সকলকে আমার আশীর্বাদ। মান্দ্রাজের যে সকল মহানুভব ব্যক্তি আমাদের কার্যে সহায়তা করিয়াছিলেন, তাঁহাদের সকলকেই আমার অনন্ত কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসা জানাইতেছি। কিন্তু আমি তাঁহাদের নিকট প্রার্থনা করি, যেন তাঁহারা কার্যে শৈথিল্য না করেন। চারিদিকে ভাব ছড়াইতে থাকো। গর্বিত হইও না। গোঁড়াদের মত জোর করিয়া কাহাকেও কিছু বিশ্বাস করিবার জন্য পীড়াপীড়ি করিও না, কোন কিছুর বিরুদ্ধেও বলিও না। আমাদের কাজ কেবল ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য একত্র রাখিয়া দেওয়া। প্রভু জানেন, কিরূপে ও কখন তাহারা নির্দিষ্ট আকার ধারণ করিবে। সর্বোপরি আমার বা তোমাদের কৃতকার্যতায় গর্বিত হইও না, বড় বড় কাজ এখনও করিতে বাকী। যাহা ভবিষ্যতে হইবে, তাহার সহিত তুলনায় এই সামান্য সিদ্ধি অতি তুচ্ছ। বিশ্বাস কর, বিশ্বাস কর, প্রভুর আজ্ঞা—ভারতের উন্নতি হইবেই হইবে, জনসাধারণকে এবং দরিদ্রদিগকে সুখী করিতে হইবে; আর আনন্দিত হও যে, তোমরাই তাঁহার কার্য করিবার নির্বাচিত যন্ত্র। ধর্মের বন্যা আসিয়াছে। আমি দেখিতেছি, উহা পৃথিবীকে ভাসাইয়া লইয়া যাইতেছে—অদম্য, অনন্ত, সর্বগ্রাসী। সকলেই সম্মুখে যাও, সকলের শুভেচ্ছা উহার সহিত যোগ দাও। সকল হস্ত উহার পথের বাধা সরাইয়া দিক্! জয়! প্রভুর জয়!!
শ্রীযুক্ত সুব্রহ্মণ্য আয়ার, কৃষ্ণস্বামী আয়ার, ভট্টাচার্য এবং আমার অন্যান্য বন্ধুগণকে আমার গভীর শ্রদ্ধা ভালবাসা জানাইবে। তাঁহাদিগকে বলিবে, যদিও সময়াভাবে কিছু লিখিতে পারি না, কিন্তু হৃদয় তাঁহাদের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট আছে। আমি তাঁহাদিগের ঋণ কখনও পরিশোধ করিতে পারিব না। প্রভু তাঁহাদের সকলকে আশীর্বাদ করুন।
আমার কোন সাহায্যের আবশ্যকতা নাই। তোমরা কিছু অর্থ সংগ্রহ করিয়া একটি ফণ্ড খুলিবার চেষ্টা কর। শহরের সর্বাপেক্ষা দরিদ্রগণের যেখানে বাস, সেখানে একটি মৃত্তিকানির্মিত কুটীর ও হল প্রস্তুত কর। গোটাকতক ম্যাজিক লণ্ঠন, কতকগুলি ম্যাপ, গ্লোব এবং কতকগুলি রাসায়নিক দ্রব্য ইত্যাদি যোগাড় কর। প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় সেখানে গরীব অনুন্নত, এমন কি, চণ্ডালগণকে পর্যন্ত জড়ো কর; তাহাদিগকে প্রথমে ধর্ম উপদেশ দাও, তারপর ঐ ম্যাজিক লণ্ঠন ও অন্যান্য দ্রব্যের সাহায্যে জ্যোতিষ, ভূগোল প্রভৃতি চলিত ভাষায় শিক্ষা দাও। অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত একদল যুবক গঠন কর। তোমাদের উৎসাহাগ্নি তাহাদের ভিতর জ্বালিয়া দাও। আর ক্রমশঃ এই সঙ্ঘ বাড়াইতে থাকো—উহার পরিধি বাড়িতে থাকুক। তোমরা যতটুকু পার, কর। যখন নদীতে জল কিছুই থাকিবে না, তখন পার হইব বলিয়া বসিয়া থাকিবে না। পত্রিকা, সংবাদপত্র প্রভৃতির পরিচালন ভাল, সন্দেহ নাই; কিন্তু চিরকাল চীৎকার ও কলমপেশা অপেক্ষা প্রকৃত কার্য—যতই সামান্য হউক, অনেক ভাল। ভট্টাচার্যের গৃহে একটি সভা আহ্বান কর। কিছু টাকা সংগ্রহ করিয়া পূর্বে আমি যাহা বলিয়াছি, সেইগুলি ক্রয় কর। একটি কুটীর ভাড়া লও এবং কাজে লাগিয়া যাও। পত্রিকাদি গৌণ, ইহাই মুখ্য। যে কোনরূপেই হউক, সাধারণ দরিদ্রলোকের মধ্যে আমাদের প্রভাব বিস্তার করিতেই হইবে। কার্যের সামান্য আরম্ভ দেখিয়া ভয় পাইও না, কাজ সামান্য হইতেই বড় হইয়া থাকে। সাহস অবলম্বন কর। নেতা হইতে যাইও না, সেবা কর। নেতৃত্বের এই পাশব প্রবৃত্তি জীবনসমুদ্রে অনেক বড় বড় জাহাজ ডুবাইয়াছে। এই বিষয়ে বিশেষ সতর্ক হও অর্থাৎ মৃত্যুকে পর্যন্ত তুচ্ছ করিয়া নিঃস্বার্থ হও এবং কাজ কর। আমার যাহা বলিবার ছিল, তোমাদিগকে সব লিখিতে পারিলাম না। হে বীরহৃদয় বালকগণ! প্রভু তোমাদিগকে সব বুঝাইয়া দিবেন। লাগো, লাগো, বৎসগণ! প্রভুর জয়! কিডিকে আমার ভালবাসা জানাইবে। আমি সেক্রেটারী সাহেবের পত্র পাইয়াছি।
তোমাদের স্নেহের
বিবেকানন্দ
৯৬*
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ
১৮ জুন, ’৯৪
প্রিয় অধ্যাপকজী,
অন্য চিঠিগুলো পাঠাতে দেরী হল বলে ক্ষমা করবেন। আমি সেগুলো আগে খুঁজে পাইনি। সপ্তাহখানেকের মধ্যে নিউ ইয়র্কে যাচ্ছি।
এনিষ্কোয়ামে যেতে পারব কিনা, ঠিক জানি না। আমি পুনরায় না লিখিলে চিঠিগুলো আমার কাছে পাঠাবার দরকার নেই। বষ্টনের কাগজে আমার বিরুদ্ধে লেখা সেই রচনাটি দেখে মিসেস ব্যাগলি খুবই বিচলিত হয়েছেন। তিনি ডেট্রয়েট থেকে আমার কাছে তার একটা কপি পাঠিয়েছেন এবং চিঠিপত্র লেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রভু তাঁকে আশীর্বাদ করুন, তিনি আমার প্রতি সব সময়ই খুব সদয় ছিলেন।
ভ্রাতঃ, আপনার মত বলিষ্ঠ হৃদয় সহজে মেলে না। এটা একটা আজব জায়গা—আমাদের এই দুনিয়াটা। তবে এই দেশে যেখানে আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত, সামান্য ‘পরিচয়পত্র’ও যেখানে আমার নেই, সেখানে এখানকার মানুষের কাছ থেকে যে পরিমাণে সহৃদয়তা পেয়েছি, তার জন্য সব জড়িয়ে আমি ঈশ্বরের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। শেষ পর্যন্ত সব কিছু মঙ্গলমুখী।
সদাকৃতজ্ঞ
বিবেকানন্দ
পুনশ্চ—ছেলেদের জন্য ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ষ্ট্যাম্প পাঠালাম, যদি তাদের কাজে লাগে।
৯৭*
[শ্রীযুত হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লিখিত]
C/o. G. W. Hale
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ
চিকাগো
২০ জুন, ১৮৯৪
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
আপনার অনুগ্রহলিপি আজ পাইলাম। আপনার মত মহাপ্রাণ ব্যক্তিকে বিবেচনাহীন কঠোর মন্তব্য দ্বারা দুঃখ দিয়াছি বলিয়া আমি অত্যন্ত বেদনা বোধ করিতেছি। আপনার অল্প স্বল্প সংশোধন আমি নতমস্তকে মানিয়া লইলাম। ‘শিষ্যস্তেঽহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্।’ কিন্তু দেওয়ানজী সাহেব, এ কথা আপনি ভালভাবেই জানেন যে, আপনাকে ভালবাসি বলিয়াই ঐরূপ কথা বলিয়াছিলাম। অসাক্ষাতে যাহারা আমার দুর্নাম রটাইয়াছে, তাহারা পরোক্ষভাবে আমার উপকার তো করেই নাই, পরন্তু আমাদের হিন্দু সমাজের পক্ষ হইতে আমেরিকার জনসাধারণের নিকট আমার প্রতিনিধিত্ব-বিষয়ে একটি কথাও উক্ত না হওয়াতে ঐ সকল দুর্নাম যথেষ্ট ক্ষতির কারণই হইয়াছে। আমার দেশবাসী কেহ—আমি যে তাহাদের প্রতিনিধি—এ বিষয়ে কি একটি কথাও লিখিয়াছিল? কিম্বা আমার প্রতি আমেরিকাবাসীদের সহৃদয়তার জন্য ধন্যবাদজ্ঞাপক একটি বাক্যও কি তাহারা প্রেরণ করিয়াছে? পক্ষান্তরে—আমেরিকাবাসীর নিকট তারস্বরে এই কথাই ঘোষণা করিয়াছে যে, আমি একটি পাকা ভণ্ড এবং আমেরিকায় পদার্পণ করিয়াই আমি প্রথম গেরুয়া ধারণ করিয়াছি। অভ্যর্থনার ব্যাপারে অবশ্য এই সকল প্রচারের ফলে আমেরিকায় কোন ক্ষতি হয় নাই; কিন্তু অর্থসাহায্যের ব্যাপারে এই ভয়াবহ ফল ঘটিয়াছে যে, আমেরিকাবাসিগণ আমার কাছে একেবারে হাত গুটাইয়া ফেলিয়াছে। এই যে এক বৎসর যাবৎ আমি এখানে আছি—এর মধ্যে ভারতবর্ষের একজন খ্যাতনামা লোকও এ দেশবাসীকে এ কথাটি জানানো উচিত মনে করেন নাই যে, আমি প্রতারক নহি। ইহার উপর আবার মিশনরী সম্প্রদায় সর্বদা আমার ছিদ্রানুসন্ধানে তৎপর হইয়াই আছে এবং ভারতবর্ষে খ্রীষ্টান পত্রিকাগুলিতে আমার বিরুদ্ধে যাহা প্রকাশিত হইয়াছে, তাহার প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি সংগ্রহ করিয়া এখানকার কাগজে ছাপা হইয়াছে। আর আপনারা এইটুকু জানিয়া রাখুন যে, এদেশের জনসাধারণ—ভারতবর্ষে খ্রীষ্টান ও হিন্দুতে যে কি পার্থক্য, তাহার খুব বেশী সংবাদ রাখে না।