৩। তোমার জ্ঞান এবং ধারণাশক্তি যে পরিমাণে অধিক, তোমার তত কঠিন বিচার হইবে, যদি সমধিক জ্ঞানের ফলস্বরূপ তোমার জীবনও সমধিক পবিত্র না হয়।
অতএব, তোমার দক্ষতা এবং বিদ্যার জন্য বহুপ্রশংসিত হইতে ইচ্ছা করিও না; বরং যে জ্ঞান তোমাকে প্রদত্ত হইয়াছে, তাহাকে ভয়ের কারণ বলিয়া জান।
যদি এ প্রকার চিন্তা আইসে যে, তুমি বহু বিষয় জান এবং বিলক্ষণ বুঝ, স্মরণ রাখিও—যে-সকল বিষয় তুমি জান না, তাহারা সংখ্যায় অনেক অধিক।
জ্ঞানগর্বে স্ফীত হইও না, বরং আপনার অজ্ঞতা স্বীকার কর। তোমা অপেক্ষা কত পণ্ডিত রহিয়াছে, ঈশ্বরাদিষ্ট শাস্ত্রজ্ঞানে তোমা অপেক্ষা কত অভিজ্ঞ লোক রহিয়াছে। ইহা দেখিয়াও কেন তুমি অপরের পূর্বদান অধিকার করিতে চাও?
যদি নিজ কল্যাণপ্রদ কোন বিষয় জানিতে এবং শিখিতে চাও, জগতের নিকট অপরিচিত এবং অকিঞ্চিৎকর থাকিতে ভালবাস।
৪। আপনাকে আপনি যথার্থরূপে জানা অর্থাৎ আপনাকে অতি হীন মনে করা সর্বাপেক্ষা মূল্যবান এবং উৎকৃষ্ট শিক্ষা। আপনাকে নীচ মনে করা এবং অপরকে সর্বদা শ্রেষ্ঠ মনে করা এবং তাহার মঙ্গল কামনা করাই শ্রেষ্ঠ জ্ঞান ও সম্পূর্ণতার চিহ্ন।
যদি দেখ, কেহ প্রকাশ্যরূপে পাপ করিতেছে অথবা কেহ কোন অপরাধ করিতেছে, তথাপি আপনাকে উৎকৃষ্ট বলিয়া জানিও না।
আমাদের সকলেরই পতন হইতে পারে; তথাপি তোমার দৃঢ় ধারণা থাকা উচিত যে, তোমা অপেক্ষা অধিক দুর্বল কেহই নাই।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
সত্যের শিক্ষা
১। সুখী সেই মনুষ্য, সাঙ্কেতিক চিহ্ন এবং নশ্বর শব্দ পরিত্যাগ করিয়া সত্য স্বয়ং ও স্ব-স্বরূপে যাহাকে শিক্ষা দেয়।
আমাদিগের মত এবং ইন্দ্রিয়সকল প্রায়শ আমাদিগকে প্রতারিত করে; কারণ বস্তুর প্রকৃত তত্ত্বে আমাদের দৃষ্টির গতি অতি অল্প।
গুপ্ত এবং গূঢ় বিষয়সকল ক্রমাগত অনুসন্ধান করিয়া লাভ কি? তাহা না জানার জন্য শেষ বিচারদিনে১৯ আমরা নিন্দিত হইব না।
উপকারক ও আবশ্যক বস্তু পরিত্যাগ করিয়া স্ব-ইচ্ছায় যাহা কেবল কৌতূহল উদ্দীপিত করে এবং অপকারক—এ প্রকার বিষয়ের অনুসন্ধান করা অতি নির্বোধের কার্য; চক্ষু থাকিতেও আমরা দেখিতেছি না!
২। ন্যায়শাস্ত্রীয় পদার্থ-বিচারে আমরা কেন ব্যাপৃত থাকি? তিনিই বহু সন্দেহপূর্ণ তর্ক হইতে মুক্ত হয়েন, সনাতন বাণী২০যাঁহাকে উপদেশ করেন।
সেই অদ্বিতীয় বাণী হইতে সকল পদার্থ বিনিঃসৃত হইয়াছে, সকল পদার্থ তাঁহাকেই নির্দেশ করিতেছে; তিনিই আদি, তিনিই আমাদিগকে উপদেশ করেন।
তাঁহাকে ছাড়িয়া কেহ কিছু বুঝিতে পারে না অথবা কোন বিষয়ে যথার্থ বিচার করিতে পারে না।
তিনিই অচলভাবে প্রতিষ্ঠিত—তিনিই ঈশ্বরে সংস্থিত, যাঁহার উদ্দেশ্য একটি মাত্র, যিনি সকল পদার্থ এক অদ্বিতীয় কারণে নির্দেশ করেন এবং যিনি এক জ্যোতিতে সমস্ত পদার্থ দর্শন করেন।
হে ঈশ্বর, হে সত্য, অনন্ত প্রেমে আমাকে তোমার সহিত একীভূত করিয়া লও।
বহু বিষয় পাঠ এবং শ্রবণ করিয়া আমি অতি ক্লান্ত হইয়া পড়ি; আমার সকল অভাব, সকল বাসনা তোমাতেই নিহিত।
আচার্যসকল নির্বাক্ হউক, জগৎ তোমার সমক্ষে স্তব্ধ হউক; প্রভো, কেবল তুমি [আমার সহিত কথা] বল।
৩। মানুষের মন যতই সংযত অন্তঃপ্রদেশ হইতে সরল হয়, ততই সে গভীর বিষয়সকলে অতি সহজে প্রবেশ করিতে পারে; কারণ তাহার মন আলোক পায়।
যে ব্যক্তি ঈশ্বরের মাহাত্ম্য-প্রকাশের জন্য সকল কার্য করে, আপনার সম্বন্ধে কার্যহীন থাকে এবং সকল প্রকার স্বার্থশূন্য হয়, সেই প্রকার পবিত্র, সরল ও অটল ব্যক্তি বহু কার্য করিতে হইলেও আকুল হইয়া পড়ে না। হৃদয়ের অনুন্মূলিত আসক্তি অপেক্ষা কোন্ পদার্থ তোমায় অধিকতর বিরক্ত করে বা বাধা দেয়?
ঈশ্বরানুরাগী সাধু ব্যক্তি অগ্রে আপনার মনে যে-সকল বাহিরের কর্তব্য করিতে হইবে, তাহা নির্দিষ্ট করিয়া লন; সেই-সকল কার্য করিতে তিনি কখনও বিকৃত আসক্তি-জনিত ইচ্ছা দ্বারা পরিচালিত হন না; পরন্তু সম্যক বিচার দ্বারা আপনার কার্যসকলকে নিয়মিত করেন।
আত্মজয়ের জন্য যিনি চেষ্টা করিতেছেন, তদপেক্ষা কঠিনতর সংগ্রাম কে করে?
আপনাকে আপনি জয় করা, দিন দিন আপনার উপর আধিপত্য বিস্তার করা এবং ধর্মে বর্ধিত হওয়া—ইহাই আমাদিগের একমাত্র কর্তব্য।
৪। এ জগতে সকল পূর্ণতার মধ্যেই অপূর্ণতা আছে এবং আমাদিগের কোন তত্ত্বানুসন্ধানই একেবারে সন্দেহরহিত হয় না।
গভীর বৈজ্ঞানিক তত্ত্বানুসন্ধান অপেক্ষা আপনাকে অকিঞ্চিৎকর বলিয়া জ্ঞান করা ঈশ্বরপ্রাপ্তির নিশ্চিত পথ।
কিন্তু বিদ্যা গুণমাত্র বলিয়া অথবা কোন বিষয়ের জ্ঞানদায়ক বলিয়া বিবেচিত হইলে নিন্দিত নহে; কারণ উহা কল্যাণপ্রদ ও ঈশ্বরাদিষ্ট।
কিন্তু ইহাই বলা হইতেছে যে, সদ্বুদ্ধি এবং সাধুজীবন বিদ্যা অপেক্ষা প্রার্থনীয়।
অনেকেই সাধু হওয়া অপেক্ষা বিদ্বান হইতে অধিক যত্ন করে; তাহার ফল এই হয় যে, অনেক সময় তাহারা কুপথে বিচরণ করে এবং তাহাদের পরিশ্রম অত্যল্প ফল উৎপাদন করে অথবা নিষ্ফল হয়।
৫। অহো! সন্দেহ উত্থাপিত করিতে মানুষ যে প্রকার যত্নশীল, পাপ উন্মূলিত করিতে ও পুণ্য রোপণ করিতে যদি সেই প্রকার হইত, তাহা হইলে পৃথিবীতে এবম্প্রকার অমঙ্গল ও পাপকার্যের বিবরণ [আলোচনা] থাকিত না এবং ধার্মিকদিগের [ধর্মসংস্থাগুলির] মধ্যে এতাদৃশী উচ্ছৃঙ্খলতা থাকিত না।