আমাদের দেশে সহস্র দৃঢ়চিত্ত নিঃস্বার্থ সন্ন্যাসী আছেন, তাঁহারা এখন গ্রামে গ্রামে যাইয়া লোককে ধর্ম শিখাইতেছেন। যদি তাঁহাদের মধ্যে কতকগুলিকে সাংসারিক প্রয়োজনীয় বিদ্যাসমূহের শিক্ষকরূপে সংগঠন করা যায়, তবে তাঁহারা এখন যেমন এক স্থান হইতে অপর স্থানে, লোকের দ্বারে দ্বারে গিয়া ধর্মশিক্ষা দিয়া বেড়াইতেছেন, তাহার সঙ্গে সঙ্গে লৌকিক বিদ্যাও শিখাইবেন। মনে করুন, এইরূপ দুইজন লোক একখানি ক্যামেরা, একটি গোলক ও কতকগুলি ম্যাপ প্রভৃতি লইয়া কোন গ্রামে গেলেন। এই ক্যামেরা ম্যাপ প্রভৃতির সাহায্যে তাঁহারা অজ্ঞ লোকদিগকে জ্যোতিষ ও ভূগোলের অনেক তত্ত্ব শিখাইতে পারেন! তারপর যদি বিভিন্ন জাতির—জগতের প্রত্যেক দেশের লোকের বিবরণ গল্পচ্ছলে তাঁহাদের নিকট বলা যায়, তবে সমস্ত জীবন বই পড়িয়া তাহারা যাহা না শিখিতে পারে, তদপেক্ষা শতগুণে অধিক এইভাবে মুখে মুখে শিখিতে পারে। ইহা করিতে হইলে একটি সঙ্ঘ গঠনের আবশ্যক হয়, তাহাতে আবার টাকার দরকার। ভারতে এইজন্য কাজ করিবার যথেষ্ট লোক আছে, কিন্তু দুঃখের বিষয় টাকা নাই। একটি চাকা গতিশীল করিতে প্রথমে অনেক কষ্ট; একবার ঘুরিতে আরম্ভ করিলে উহা উত্তরোত্তর অধিকতর বেগে ঘুরিতে থাকে। আমি আমার স্বদেশে এই বিষয়ের জন্য যথেষ্ট সাহায্য প্রার্থনা করিয়াছি; কিন্তু ধনিগণের নিকট আমি এ সম্বন্ধে কিছুমাত্র সহানুভূতি পাই নাই। মহামান্য মহারাজের সাহায্যে আমি এখানে আসিয়াছি। ভারতের দরিদ্রেরা মরুক বাঁচুক, আমেরিকানদের সে বিষয়ে খেয়াল নাই। আর আমাদের দেশের লোকেই যখন নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু ভাবে না, তখন ইহারাই বা ভাবিবে কেন?
হে মহামনা রাজন্! এই জীবন ক্ষণভঙ্গুর, জগতের ধন মান ঐশ্বর্য—সকলই ক্ষণস্থায়ী। তাহারাই যথার্থ জীবিত, যাহারা অপরের জন্য জীবনধারণ করে। অবশিষ্ট ব্যক্তিগণ বাঁচিয়া নাই, মরিয়া আছে। মহারাজের ন্যায় মহামনা একজন রাজবংশধর ইচ্ছা করিলে ভারতকে আবার নিজের পায়ে দাঁড় করাইয়া দিতে পারেন, তাহাতে ভবিষ্যৎ বংশধরগণ শ্রদ্ধার সহিত আপনার নাম স্মরণ করিবে। ঈশ্বর করুন, যেন আপনার মহৎ অন্তঃকরণ অজ্ঞতায় নিমগ্ন লক্ষ লক্ষ আর্ত ভারতবাসীর জন্য গভীরভাবে অনুভব করে। ইহাই প্রার্থনা—
বিবেকানন্দ
৯৯*
[রাও বাহাদুর নরসিংহাচারিয়াকে লিখিত]
চিকাগো
২৩ জুন, ১৮৯৪
প্রিয় মহাশয়,
আপনি আমাকে বরাবর যে অনুগ্রহ করিয়া থাকেন, তাহাতেই আমি আপনার নিকট একটি বিশেষ অনুরোধ করিতে সাহসী হইতেছি। মিসেস পটার পামার যুক্তরাজ্যের প্রধানা মহিলা। তিনি মহামেলার মহিলানেত্রী ছিলেন। সমগ্র জগতের স্ত্রীলোকদের অবস্থার যাহাতে উন্নতি হয়, সে বিষয়ে তিনি বিশেষ উৎসাহী, মেয়েদের একটি বিরাট প্রতিষ্ঠানের পরিচালিকা। তিনি লেডি ডফরিনের বিশেষ বন্ধু এবং তাঁহার ধন ও পদমর্যাদাগুণে ইওরোপীয় রাজপরিবারসমূহের নিকট হইতে অনেক অভ্যর্থনা পাইয়াছেন। এ দেশে তিনি আমার প্রতি বিশেষ সদয় ব্যবহার করিয়াছেন। এক্ষণে তিনি চীন, জাপান, শ্যাম ও ভারত সফরে বাহির হইতেছেন। অবশ্য ভারতের শাসনকর্তারা এবং বড় বড় লোকেরা তাঁহার আদর অভ্যর্থনা করিবেন। কিন্তু ইংরেজ রাজকর্মচারীদের সাহায্য ছাড়াই আমাদের সমাজ দেখিবার জন্য তিনি বিশেষ উৎসুক। আমি অনেক সময় তাঁহাকে ভারতীয় নারীদের অবস্থা উন্নত করিবার জন্য আপনার মহতী চেষ্টার এবং মহীশূরে আপনার চমৎকার কলেজটির কথা বলিয়াছি। আমার মনে হয়, আমাদের দেশের লোক আমেরিকায় আসিলে ইঁহারা যেরূপ সহৃদয় ব্যবহার করেন, তাহার প্রতিদানস্বরূপ এইরূপ ব্যক্তিদিগকে একটু আতিথেয়তা দেখানো কর্তব্য। আমি আশা করি, আপনারা তাঁহাকে সাদর অভ্যর্থনা করিবেন ও আমাদের স্ত্রীলোকদের যথার্থ অবস্থা একটু দেখাইতে সাহায্য করিবেন। তিনি মিশনরী বা গোঁড়া খ্রীষ্টান নহেন—আপনি সে ভয় করিবেন না। ধর্মনিরপেক্ষ ভাবে তিনি সমগ্র জগতের স্ত্রীলোকদের অবস্থার উন্নতির চেষ্টাই করিতে চান। তাঁহার উদ্দেশ্যসাধনে এইরূপে সহায়তা করিলে এদেশে আমাকেও অনেকটা সাহায্য করা হইবে। প্রভু আপনাকে আশীর্বাদ করুন।
ভবদীয় চিরস্নেহাস্পদ
বিবেকানন্দ
১০০*
[মিস মেরী ও হ্যারিয়েট হেলকে লিখিত]
চিকাগো
২৬ জুন, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনীগণ,
শ্রেষ্ঠ হিন্দী কবি তুলসীদাস তাঁর রামায়ণের মঙ্গলাচরণে বলেছেন, ‘আমি সাধু অসাধু উভয়েরই চরণ বন্দনা করি; কিন্তু হায়, উভয়েই আমার নিকট সমভাবে দুঃখপ্রদ—অসাধু ব্যক্তি আমার নিকট আসা মাত্র আমাকে যাতনা দিতে থাকে, আর সাধু ব্যক্তি ছেড়ে যাবার সময় আমার প্রাণ হরণ করে নিয়ে যান।’৫৩
আমি বলি ‘তথাস্তু’। আমার কাছে—ভগবানের প্রিয় সাধু ভক্তগণকে ভালবাসা ছাড়া সুখের ও ভালবাসার জিনিষ আর কিছুই নাই; আমার পক্ষে তাদের সঙ্গে বিচ্ছেদ মৃত্যুতুল্য। কিন্তু এ সব অনিবার্য। হে আমার প্রিয়তমের বংশীধ্বনি! তুমি পথ দেখিয়ে নিয়ে চল, আমি অনুগমন করছি। হে মহৎস্বভাবা মধুরপ্রকৃতি সহৃদয়া পবিত্রস্বভাবগণ! হায়, আমি যদি ষ্টোয়িক (Stoic) দার্শনিকগণের মত সুখদুঃখে নির্বিকার হতে পারতাম!
আশা করি তোমরা সুন্দর গ্রাম্য দৃশ্য বেশ উপভোগ করছ।
‘যা নিশা সর্বভূতানাং তস্যাং জাগর্তি সংযমী।
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশ্যতো মুনেঃ॥’—গীতা