জীবনটা ক্ষণস্থায়ী স্বপ্নমাত্র, যৌবন ও সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়; দিবারাত্র বল, ‘তুমি আমার পিতা, মাতা, স্বামী, দয়িত, প্রভু, ঈশ্বর—আমি তোমা ছাড়া আর কিছু চাই না, আর কিছুই চাই না, আর কিছুই না। তুমি আমাতে, আমি তোমাতে—আমি তুমি, তুমি আমি।’ ধন চলে যায়, সৌন্দর্য বিলীন হয়ে যায়, জীবন দ্রুতগতিতে চলে যায়, শক্তি লোপ পেয়ে যায়, কিন্তু প্রভু চিরদিনই থাকেন—প্রেম চিরদিনই থাকে। যদি এই দেহযন্ত্রটাকে ঠিক রাখতে পারায় কিছু গৌরব থাকে, তবে দেহের অসুখের সঙ্গে সঙ্গে আত্মাতে অসুখের ভাব আসতে না দেওয়া আরও গৌরবের কথা। জড়ের সঙ্গে কোন সম্পর্ক না রাখাই—তুমি যে জড় নও তার একমাত্র প্রমাণ।
ঈশ্বরে লেগে থাকো—দেহে বা অন্য কোথাও কি হচ্ছে, কে গ্রাহ্য করে? যখন নানা বিপদ দুঃখ এসে বিভীষিকা দেখাতে থাকে, তখন বল, ‘হে আমার ভগবান্, হে আমার প্রিয়’; যখন মৃত্যুর ভীষণ যাতনা হতে থাকে, তখনও বল, ‘হে আমার ভগবান্, হে আমার প্রিয়’; জগতে যত রকম দুঃখ বিপদ আসতে পারে তা এলেও বল, ‘হে ভগবান্, হে আমার প্রিয়, তুমি এইখানেই রয়েছ, তোমাকে আমি দেখছি, তুমি আমার সঙ্গে রয়েছ, তোমাকে আমি অনুভব করছি। আমি তোমার, আমায় টেনে নাও, প্রভু; আমি এই জগতের নই, আমি তোমার—তুমি আমায় ত্যাগ কর না।’ হীরার খনি ছেড়ে কাঁচখণ্ডের অন্বেষণে যেও না। এই জীবনটা একটা মস্ত সুযোগ—তোমরা কি এই সুযোগ অবহেলা করে সংসারের সুখ খুঁজতে যাবে? তিনি সকল আনন্দের প্রস্রবণ—সেই পরম বস্তুর অনুসন্ধান কর, সেই পরম বস্তুই তোমাদের জীবনের লক্ষ্য হোক, তা হলে নিশ্চয়ই সেই পরম বস্তু লাভ করবে। সর্বদা আমার আশীর্বাদ জানবে।
বিবেকানন্দ
১০৮*
[হেল ভগিনীগণকে লিখিত]
গ্রীনএকার
১১ অগষ্ট, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনীগণ,
এ যাবৎ গ্রীনএকারেই আছি। জায়গাটি বেশ লাগল। সকলেই খুব সহৃদয়। কেনিলওয়ার্থের মিসেস প্র্যাট-নাম্নী চিকাগোবাসিনী মহিলা আমার প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট হয়ে পাঁচশত ডলার দিতে চান। আমি প্রত্যাখ্যান করেছি। আমায় কিন্তু কথা দিতে হয়েছে যে, অর্থের প্রয়োজন হলেই তাঁকে জানাব। আশা করি, ভগবান্ আমাকে সেরূপ অবস্থায় ফেলবেন না। একমাত্র তাঁর সহায়তাই আমার পক্ষে পর্যাপ্ত। মায়ের বা তোমাদের কোন পত্র আমি পাইনি; কলিকাতা থেকে ফনোগ্রাফটির পৌঁছানো সংবাদও আসেনি।
আমার চিঠিতে যদি পীড়াদায়ক কোন কিছু থাকে, আশা করি তোমরা বুঝতে পারবে যে, সেটা স্নেহের ভাব থেকেই লেখা হয়েছিল। তোমাদের দয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা-প্রকাশ অনাবশ্যক। ভগবান্ তোমাদিগকে সুখী করুন। তাঁহার অশেষ আশীর্বাদ তোমাদের ও তোমাদের প্রিয়জনের উপর বর্ষিত হোক। তোমাদের পরিবারবর্গের নিকট আমি চিরঋণী। তোমরা তো তা জানই এবং অনুভব কর। আমি কথায় তা প্রকাশ করতে অক্ষম। রবিবার বক্তৃতা দিতে যাচ্ছি প্লিমাথে কর্ণেল হিগিনসনের ‘Sympathy of Religions’-এর অধিবেশনে। কোরা স্টকহ্যাম্ গাছতলায় আমাদের দলের ছবি তুলেছিলেন, তারই একটি এই সঙ্গে পাঠাচ্ছি। এটা কিন্তু কাঁচা প্রতিলিপিমাত্র, আলোতে অস্পষ্ট হয়ে যাবে। এর চেয়ে ভাল এখন কিছু পাচ্ছি না। অনুগ্রহ করে মিস হাউকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও প্রীতি জানিও। আমার প্রতি তাঁর অশেষ দয়া। বর্তমানে আমার কোন কিছুর প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন হলে সানন্দে জানাব। মনে করছি, মাত্র দু-দিনের জন্য একবার প্লিমাথ থেকে ফিশকিলে যাব। সেখান থেকে তোমাদের আবার পত্র দেব। আশা করি—আশা করি কেন, জানিই তোমরা সুখে আছ, কারণ পবিত্র সজ্জন কখনও অসুখী হয় না। অল্প যে কয় সপ্তাহ এখানে থাকব, আশা করি আনন্দেই কাটবে। আগামী শরৎকালে নিউ ইয়র্কে থাকব। নিউ ইয়র্ক চমৎকার জায়গা। সেখানকার লোকের যে অধ্যবসায়, অন্যান্য নগরবাসিগণের মধ্যে তা দেখা যায় না। মিসেস পটার পামারের এক চিঠি পেয়েছি; অগষ্ট মাসে তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্য লিখেছেন। মহিলাটি বেশ সহৃদয়, উদার ইত্যাদি। অধিক আর কি? ‘নৈতিক অনুশীলন সমিতি’র (Ethical Culture Society) সভাপতি নিউ ইয়র্কনিবাসী আমার বন্ধু ডাক্তার জেন্স্ এখানে রয়েছেন। তিনি বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করেছেন। আমি তাঁর বক্তৃতা শুনতে অবশ্য যাব। তাঁর সঙ্গে আমার মতের খুবই ঐক্য আছে। তোমরা চিরসুখী হও।
তোমাদের চিরশুভার্থী ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
১০৯*
[মিস ইসাবেল ম্যাক্কিণ্ডলিকে লিখিত]
এনিস্কোয়াম্
২০ অগষ্ট, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনী,
তোমার অত্যন্ত সহৃদয় লিপিখানি এনিস্কোয়ামে আমার কাছে যথাসময়ে এসে পৌঁছেছে। আমি পুনরায় ব্যাগলিদের সঙ্গে আছি। তাঁরা যথারীতি সহৃদয়। অধ্যাপক রাইট এখানে ছিলেন না। তবে গত পরশু তিনি এসেছেন এবং একসঙ্গে আমাদের খুব ভাল কাটছে। এভানস্টনের মিঃ ব্রাডলি, যাঁর সঙ্গে তোমার এভানস্টনে সাক্ষাৎ হয়েছিল, এখানে ছিলেন। কয়েকদিন বেশ নৌকাভ্রমণ করা গেছে এবং একদিন সন্ধ্যায় নৌকা উল্টিয়ে কাপড় জামা ও সবকিছু ভিজে একশেষ।
গ্রীনএকারে আমার চমৎকার কেটেছে। তাঁরা সকলেই নিষ্ঠাপরায়ণ ও সহৃদয়। ফ্যানি হার্টলি (Fanny Hartley) ও মিসেস মিল্স্ (Mrs. Mills) মনে হয় এতদিনে বাড়ী ফিরে গিয়েছেন।
ভাবছি এখান থেকে নিউ ইয়র্ক ফিরে যাব, অথবা বষ্টনে মিসেস ওলি বুলের কাছেও যেতে পারি। সম্ভবতঃ তুমি এ দেশের বিখ্যাত বেহালা-বাদক মিঃ ওলি বুলের কথা শুনেছ। ইনি তাঁর বিধবা পত্নী। মহিলাটি খুবই ধর্মশীলা। তিনি কেম্ব্রিজে বাস করেন এবং ভারত থেকে আনা কারুকার্যময় কাঠ দিয়ে তৈরী একখানা সুন্দর বৈঠকখানা তাঁর আছে। তিনি চান আমি যে-কোন সময়ে তাঁর কাছে যাই এবং তাঁর বৈঠকখানাটি বক্তৃতার জন্য ব্যবহার করি। বষ্টন অবশ্য সব-কিছুর জন্যই একটি বৃহৎ ক্ষেত্র, কিন্তু বষ্টনের লোকেরা কোনকিছু যেমন তৎপরতার সঙ্গে গ্রহণ করে, আবার তেমনি তৎপরতার সঙ্গে ত্যাগ করে। অন্য দিকে নিউ ইয়র্কবাসীরা একটু ঢিলে হলেও যখন তারা কোন জিনিষ ধরে, তখন খুব শক্ত করেই ধরে।