এক্ষণে প্রশ্ন হইতে পারে যে, সন্ন্যাসিগণ কিসের জন্য এ জাতীয় ত্যাগব্রত গ্রহণ করিবে এবং কেনই বা এ প্রকারের কাজ করিতে অগ্রসর হইবে? উত্তরে আমি বলিব—ধর্মের প্রেরণায়! প্রত্যেক নূতন ধর্ম-তরঙ্গেরই একটি নূতন কেন্দ্র প্রয়োজন। প্রাচীন ধর্ম শুধু নূতন কেন্দ্র-সহায়েই নূতনভাবে সঞ্জীবিত হইতে পারে। গোঁড়া মতবাদ সব গোল্লায় যাউক—উহাদের দ্বারা কোন কাজই হয় না। একটি খাঁটি চরিত্র, একটি সত্যিকার জীবন, একটি শক্তির কেন্দ্র—একজন দেবমানবই পথ দেখাইবেন। এই কেন্দ্রেই বিভিন্ন উপাদান একত্র হইবে এবং প্রচণ্ড তরঙ্গের মত সমাজের উপর পতিত হইয়া সব কিছু ভাসাইয়া লইয়া যাইবে, সমস্ত অপবিত্রতা মুছিয়া দিবে। আবার দেখুন, একটি কাষ্ঠখণ্ডকে উহার আঁশের অনুকূলেই যেমন সহজে চিরিয়া ফেলা যায়, তেমনি হিন্দুধর্মের দ্বারাই প্রাচীন হিন্দুধর্মের সংস্কার করিতে হইবে, নব্য সংস্কার-আন্দোলন দ্বারা নহে। আর সেই সঙ্গে সঙ্গে সংস্কারকগণকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয়দেশের সংস্কৃতিধারা নিজ জীবনে মিলিত করিতে হইবে। সেই মহা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র প্রত্যক্ষ করিতেছেন বলিয়া মনে হয় কি? ঐ তরঙ্গের আগমনসূচক মৃদু গম্ভীর ধ্বনি শুনিতে পাইতেছেন কি? সেই শক্তিকেন্দ্র—সেই পথপ্রদর্শক দেবমানব ভারতবর্ষেই জন্মিয়াছিলেন। তিনি সেই মহান্ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস এবং তাঁহাকেই কেন্দ্র করিয়া এই যুবকদল ধীরে ধীরে সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া উঠিতেছে। তাহারাই এ মহাব্রত উদ্যাপন করিবে।
এ কার্যের জন্য সঙ্ঘের প্রয়োজন এবং অন্ততঃ প্রথম দিকটায় সামান্য কিছু অর্থেরও প্রয়োজন। কিন্তু ভারতবর্ষে কে আমাদিগকে অর্থ দিবে? … দেওয়ানজী সাহেব, আমি সেইজন্যই আমেরিকায় আসিয়াছি। আপনার স্মরণ থাকিতে পারে, আমি সমস্ত অর্থ দরিদ্রগণের নিকট হইতেই সংগ্রহ করিয়াছিলাম; ধনী-সম্প্রদায়ের দান আমি গ্রহণ করিতে পারি নাই, কারণ তাহারা আমার ভাব বুঝিতে পারে নাই। এ দেশে এক বৎসর ক্রমান্বয়ে বক্তৃতা দিয়াও আমি বিশেষ কিছু করিতে পারি নাই—অবশ্য আমার ব্যক্তিগত কোন অভাব নাই, কিন্তু আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যের জন্য অর্থসংগ্রহ করিয়া উঠিতে পারি নাই। তাহার প্রথম কারণ, এবার আমেরিকায় বড় দুর্বৎসর চলিতেছে, হাজার হাজার গরীব বেকার। দ্বিতীয়তঃ মিশনরীরা এবং ‘—’ গণ আমার মতবাদ ধ্বংস করিতে চেষ্টা করিতেছে। তৃতীয়তঃ একটি বৎসর অতীত হইয়া গেল, কিন্তু আমার দেশের কেহ এই কথাটুকু আমেরিকাবাসিগণকে বলিতে পারিল না যে, আমি সত্যই সন্ন্যাসী, প্রতারক নই এবং আমি হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি। শুধু এই কয়টি কথামাত্র, তাহাও তাহারা বলিতে পারিল না! আমার দেশবাসিগণকে সেজন্য আমি ‘বাহবা’ দিতেছি। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও দেওয়ানজী সাহেব, আমি তাহাদিগকে ভালবাসি। মানুষের সাহায্য আমি অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করি। যিনি গিরিগুহায়, দুর্গম বনে ও মরুভূমিতে আমার সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন—আমার বিশ্বাস, তিনি আমার সঙ্গেই থাকিবেন। আর যদি তাহা না হয়, তবে আমা অপেক্ষা শক্তিমান্ কোন পুরুষ কোন দিন ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করিয়া এই মহৎ কার্য সম্পন্ন করিবেন। আজ সব কথাই আপনাকে খুলিয়া বলিলাম। হে মহাপ্রাণ বন্ধু, আমার দীর্ঘ পত্রের জন্য আমাকে মার্জনা করিবেন; যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন আমার প্রকৃত দরদী আর আমার প্রতি সদয়, আপনি তাঁহাদেরই একজন; আপনি আমার এই দীর্ঘ পত্রের জন্য ক্ষমা করিবেন। হে বন্ধু, আপনি আমাকে স্বপ্নবিলাসী কিম্বা কল্পনাপ্রিয় বলিয়া অবশ্য মনে করিতে পারেন, কিন্তু এইটুকু অন্ততঃ বিশ্বাস করিবেন যে, আমি সম্পূর্ণ অকপট; আর আমার চরিত্রের সর্বপ্রধান ত্রুটি এই যে, আমি আমার দেশকে ভালবাসি, বড় একান্তভাবেই ভালবাসি।
হে মহাপ্রাণ বন্ধুবর, ভগবানের আশীর্বাদ আপনার ও আপনার আত্মীয়স্বজনের উপর নিরন্তর বর্ষিত হউক, তাঁহার অঙ্গচ্ছায়া আপনার সকল প্রিয়জনকে আবৃত করিয়া রাখুক। আমার অনন্ত কৃতজ্ঞতা আপনি গ্রহণ করুন। আপনার নিকট আমার ঋণ অপরিসীম, কারণ আপনি শুধু বন্ধু নহেন, পরন্তু আজীবন ভগবান্ ও মাতৃভূমির সেবা সমভাবে করিয়া আসিতেছেন। ইতি
চিরকৃতজ্ঞ
বিবেকানন্দ
পুনশ্চ—আপনার নিকট একটু অনুগ্রহ ভিক্ষা করি। আমি নিউ ইয়র্কে ফিরিয়া যাইতেছি। এই [হেল] পরিবারটি আমায় সর্বদা আশ্রয় দিয়াছে এবং আমাকে নিজ সন্তানের ন্যায় স্নেহ করিয়াছে। আর আমাদের স্বদেশীয়দের ও নিজেদের পুরোহিতকুলের কুৎসা সত্ত্বেও, এবং আমি তাহাদের নিকট কোন প্রকার প্রমাণলিপি পরিচয়পত্র বা ঐরূপ কোন কিছু না লইয়া আসা সত্ত্বেও তাহারা পশ্চাৎপদ হয় নাই। আপনি যদি আগ্রা ও লাহোরে প্রস্তুত দুই-তিনখানি গালিচা আমায় পাঠাইয়া দিতে পারেন, তবে তাহাদিগকে সামান্য কিছু উপহার দিবার সাধ আছে। ইহারা ঘরের মেঝেতে ভারতীয় গালিচা পাতিয়া রাখিতে খুব ভালবাসে—ইহা একটা বিশেষ বিলাসের বস্তু। … ইহাতে যদি অত্যধিক খরচ হয়, তবে আমি চাই না। আমি নিজে বেশ আছি। খাওয়া-দাওয়া ও বাড়ীভাড়া দেওয়ার মত এবং যখন খুশী ফিরিয়া যাওয়ার মত অর্থ আমার যথেষ্ট আছে।
আপনার
বি
৯৮*
(মহীশূরের মহারাজাকে লিখিত)
চিকাগো
২৩ জুন, ১৮৯৪
মহারাজ,
শ্রীনারায়ণ আপনার ও আপনার পরিবারবর্গের কল্যাণ করুন। আপনি অনুগ্রহপূর্বক সাহায্য করিয়াছিলেন বলিয়াই আমি এদেশে আসিতে সমর্থ হইয়াছি। তারপর আমাকে এ দেশে সকলে বিশেষরূপে জানিতে পারিয়াছে। আর এ দেশের অতিথিপরায়ণ ব্যক্তিগণ আমার সমুদয় অভাব পূরণ করিয়া দিয়াছেন। অনেক বিষয়ে এ এক আশ্চর্য দেশ ও এক অদ্ভুত জাতি! প্রথমতঃ জগতের মধ্যে কলকারখানার উন্নতিবিষয়ে এ জাতি সর্বশ্রেষ্ঠ। এ দেশের লোক নানাপ্রকার শক্তিকে যেমন কাজে লাগায়, অন্য কোথাও তদ্রূপ নহে—এখানে কেবল কল আর কল! আবার দেখুন, ইহাদের সংখ্যা সমুদয় জগতের লোকসংখ্যার বিশ ভাগের এক ভাগ হইবে, কিন্তু ইহারা জগতের ধনরাশির পুরা এক-ষষ্ঠাংশ অধিকার করিয়া বসিয়া আছে। ইহাদের ঐশ্বর্যবিলাসের সীমা নাই, আবার সব জিনিষই এখানে অতিশয় দুর্মূল্য। এখানে শ্রমিকের মজুরী জগতের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক, তথাপি শ্রমজীবী ও মূলধনীদের মধ্যে নিত্য বিবাদ চলিয়াছে।