আমার এখানে আসিবার মুখ্য উদ্দেশ্য—নিজের একটি বিশেষ কাজের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। আমি সমস্ত বিষয়টি পুনর্বার সবিস্তার আপনাকে বলিতেছি।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মূল পার্থক্য এই যে, পাশ্চাত্য দেশে জাতীয়তাবোধ আছে, আর আমাদের তাহা নাই। অর্থাৎ শিক্ষা ও সভ্যতা এখানে (পাশ্চাত্যে) সর্বজনীন—জনসাধারণে অনুপ্রবিষ্ট। ভারতবর্ষের ও আমেরিকার উচ্চবর্ণের মধ্যে খুব বেশী পার্থক্য নাই সত্য, কিন্তু উভয় দেশের নিম্মবর্ণের মধ্যে বিশাল পার্থক্য বিদ্যমান। ভারতবর্ষ জয় করা ইংরেজের পক্ষে এত সহজ হইয়াছিল কেন? যেহেতু তাহারা একটি সঙ্ঘবদ্ধ জাতি ছিল, আর আমরা তাহা ছিলাম না। আমাদের দেশে একজন মহৎ লোক মারা গেলে বহু শতাব্দী ধরিয়া আর একজনের আবির্ভাবের অপেক্ষায় বসিয়া থাকিতে হয়, আর এদেশে মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সে স্থান পূর্ণ হইয়া যায়। আপনি মারা গেলে (ভগবান্ আমার দেশের সেবার জন্য আপনাকে দীর্ঘায়ু করুন) আপনার স্থান পূর্ণ করিতে দেশ যথেষ্ট অসুবিধা বোধ করিবে; তাহা এখনই প্রতীয়মান হইতেছে, কারণ আপনাকে অবসর গ্রহণ করিতে দেওয়া হইতেছে না। বস্তুতঃ দেশে মহৎ ব্যক্তির অভাব ঘটিয়াছে। কেন তাহা হইয়াছে? কারণ এ দেশে কৃতী পুরুষগণের উদ্ভবক্ষেত্র অতি বিস্তৃত, আর আমাদের দেশে অতি সঙ্কীর্ণক্ষেত্র হইতে তাঁহাদের উদ্ভব হইয়া থাকে। এ দেশের শিক্ষিত নরনারীর সংখ্যা অত্যন্ত বেশী। তাই ত্রিশকোটি অধিবাসীর দেশ ভারতবর্ষ অপেক্ষা তিন চার কিম্বা ছয় কোটি নরনারী-অধ্যুষিত এ সকল দেশে কৃতী পুরুষগণের উদ্ভবক্ষেত্র বিস্তৃততর। আপনি সহৃদয় বন্ধু, আমাকে ভুল বুঝিবেন না। আমাদের জাতীয় জীবনে ইহা একটি বিশেষ ত্রুটি এবং ইহা দূর করিতে হইবে।
জনসাধারণকে শিক্ষিত করা এবং তাহাদিগকে উন্নত করাই জাতীয় জীবন-গঠনের পন্থা। আমাদের সমাজসংস্কারকগণ খুঁজিয়া পান না—ক্ষতটি কোথায়। বিধবা-বিবাহের প্রচলন দ্বারা তাঁহারা জাতিকে উদ্ধার করিতে চাহেন। আপনি কি মনে করেন যে, বিধবাগণের স্বামীর সংখ্যার উপর কোন জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে? আমাদের ধর্মের কোন অপরাধ নাই, কারণ মূর্তিপূজায় বিশেষ কিছু আসিয়া যায় না। সমস্ত ত্রুটির মূলই এইখানে যে, সত্যিকার জাতি—যাহারা কুটীরে বাস করে, তাহারা তাহাদের ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্ব ভুলিয়া গিয়াছে। হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান—প্রত্যেকের পায়ের তলায় পিষ্ট হইতে হইতে তাহাদের মনে এখন এই ধারণা জন্মিয়াছে যে, ধনীর পদতলে নিষ্পেষিত হইবার জন্যই তাহাদের জন্ম। তাহাদের লুপ্ত ব্যক্তিত্ববোধ আবার ফিরাইয়া দিতে হইবে। তাহাদিগকে শিক্ষিত করিতে হইবে। মূর্তিপূজা থাকিবে কি থাকিবে না, কতজন বিধবার পুনর্বার বিবাহ হইবে, জাতিভেদ-প্রথা ভাল কি মন্দ, তাহা লইয়া মাথা ঘামাইবার আমার প্রয়োজন নাই। প্রত্যেককেই তাহার নিজের মুক্তির পথ করিয়া লইতে হইবে। রাসায়নিক দ্রব্যের একত্র সমাবেশ করাই আমাদের কর্তব্য—দানাবাঁধার কার্য ঐশ্বরিক বিধানে স্বতই হইয়া যাইবে। আসুন, আমরা তাহাদের মাথায় ভাব প্রবেশ করাইয়া দিই—বাকীটুকু তাহারাই নিজেরাই করিবে। ইহার অর্থ, জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার করিতে হইবে। কিন্তু তাহাতেও অসুবিধা আছে। দেউলিয়া গভর্ণমেণ্ট কোন সহায়তা করিবে না, করিতে সক্ষমও নহে; সুতরাং সেদিক হইতে সহায়তার কোন আশা নাই।
ধরুন, যদি আমরা গ্রামে অবৈতনিক বিদ্যালয় খুলিতে সক্ষমও হই, তবু দরিদ্রঘরের ছেলেরা সে সব স্কুলে পড়িতে আসিবে না; তাহারা বরং ঐ সময় জীবিকার্জনের জন্য হালচাষ করিতে বাহির হইয়া পড়িবে। আমাদের না আছে প্রচুর অর্থ—না আছে ইহাদিগকে শিক্ষাগ্রহণে বাধ্য করিবার ক্ষমতা। সুতরাং সমস্যাটি নৈরাশ্যজনক বলিয়াই মনে হয়। কিন্তু আমি ইহারই মধ্যে একটি পথ বাহির করিয়াছি। তাহা এই—যদি পর্বত মহম্মদের নিকট নাই আসে তবে মহম্মদকেই পর্বতের নিকট যাইতে হইবে।৫২ দরিদ্র লোকেরা যদি শিক্ষার নিকট পৌঁছিতে না পারে (অর্থাৎ নিজেরা শিক্ষালাভে তৎপর না হয়), তবে শিক্ষাকেই চাষীর লাঙ্গলের কাছে, মজুরের কারখানায় এবং অন্যত্র সব স্থানে যাইতে হইবে। প্রশ্ন হইতে পারে যে, কিরূপে তাহা সাধিত হইবে? আপনি আমার গুরুভ্রাতাগণকে দেখিয়া থাকিবেন। এক্ষণে ঐরূপ নিঃস্বার্থ, সৎ ও শিক্ষিত শত শত ব্যক্তি সমগ্র ভারতবর্ষ হইতে আমি পাইব। ইহাদিগকে গ্রামে গ্রামে, প্রতি দ্বারে দ্বারে শুধু ধর্মের নহে, পরন্তু শিক্ষার আলোকও বহন করিয়া লইয়া যাইতে হইবে। আমাদের মেয়েদের শিক্ষার জন্য বিধবাদিগকে শিক্ষয়িত্রীয় কাজে লাগাইবার গোড়াপত্তন আমি করিয়াছি।
মনে করুন, কোন একটি গ্রামের অধিবাসিগণ সারাদিনের পরিশ্রমের পর গ্রামে ফিরিয়া আসিয়া কোন একটি গাছের তলায় অথবা অন্য কোন স্থানে সমবেত হইয়া বিশ্রম্ভালাপে সময়াতিপাত করিতেছে। সেই সময় জন-দুই শিক্ষিত সন্ন্যাসী তাহাদের মধ্যে গিয়া ছায়াচিত্র কিম্বা ক্যামেরার সাহায্যে গ্রহনক্ষত্রাদি সম্বন্ধে কিম্বা বিভিন্ন জাতি বা বিভিন্ন দেশের ইতিহাস সম্বন্ধে ছবি দেখাইয়া কিছু শিক্ষা দিল। এইরূপে গ্লোব, মানচিত্র প্রভৃতির সাহায্যে মুখে মুখে কত জিনিষই না শেখানো যাইতে পারে দেওয়ানজী! চক্ষুই যে জ্ঞানলাভের একমাত্র দ্বার তাহা নহে, পরন্তু কর্ণদ্বারাও শিক্ষার কার্য যথেষ্ট হইতে পারে। এইরূপে তাহারা নূতন চিন্তার সহিত পরিচিত হইতে পারে, নৈতিক শিক্ষা লাভ করিতে পারে এবং ভবিষ্যৎ অপেক্ষাকৃত ভাল হইবে বলিয়া আশা করিতে পারে। ঐটুকু পর্যন্ত আমাদের কর্তব্য—বাকীটুকু উহারা নিজেরাই করিবে।