নিশ্চিত শেষ-বিচারদিনে—‘কি পড়িয়াছি’, তাহা জিজ্ঞাসিত হইবে না; ‘কি করিয়াছি’ তাহাই জিজ্ঞাসিত হইবে। কি পটুতাসহকারে বাক্যবিন্যাস করিয়াছি, তাহা জিজ্ঞাসিত হইবে না; ধর্মে কতদূর জীবন কাটাইয়াছি, তাহাই জিজ্ঞাসিত হইবে।
যাঁহাদের সহিত জীবদ্দশায় তুমি উত্তমরূপে পরিচিত ছিলে এবং যাঁহারা আপন আপন ব্যবসায়ে বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিলেন, সেই-সকল পণ্ডিত এবং অধ্যাপকেরা কোথায় বলিতে পার?
অপরে তাঁহাদিগের স্থান অধিকার করিতেছে এবং নিশ্চিত বলিতে পারি, তাহারা তাঁহাদের বিষয় একবার চিন্তাও করে না!
জীবদ্দশায় তাঁহারা সারবান্ বলিয়া বিবেচিত হইতেন, এক্ষণে কেহ তাঁহাদের কথাও কহেন না।
৬। অহো! সাংসারিক গরিমা কি শীঘ্রই চলিয়া যায়! আহা! তাঁহাদের জীবন যদি তাঁহাদের জ্ঞানের সদৃশ হইত, তাহা হইলে বুঝিতাম যে তাঁহাদের পাঠ এবং চিন্তা কার্যের হইয়াছে।
ঈশ্বরের সেবাতে কোন যত্ন না করিয়া বিদ্যামদে এ সংসারে কত লোকই বিনষ্ট হয়!
জগতে তাহারা দীনহীন হইতে চাহে না, তাহারা মহৎ বলিয়া পরিচিত হইতে চায়; সেইজন্যই আপনার কল্পনা-চক্ষে আপনি অতি গর্বিত হয়।
তিনিই বাস্তবিক মহান্, যাঁহার নিঃস্বার্থ সহানুভূতি আছে।
তিনিই বাস্তবিক মহান্, যিনি আপনার চক্ষে আপনি অতি ক্ষুদ্র এবং উচ্চপদলাভ রূপ সম্মানকে অতি তুচ্ছ বোধ করেন।
তিনিই যথার্থ জ্ঞানী, যিনি খ্রীষ্টকে প্রাপ্ত হইবার জন্য সকল পার্থিব পদার্থকে বিষ্ঠার ন্যায় জ্ঞান করেন।
তিনিই যথার্থ পণ্ডিত, যিনি ঈশ্বরের ইচ্ছায় পরিচালিত হন এবং আপনার ইচ্ছাকে পরিত্যাগ করেন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
কার্যে বুদ্ধিমত্তা
১। প্রত্যেক প্রবাদ অথবা মনোবেগজনিত ইচ্ছাকে বিশ্বাস করা আমাদের কখনও উচিত নহে, পরন্তু সতর্কতা এবং ধৈর্যসহকারে উক্ত বিষয়ের ঈশ্বরের সহিত সম্বন্ধ বিচার করিবে।
আহা! আমরা এমনি দুর্বল যে, আমরা প্রায়ই অতি সহজে অপরের সুখ্যাতি অপেক্ষা নিন্দা বিশ্বাস করি এবং রটনা করি। যাঁহারা পবিত্রতায় উন্নত, তাঁহারা সহসা সকল মন্দ প্রবাদে বিশ্বাস স্থাপন করেন না; কারণ তাঁহারা জানেন যে, মনুষ্যের দুর্বলতা মনুষ্যকে অপরের মন্দ রটাইতে এবং মিথ্যা বলিতে অত্যন্ত প্রবণ করে।
২। যিনি কার্যে হঠকারী নহেন এবং সবিশেষ বিপরীত প্রমাণ সত্ত্বে (থাকিলে) আপন মতে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করেন না, যিনি যাহাই শুনেন তাহাই বিশ্বাস করেন না এবং শুনিলেও তাহা তৎক্ষণাৎ রটনা করেন না, তিনি অতি বুদ্ধিমান্।
৩। বুদ্ধিমান্ ও সদ্বিবেচক লোকদিগের নিকট হইতে উপদেশ অন্বেষণ করিবে এবং নিজ বুদ্ধির অনুসরণ না করিয়া তোমা অপেক্ষা যাঁহারা অধিক জানেন, তাঁহাদের দ্বারা উপদিষ্ট হওয়া উত্তম বিবেচনা করিবে।
সাধুজীবন মনুষ্যকে ঈশ্বরের গণনায় বুদ্ধিমান্ করে এবং এই প্রকার ব্যক্তি যথার্থ বহুদর্শন লাভ করে। যিনি আপনাকে আপনি যত অকিঞ্চিৎকর বলিয়া জানেন এবং যিনি যত পরিমাণে ঈশ্বরের ইচ্ছার অধীন, তিনি সর্বদা তত পরিমাণে বুদ্ধিমান্ এবং শান্তিপূর্ণ হইবেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
শাস্ত্রপাঠ
১। সত্যের অনুসন্ধান শাস্ত্রে করিতে হইবে, বাক্চাতুর্যে নহে। যে পরমাত্মার প্রেরণায় বাইবেল লিখিত হইয়াছে, তাহারই সাহায্যে বাইবেল সর্বদা পড়া উচিত।২১
শাস্ত্রপাঠকালে কূটতর্ক পরিত্যাগ করিয়া আমাদের কল্যাণমাত্র অনুসন্ধান করা কর্তব্য।
যে-সকল পুস্তকে পাণ্ডিত্যসহকারে এবং গভীরভাবে প্রস্তাবিত বিষয় লিখিত আছে, তাহা পড়িতে আমাদের যে-প্রকার আগ্রহ, অতি সরলভাবে লিখিত যে-কোন ভক্তির গ্রন্থে সেই প্রকার আগ্রহ থাকা উচিত।
গ্রন্থকারের প্রসিদ্ধি অথবা অপ্রসিদ্ধি যেন তোমার মনকে বিচলিত না করে। কেবল সত্যের প্রতি তোমার ভালবাসা দ্বারা পরিচালিত হইয়া তুমি পাঠ কর।২২
‘কে লিখিয়াছে’ সে তত্ত্ব না লইয়া ‘কি লিখিয়াছে’ তাহাই যত্নপূর্বক বিচার করা উচিত।
২। মানুষ চলিয়া যায়, কিন্তু ঈশ্বরের সত্য চিরকাল থাকে।
নানারূপে ঈশ্বর আমাদিগকে বলিতেছেন, তাঁহার কাছে ব্যক্তিবিশেষের আদর নাই।
অনেক সময় শাস্ত্র পড়িতে পড়িতে যে-সকল কথা আমাদের কেবল দেখিয়া যাওয়া উচিত, সেই-সকল কথার মর্মভেদ ও আলোচনা করিবার জন্য আমরা ব্যগ্র হইয়া পড়ি। এই প্রকারে আমাদের কৌতূহল আমাদের অনেক সময় বাধা দেয়।
যদি উপকার বাঞ্ছা কর, নম্রতা সরলতা ও বিশ্বাসের সহিত পাঠ কর এবং কখনও পণ্ডিত বলিয়া পরিচিত হইবার বাসনা রাখিও না।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
অত্যন্ত আসক্তি
১। যখন কোন মানুষ কোন বস্তুর জন্য অত্যন্ত ব্যগ্র হয়, তখনই তাহার আভ্যন্তরিক শান্তি নষ্ট হয়।২৩
অভিমানী এবং লোভীরা কখনও শান্তি পায় না, কিন্তু অকিঞ্চন এবং বিনীত লোকেরা সদা শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করে। যে মানুষ স্বার্থ সম্বন্ধে এখনও সম্পূর্ণ মৃত হয় নাই, সে শীঘ্রই প্রলোভিত হয় এবং অতি সামান্য ও অকিঞ্চিৎকর বিষয়সকল তাহাকে পরাভূত করে।২৪
যাহার আত্মা দুর্বল ও এখনও কিয়ৎপরিমাণে ইন্দ্রিয়ের বশীভূত এবং যে-সকল পদার্থ কালে উৎপন্ন ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভবের উপর যাহাদের সত্তা বিদ্যমান, সেই-সকল বিষয়ে আসক্তিসম্পন্ন পার্থিব বাসনা হইতে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করা তাহার পক্ষে অত্যন্ত দুরূহ। সেই জন্যই যখন সে অনিত্য পদার্থসকল কোনরূপে পরিত্যাগ করে, তখনও সর্বদা তাহার মন বিমর্ষ থাকে এবং কেহ তাহাকে বাধা দিলে সহজেই ক্রুদ্ধ হয়।