এ স্থানটি সুন্দর ও মনোরম—এখানে স্নান করার ভারি সুবিধা। কোরা স্টকহ্যাম আমার জন্য একটি স্নানের পোষাক করে দিয়েছেন—আমিও ঠিক হাঁসের মত জলে নেমে স্নান করে মজা করছি—এমন কি জল-কাদায় যারা বাস করে (যেমন হাঁস-ব্যাঙ) তাদের পক্ষেও বেশ উপভোগ্য।
আর বেশী কিছু লেখবার পাচ্ছি না—আমি এখন এত ব্যস্ত যে, মাদার চার্চকে পৃথক্ভাবে লেখবার আমার সময় নেই। মিস হাউ-কে আমার শ্রদ্ধা ও প্রীতি জানাবে।
বষ্টনের মিঃ উড্ এখানে রয়েছেন—তিনি তোমাদের সম্প্রদায়ের একজন প্রধান পাণ্ডা। তবে ‘হোয়ার্লপুল’ মহোদয়ার৬০ সম্প্রদায়ভুক্ত হতে তাঁর বিশেষ আপত্তি—সেই জন্য তিনি দার্শনিক-রাসায়নিক-ভৌতিক-আধ্যাত্মিক আরও কত কি বিশেষণ দিয়ে নিজেকে একজন মনঃশক্তি-প্রভাবে আরোগ্যকারী বলে পরিচিত করতে চান। কাল এখানে একটা ভয়ানক ঝড় উঠেছিল—তাতে তাঁবুগুলোর উত্তমমধ্যম ‘চিকিৎসা’ হয়ে গেছে। যে বড় তাঁবুর নীচে তাঁদের এইসব বক্তৃতা চলছিল, ঐ ‘চিকিৎসার’ চোটে সেটির এত আধ্যাত্মিকতা বেড়ে উঠেছিল যে, সেটি মর্ত্যলোকের দৃষ্টি হতে সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হয়েছে, আর প্রায় দুশ’ চেয়ার আধ্যাত্মিক ভাবে গদ্গদ হয়ে জমির চারিদিকে নৃত্য আরম্ভ করেছিল। মিল্স্ কোম্পানীর মিসেস ফিগ্স্ প্রত্যহ প্রাতে একটা করে ক্লাস করে থাকেন আর মিসেস মিল্স্ ব্যস্তসমস্ত হয়ে সমস্ত জায়গাটায় যেন লাফিয়ে বেড়াচ্ছেন—ওরা সকলেই খুব আনন্দে মেতে আছে। আমি বিশেষতঃ কোরাকে দেখে ভারী খুশী হয়েছি, গত শীত-ঋতুতে ওরা বিশেষ কষ্ট পেয়েছে—একটু আনন্দ করলে ওর পক্ষে ভালই হবে।
তাঁবুতে ওরা যে রকম স্বাধীনভাবে রয়েছে, শুনলে তোমরা বিস্মিত হবে। তবে এরা সকলেই বড় ভাল ও শুদ্ধাত্মা, একটু খেয়ালী—এই যা।
আমি এখানে আগামী শনিবার পর্যন্ত আছি—সুতরাং তোমরা যদি পত্র পাওয়া মাত্র জবাব দাও, তবে এখান থেকে চলে যাবার পূর্বেই পেতে পারি। এখানে একটি যুবক রোজ গান করে—সে পেশাদার; তার ভাবী পত্নী ও বোনের সঙ্গে এখানে আছে; ভাবী পত্নীটি বেশ গাইতে পারে, পরমা সুন্দরী। এই সেদিন রাত্রিতে ছাউনির সকলে একটা পাইন গাছের তলায় শুতে গিয়েছিল—আমি রোজ প্রাতে ঐ গাছতলাটায় হিন্দু ধরনে বসে এদের উপদেশ দিয়ে থাকি। অবশ্য আমিও তাদের সঙ্গে গেছলাম—তারকাখচিত আকাশের নীচে জননী ধরিত্রীর কোলে শুয়ে রাতটা বড় আনন্দেই কেটেছিল—আমি তো এই আনন্দের সবটুকু উপভোগ করেছি।
এক বৎসর হাড়ভাঙা খাটুনির পর এই রাত্রিটা যে কি আনন্দে কেটেছিল—মাটিতে শোওয়া, বনে গাছতলায় বসে ধ্যান—তা তোমাদের কি বলব! সরাইয়ে যারা রয়েছে তারা অল্পবিস্তর অবস্থাপন্ন, আর তাঁবুর লোকেরা সুস্থ সবল শুদ্ধ অকপট নরনারী। আমি তাদের সকলকে ‘শিবোঽহং’ করতে শেখাই, আর তারা তাই আবৃত্তি করতে থাকে—সকলেই কি সরল ও শুদ্ধ এবং অসীম সাহসী! সুতরাং এদের শিক্ষা দিয়ে আমিও পরম আনন্দ ও গৌরব বোধ করছি। ভগবানকে ধন্যবাদ যে তিনি আমাকে নিঃস্ব করেছেন; ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, তিনি এই তাঁবুবাসীদের দরিদ্র করেছেন। শৌখীন বাবুরা ও শৌখীন মেয়েরা রয়েছেন হোটেলে; কিন্তু তাঁবুবাসীদের স্নায়ুগুলি যেন লোহা দিয়ে বাঁধানো, মন তিন-পুরু ইস্পাতে তৈরী আর আত্মা অগ্নিময়। কাল যখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল আর ঝড়ে সব উল্টে পাল্টে ফেলছিল, তখন এই নির্ভীক বীরহৃদয় ব্যক্তিগণ আত্মার অনন্ত মহিমায় বিশ্বাস দৃঢ় রেখে ঝড়ে যাতে উড়িয়ে না নিয়ে যায়, সেজন্য তাদের তাঁবুর দড়ি ধরে কেমন ঝুলছিল, তা দেখলে তোমাদের হৃদয় প্রশস্ত ও উন্নত হত। আমি এদের জুড়ি দেখতে ৫০ ক্রোশ যেতে প্রস্তুত আছি। প্রভু তাদের আশীর্বাদ করুন। আশা করি, তোমরা তোমাদের সুন্দর পল্লীনিবাসে বেশ আনন্দে আছ। আমার জন্য এক মুহূর্তও ভেব না—আমাকে তিনি দেখবেনই দেখবেন, আর যদি না দেখেন নিশ্চিত জানব, আমার যাবার সময় হয়েছে—আমি আনন্দে চলে যাব।
‘হে মাধব, অনেকে তোমায় অনেক জিনিষ দেয়—আমি গরীব—আমার আর কিছু নেই, কেবল এই শরীর মন ও আত্মা আছে—এইগুলি সব তোমার পাদপদ্মে সমর্পণ করলাম—হে জগদ্ব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর, দয়া করে এইগুলি গ্রহণ করতেই হবে—নিতে অস্বীকার করলে চলবে না।’ আমি তাই আমার সর্বস্ব চিরকালের জন্য দিয়েছি। একটা কথা—এরা কতকটা শুষ্ক ধরনের লোক, আর সমগ্র জগতে খুব কম লোকই আছে, যারা শুষ্ক নয়। তারা ‘মাধব’ অর্থাৎ ভগবান্ যে রসস্বরূপ, তা একেবারে বোঝে না। তারা হয় জ্ঞানচচ্চড়ি অথবা ঝাড়ফুঁক করে রোগ আরাম করা, টেবিলে ভূত নাবানো, ডাইনী-বিদ্যা ইত্যাদির পিছনে ছোটে। এ দেশে যত প্রেম, স্বাধীনতা, তেজের কথা শোনা যায়, আর কোথাও তত শুনিনি, কিন্তু এখানকার লোকে এগুলি যত কম বোঝে, তত আর কোথাও নয়। এখানে ঈশ্বরের ধারণা—হয় ‘সভয়ং বজ্রমুদ্যতং’ অথবা রোগ-আরামকারী শক্তিবিশেষ অথবা কোন প্রকার স্পন্দন, ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রভু এদের মঙ্গল করুন। এরা আবার দিনরাত তোতা পাখীর মত ‘প্রেম প্রেম প্রেম’ করে চেঁচাচ্ছে!
এবার তোমাদের সৎ কল্পনা এবং শুভ চিন্তার সামগ্রী খানিকটা দিচ্ছি। তোমরা সুশীলা ও উন্নতহৃদয়া। এদের মত চৈতন্যকে জড়ের ভূমিতে টেনে না এনে—জড়কে চৈতন্যে পরিণত কর, অন্ততঃ প্রত্যহ একবার করে সেই চৈতন্যরাজ্যের—সেই অনন্ত সৌন্দর্য, শান্তি ও পবিত্রতার রাজ্যের একটু আভাস পাবার এবং দিনরাত সেই ভাবভূমিতে বাস করবার চেষ্টা কর। অস্বাভাবিক অলৌকিক কিছু কখনও খুঁজো না, ওগুলি পায়ের আঙুল দিয়েও যেন স্পর্শ কর না। তোমাদের আত্মা দিবারাত্র অবিচ্ছিন্ন তৈলধারার ন্যায় তোমাদের হৃদয়সিংহাসনবাসী সেই প্রিয়তমের পাদপদ্মে গিয়ে সংলগ্ন হতে থাকুক, বাকী যা কিছু অর্থাৎ দেহ প্রভৃতি—তাদের যা হবার হোক গে।