামর্শ এই যে, তাঁদের সঙ্গে এলে তোমার পথের একঘেয়েমি দূর হতে পারে।
মিঃ স্টার্ডির কাছ থেকে শেষ পর্যন্ত একখানা চিঠি পেয়ে সুখী হয়েছি। কিন্তু চিঠিটি বড় শুষ্ক এবং প্রাণহীন। লণ্ডনের কাজ পণ্ড হওয়ায় তিনি হতাশ হয়েছেন বলে মনে হয়।
অনন্ত ভালবাসা জানবে। ইতি
সদা ভগবৎ-পদাশ্রিত
বিবেকানন্দ
৩৬১
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
আলমোড়া
২৯ জুলাই, ১৮৯৭
প্রিয় শশী,
তোমার কাজকর্ম বেশ চলছে, খবর পাইলাম। তিনটি ভাষ্য বেশ করে পড়ে রাখবে, আর ইওরোপীয় দর্শনাদিও বেশ করে পড়বে, ইহাতে অন্যথা না হয়। পরকে মারতে গেলে ঢাল-তলওয়ার চাই, এ কথা যেন ভুল একদম না হয়। সুকুল এক্ষণে পৌঁছিয়াছে, তোমার সেবাদিও বেশ চলছে বোধ হয়। সদানন্দ যদি সেখানে থাকিতে না চায়, কলিকাতায় পাঠাইয়া দিবে, এবং প্রতি সপ্তাহে একটা রিপোর্ট—আয়-ব্যয় প্রভৃতি সব সমেত মঠে পাঠাইতে ভুল যেন না হয়। আলাসিঙ্গার বোনাই এখানে বদ্রী শা-র নিকট হতে চারিশত টাকা ধার করিয়া লইয়া গিয়াছে; পৌঁছিবামাত্র পাঠাইবার কথা, এখনও কেন পাঠাইল না। আলাসিঙ্গাকে জিজ্ঞাসিবে এবং সত্বর পাঠাইতে কহিবে; কারণ আমি পরশুদিন এখান হতে যাচ্ছি—মসূরী পাহাড় বা অন্য কোথাও যাই পরে ঠিক করব। কাল এখানে ইংরেজ-মহলে এক লেকচার হয়েছিল, তাতে বড়ই খুশী। কিন্তু তার আগের দিন হিন্দীতে এক বক্তৃতা করি, তাতে আমি বড়ই খুশী—হিন্দীতে যে oratory (বাগ্মিতা) করতে পারব তা তো আগে জানতাম না। মঠে ছেলেপুলে যোগাড় হচ্ছে কি? যদি হয় তো কলিকাতায় যেভাবে কার্য হচ্ছে, ঠিক সেইভাবে করে যাও। নিজের বুদ্ধি এখন কিছুদিন বেশী খরচ করবে না, পাছে ফুরিয়ে যায়—কিছুদিন পরে করো।
তোমার শরীরের উপর বিশেষ লক্ষ্য রাখবে—তবে বিশেষ আতুপুতুতে শরীর উল্টা আরও খারাপ হয়ে যায়। বিদ্যের জোর না থাকলে কেউ ঘণ্টা-ফণ্টা মানবে না—এ-কথাটা নিশ্চিত, এবং এইটি মনে স্থির রেখে কার্য করবে।
আমার হৃদয়ের ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানিবে ও গুডউইন প্রভৃতিকে জানাইবে। ইতি
বিবেকানন্দ
৩৬২
[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
আলমোড়া
৩০ জুলাই, ১৮৯৭
কল্যাণবরেষু,
তোমার কথামত ডিষ্ট্রীক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট লেভিঞ্জ সাহেবকে এক পত্র লিখিলাম। অপিচ তুমি তাঁহার বিশেষ বিশেষ কার্যকলাপ বিবৃত করিয়া শশী-ডাক্তারকে দিয়া দেখাইয়া ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’-এ একটি লম্বাচওড়া পত্র লিখিবে ও তাহার এক কপি উক্ত মহোদয়কে পাঠাইবে। আমাদের মূর্খগুলো খালি দোষ অনুসন্ধান করে, গুণও কিঞ্চিৎ দেখুক।
আমি আগামী সোমবার এস্থান হইতে প্রস্থান করিতেছি।
Orphan (অনাথ বালক) যোগাড়ের কি করছ? মঠ হতে চারি-পাঁচজনকে না হয় ডাকিয়া লও, গাঁয়ে গাঁয়ে খুঁজিলে দুদিনেই মিলিবার সম্ভাবনা।
Permanent Centre (স্থায়ী কেন্দ্র) করিতে হইবে বৈকি। আর—দেবকৃপা না হলে এদেশে কি কাজ হয়? রাজনীতি ইত্যাদিতে কোন যোগ দিবে না অথবা সংস্রব রাখিবে না। অথচ তাদের সহিত কোন বিবাদাদিতেও কাজ নাই। একটা কার্যে তন্ মন ধন। এখানে একটি—সাহেবমহলে-ইংরেজী বক্তৃতা হইয়াছিল, ও একটি—দেশী লোকদিগকে হিন্দীতে। হিন্দীতে আমার এই প্রথম, কিন্তু সকলের তো খুব ভাল লাগল। সাহেবরা অবশ্যই যেমন আছে, নাল গড়িয়ে গেল, ‘কালো মানুষ!’ ‘তাই তো কি আশ্চর্য’ ইত্যাদি। আগামী শনিবার আর একটি বক্তৃতা ইংরেজীতে, দেশী লোকের জন্য। এখানে একটি বৃহৎ সভা স্থাপন করা গেল—ভবিষ্যতে কতদূর কার্য হয় দেখা যাক। সভার উদ্দেশ্য বিদ্যা ও ধর্ম শিক্ষা দেওয়া।
সোমবার বেরেলি-যাত্রা, তারপর সাহারানপুর, তারপর আম্বালা, সেখান হইতে ক্যাপ্টেন সেভিয়ারের সঙ্গে বোধ হয় মসূরী, আর একটু ঠাণ্ডা পড়লেই দেশে পুনরাগমন ও রাজপুতানায় গমন ইত্যাদি।
তুমি খুব চুটিয়ে কাজ করে যাও, ভয় কি? আমিও ‘ফের লেগে যা’ আরম্ভ করেছি। শরীর তো যাবেই, কুঁড়েমিতে কেন যায়? It is better to wear out than rust out. (মরচে পড়ে পড়ে মরার চেয়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে মরা ভাল)। মরে গেলেও হাড়ে হাড়ে ভেল্কি খেলবে, তার ভাবনা কি? দশ বৎসরের ভেতর ভারতবর্ষটাকে ছেয়ে ফেলতে হবে—‘এর কমে হবেই না।’ তাল ঠুকে লেগে যাও—‘ওয়া গুরুকী ফতে!’ টাকা-ফাকা সব আপনা-আপনি আসবে। মানুষ চাই, টাকা চাই না। মানুষ সব করে, টাকায় কি করতে পারে? মানুষ চাই—যত পাবে ততই ভাল। … এই—তো ঢের টাকা যোগাড় করেছিল, কিন্তু মানুষ নাই—কি কাজ করলে বল? কিমধিকমিতি।