… সমস্ত প্রাণীর পক্ষে যা রাত্রি, সংযমী তাতে জাগ্রত থাকেন; আর প্রাণিগণ যাতে জাগ্রত থাকে, আত্মজ্ঞানী মুনির পক্ষে তা রাত্রিস্বরূপ।
এই জগতের ধূলি পর্যন্ত যেন তোমাদের স্পর্শ করতে না পারে; কারণ, কবিরা বলে থাকেন, জগৎটা হচ্ছে একটা পুষ্পাচ্ছাদিত শব মাত্র। তাকে স্পর্শ কর না। তোমরা হোমা পাখীর বাচ্চা—এই মলিনতার পঙ্কিল পল্বলস্বরূপ জগৎ স্পর্শ করবার পূর্বেই তোমরা আকাশের দিকে আবার উড়ে যাও।
‘যে আছ চেতন ঘুমায়ো না আর!’
‘জগতের লোকের ভালবাসার অনেক বস্তু আছে—তারা সেগুলি ভালবাসুক; আমাদের প্রেমাস্পদ একজন মাত্র—সেই প্রভু। জগতের লোক যাই বলুক না, আমরা সে সব গ্রাহ্যের মধ্যেই আনি না। তবে যখন তারা আমাদের প্রেমাস্পদের ছবি আঁকতে যায় ও তাঁকে নানারূপ কিম্ভূতকিমাকার বিশেষণে বিশেষিত করে, তখনই আমাদের ভয় হয়। তাদের যা খুশী তাই করুক, আমাদের নিকট তিনি কেবল প্রেমাস্পদ মাত্র—তিনি আমার প্রিয়তম—প্রিয়তম—প্রিয়তম, আর কিছুই নন।’
‘তাঁর কত শক্তি, কত গুণ আছে—এমন কি আমাদের কল্যাণ করবারও কত শক্তি আছে, তাই বা কে জানতে চায়? আমরা চিরদিনের জন্য বলে রাখছি আমরা কিছু পাবার জন্য ভালবাসি না। আমরা প্রেমের দোকানদার নই, আমরা কিছু প্রতিদান চাই না, আমরা কেবল দিতে চাই।’
‘হে দার্শনিক! তুমি আমায় তাঁর স্বরূপের কথা বলতে আসছ, তাঁর ঐশ্বর্যের কথা—তাঁর গুণের কথা বলতে আসছ? মূর্খ, তুমি জান না, তাঁর অধরের একটি মাত্র চুম্বনের জন্য আমাদের প্রাণ বের হবার উপক্রম হচ্ছে। তোমার ও-সব বাজে জিনিষ পুঁটলি বেঁধে তোমার বাড়ী নিয়ে যাও—আমাকে আমার প্রিয়তমের একটি চুম্বন পাঠিয়ে দাও—পার কি?’
‘মূর্খ, তুমি কার সামনে নতজানু হয়ে ভয়ে প্রার্থনা করছ? আমি আমার গলার হার নিয়ে বকলসের মত তাঁর গলায় পরিয়ে দিয়ে তাতে একগাছি সুতো বেঁধে তাঁকে আমার সঙ্গে সঙ্গে টেনে নিয়ে যাচ্ছি—ভয়, পাছে এক মুহূর্তের জন্য তিনি আমার নিকট থেকে পালিয়ে যান। ঐ হার—প্রেমের হার, ঐ সূত্র—প্রেমের জমাটবাঁধা ভাবের সূত্র। মূর্খ, তুমি তো সূক্ষ্ম তত্ত্ব বোঝ না যে, যিনি অসীম অনন্তস্বরূপ, তিনি প্রেমের বাঁধনে পড়ে আমার মুঠোর মধ্যে ধরা পড়েছেন। তুমি কি জান না যে, সেই জগন্নাথ প্রেমের ডোরে বাঁধা পড়েন—তুমি কি জান না যে, যিনি এত বড় জগৎটাকে চালাচ্ছেন, তিনি বৃন্দাবনের গোপীদের নূপুর-ধ্বনির তালে তালে নাচতেন?’
এই যে পাগলের মত যা-তা লিখলাম, তার জন্য আমায় ক্ষমা করবে। অব্যক্তকে ব্যক্ত করবার ব্যর্থপ্রয়াসরূপ আমার এই ধৃষ্টতা মার্জনা করবে—এ কেবল প্রাণে প্রাণে অনুভব করবার জিনিষ। সদা আমার আশীর্বাদ জানবে।
তোমাদের ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
১১. পত্রাবলী ১০১-১১০
১০১*
[জনৈক মান্দ্রাজী শিষ্যকে লিখিত]
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
২৮ জুন, ১৮৯৪
প্রিয়—,
সেদিন মহীশূর থেকে জি. জি—র এক পত্র পেলাম। দুঃখের বিষয় জি. জি আমাকে সর্বজ্ঞ মনে করে; তা না হলে সে চিঠির মাথায় তার অদ্ভুত কানাড়া ঠিকানাটা আর একটু পরিষ্কার করে লিখত। তারপর—চিকাগো ছাড়া অন্য কোন জায়গায় আমাকে চিঠি পাঠানো বড্ড ভুল। অবশ্য গোড়ায় আমারই ভুল হয়েছিল—আমারই ভাবা উচিত ছিল, আমার বন্ধুদের সূক্ষ্ম বুদ্ধির কথা—তাঁরা তো আমার চিঠির মাথায় একটা ঠিকানা দেখলেই যেখানে খুশী আমার নামে চিঠি পাঠাচ্ছেন। আমাদের মান্দ্রাজ-বৃহস্পতিদের বল, তারা তো বেশ ভাল করেই জানত যে, তাদের চিঠি পৌঁছবার পূর্বেই হয়তো আমি সেখান থেকে এক হাজার মাইল দূরে চলে গেছি, কারণ আমি ক্রমাগত ঘুরে বেড়াচ্ছি। চিকাগোয় আমার একজন বন্ধু আছেন, তাঁর বাড়ী হচ্ছে আমার প্রধান আড্ডা। এখানে আমার কাজের প্রসারের আশা প্রায় শূন্য বললেই হয়। কারণ—যদিও প্রসারের খুব সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু নিম্নোক্ত কারণে সে আশা একেবারে নির্মূল হয়েছেঃ
ভারতের খবর আমি যা কিছু পাচ্ছি, তা মান্দ্রাজের চিঠি থেকে। তোমাদের পত্রে ক্রমাগত শুনছি, ভারতে আমাকে সকলে খুব সুখ্যাতি করছে, কিন্তু সে তো—তুমি জেনেছ আর আমি জানছি, কারণ আলাসিঙ্গার প্রেরিত একটা তিন বর্গ-ইঞ্চি কাগজের টুকরো ছাড়া আমি একখানা ভারতীয় খবরের কাগজে আমার সম্বন্ধে কিছু বেরিয়েছে, তা দেখিনি। অন্যদিকে ভারতের খ্রীষ্টানরা যা কিছু বলছে, মিশনরীরা তা খুব সযত্নে সংগ্রহ করে নিয়মিতভাবে প্রকাশ করছে এবং বাড়ী বাড়ী গিয়ে আমার বন্ধুরা যাতে আমায় ত্যাগ করেন, তার চেষ্টা করছে। তাদের উদ্দেশ্য খুব ভালরকমেই সিদ্ধ হয়েছে, যেহেতু ভারত থেকে কেউ একটা কথাও আমার জন্য বলছে না। ভারতের হিন্দু পত্রিকাগুলো আমাকে আকাশে তুলে দিয়ে প্রশংসা করতে পারে, কিন্তু তার একটা কথাও আমেরিকায় পৌঁছয়নি। তার জন্য এদেশের অনেকে মনে করছে, আমি একটা জুয়াচোর। একে তো মিশনরীরা আমার পিছু লেগেছে, তার উপর এখানকার হিন্দুরা হিংসা করে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে; এক্ষেত্রে আমার একটা কথাও জবাব দেবার নেই। এখন মনে হচ্ছে, কেবল মান্দ্রাজের কতকগুলি ছোকরার পীড়াপীড়ির জন্য ধর্মমহাসভায় যাওয়া আমার আহাম্মকি হয়েছিল, কারণ তারা তো ছোকরা বৈ আর কিছুই নয়। অবশ্য আমি অনন্ত কালের জন্য তাদের কাছে কৃতজ্ঞ, কিন্তু তারা তো গুটিকতক উৎসাহী যুবক ছাড়া আর কিছু নয়—কাজের ক্ষমতা তাদের যে একদম নেই। আমি কোন নিদর্শনপত্র নিয়ে আসিনি, আর যখন কারও অর্থসাহায্যের আবশ্যক হয়, তার নিদর্শনপত্র থাকা দরকার, তা না হলে মিশনরী ও ব্রাহ্মসমাজের বিরুদ্ধাচরণের সামনে—আমি যে জুয়াচোর নই, তা কি করে প্রমাণ করব? মনে করেছিলাম, গোটাকতক বাক্য ব্যয় করা ভারতের পক্ষে বিশেষ কঠিন কাজ হবে না। মনে করেছিলাম, মান্দ্রাজে ও কলিকাতায় কয়েকজন ভদ্রলোক জড়ো করে এক-একটা সভা করে আমাকে এবং আমেরিকাবাসিগণকে আমার প্রতি সহৃদয় ব্যবহার করবার জন্য ধন্যবাদ সহ প্রস্তাব পাস করিয়ে, সেই প্রস্তাবটা দস্তুরমত নিয়মানুযায়ী অর্থাৎ সেই সভার সেক্রেটারীকে দিয়ে, আমেরিকায় ডাঃ ব্যারোজের কাছে পাঠিয়ে তাঁকে তথাকার বিভিন্ন কাগজে ছাপাতে অনুরোধ করা। ঐরূপ বষ্টন, নিউ ইয়র্ক ও চিকাগোর বিভিন্ন কাগজে পাঠানো বিশেষ কঠিন কাজ হবে না। এখন দেখছি, ভারতের পক্ষে এই কাজটা বড়ই গুরুতর ও কঠিন, এক বছরের ভেতর ভারত থেকে কেউ আমার জন্য একটা টুঁ শব্দ পর্যন্ত করলে না, আর এখানে সকলেই আমার বিপক্ষে। তোমরা নিজেদের ঘরে বসে আমার সম্বন্ধে যা খুশী বল না কেন, এখানে তার কে কি জানে? দু-মাসেরও উপর হল আলাসিঙ্গাকে আমি এ বিষয়ে লিখেছিলাম, কিন্তু সে আমার পত্রের জবাব পর্যন্ত দিলে না। আমার আশঙ্কা হয়, তার উৎসাহ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। সুতরাং তোমায় বলছি, আগে এ বিষয়টি বিবেচনা করে দেখ, তারপর মান্দ্রাজীদের এই চিঠি দেখিও। এদিকে আমার গুরুভাইরা ছেলেমানুষের মত কেশব সেন সম্বন্ধে অনেক বাজে কথা বলছে, আর মান্দ্রাজীরা থিওসফিষ্টদের সম্বন্ধে আমি চিঠিতে যা কিছু লিখছি, তাই তাদের বলছে—এতে শুধু শত্রুর সৃষ্টি করা হচ্ছে। হায়! যদি ভারতে একটা মাথাওয়ালা কাজের লোক আমার সহায়তা করবার জন্য পেতাম! কিন্তু তাঁর ইচ্ছাই পূর্ণ হবে, আমি এদেশে জুয়াচোর বলে গণ্য হলাম। আমারই আহাম্মকি হয়েছিল, কোন নিদর্শনপত্র না নিয়ে ধর্মমহাসভায় যাওয়া—আশা করেছিলাম, অনেক জুটে যাবে। এখন দেখছি, আমাকে একলা ধীরে ধীরে কাজ করতে হবে। মোটের ওপর, আমেরিকানরা হিন্দুদের চেয়ে লাখোগুণ ভাল, আর আমি অকৃতজ্ঞ ও হৃদয়হীনদের দেশ অপেক্ষা এখানে অনেক ভাল কাজ করতে পারি। যাই হোক, আমাকে কর্ম করে আমার প্রারব্ধ ক্ষয় করতে হবে। আমার আর্থিক অবস্থার কথা যদি বলতে হয়, তবে বলি, আর্থিক অবস্থা বেশ সচ্ছলই আছে এবং সচ্ছলই থাকবে। সমগ্র আমেরিকায় বিগত আদমসুমারিতে থিওসফিষ্টদের সংখ্যা সর্বসুদ্ধ মাত্র ৬২৫ জন—তাদের সঙ্গে মিশলে আমার সাহায্য হওয়া দূরে থাক, মুহূর্তের মধ্যে আমার কাজ চুরমার হয়ে যাবে। আলাসিঙ্গা বলছে, লণ্ডনে গিয়ে মিঃ ওল্ডের সঙ্গে দেখা করতে, ইত্যাদি ইত্যাদি। ও কি বাজে আহাম্মকের মত বকছে! বালক—ওরা কি বলছে, তা নিজেরাই বোঝে না। আর এই মান্দ্রাজী খোকার দল—নিজেদের ভেতর একটা বিষয়ও গোপন রাখতে পারে না!! সারাদিন বাজে বকা আর যেই কাজের সময় এল, অমনি আর কারও পাত্তা পাবার যো নেই!!! বোকারামেরা পঞ্চাশটা লোক জড়ো করে, কয়েকটা সভা করে আমার সাহায্যের জন্য গোটাকতক ফাঁকা কথা পাঠাতে পারলে না—তারা আবার সমগ্র জগৎকে শিক্ষা দেব বলে লম্বা কথা কয়!