আপনার বি.
ব্রাহ্মসমাজ আপনাদের দেশের ‘ক্রিশ্চান সায়েন্স’ দলের মত কিছু সময়ের জন্য কলিকাতায় বিস্তৃতিলাভ করেছিল, তারপর গুটিয়ে গেছে। এতে আমি সুখীও নই, দুঃখিতও নই। তার কাজ সে করেছে, যেমন সমাজসংস্কার। তার ধর্মের দান এক কানাকড়িও নয়। সুতরাং এ জিনিষ লোপ পেয়ে যাবে। যদি ম— মনে করেন আমি সেই মৃত্যুর অন্যতম কারণ, তিনি ভুল করেছেন। আমি এখনও ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারকার্যের প্রতি প্রভূত সহানুভূতিপূর্ণ। কিন্তু ঐ ‘অসার’ ধর্ম প্রাচীন ‘বেদান্ত’-এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে না। আমি কি করব? সেটা কি আমার দোষ? ম—কে বুড়ো বয়সে ছেলেমিতে পেয়েছে, এবং তিনি যে ফন্দি নিয়েছেন, তা আপনার খ্রীষ্টান মিশনরীদের ফন্দিবাজির চেয়ে একচুল কম নয়। প্রভু তাঁকে কৃপা করুন এবং শুভপথ দেখান।
আপনাদের
বিবেকানন্দ
আপনি কবে এনিষ্কোয়ামে যাচ্ছেন? অষ্টিন এবং বাইমকে আমার ভালবাসা, আপনার পত্নীকে আমার শ্রদ্ধা। আপনার জন্য গভীর প্রেম ও কৃতজ্ঞতা, যা ভাষায় প্রকাশে আমি অসমর্থ।
সদাপ্রেমবদ্ধ
বিবেকানন্দ
৯৫*
চিকাগো
২৮ মে, ১৮৯৪
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আমি তোমার পত্রের উত্তর পূর্বে দিতে পারি নাই, কারণ আমি নিউ ইয়র্ক ও বষ্টনের মধ্যে ক্রমাগত ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলাম আর আমি ন—র পত্রের অপেক্ষা করিতেছিলাম। আমার সম্বন্ধে কিছু লিখিবার পূর্বে তোমাকে ন—র কথা কিছু বলিব। সে সকলকে নিরাশ করেছে। কতকগুলো বিটকেল দুষ্ট পুরুষ ও মেয়ের সঙ্গে মিশিয়া যে একেবারে গোল্লায় গিয়াছে—এখন কেউ তাহাকে কাছে ঘেঁষিতে দেয় না। যাহা হউক, অধোগতির চরম সীমায় পৌঁছিয়া সে আমাকে সাহায্যের জন্য লেখে। আমিও তাহাকে যথাসাধ্য সাহায্য করিব। যাহা হউক, তুমি তাহার আত্মীয়স্বজনকে বলিবে, তাহারা যেন শীঘ্র তাহাকে দেশে ফিরিয়া যাইবার জন্য ভাড়া পাঠায়। তাহারা কুক কোম্পানীর নামে টাকা পাঠাইতে পারে—তাহারা ওকে নগদ টাকা না দিয়া ভারতের একখানা টিকিট দিবে। আমার বোধ হয়, প্রশান্ত মহাসাগরের পথে যাওয়াই তাহার পক্ষে ভাল—ঐ পথে কোথাও নামিয়া পড়িবার প্রলোভন কিছু নেই। বেচারা বিশেষ কষ্টে পড়িয়াছে—অবশ্য যাহাতে সে অনশনক্লেশ না পায়, সেই দিকে আমি দৃষ্টি রাখিব। ফটোগ্রাফ-সম্বন্ধে বক্তব্য এই, এখন আমার নিকট একখানাও নাই—খানকতক পাঠাইবার জন্য অর্ডার দিব। খেতড়ির মহারাজকে আমি কয়েকখানি পাঠাইয়াছিলাম এবং তিনি তাহা হইতে কতকগুলি ছাপাইয়াছিলেন—ইতোমধ্যে তুমি তাহা হইতে কতকগুলি পাঠাইবার জন্য লিখিতে পার।
জানি না, কবে ভারতে যাইব। সমুদয় ভার তাঁহার উপর ফেলিয়া দেওয়া ভাল, তিনি আমার পশ্চাতে থাকিয়া আমাকে চালাইতেছেন।
আমাকে ছাড়িয়া কাজ করিবার চেষ্টা কর, মনে কর, যেন আমি কখনও ছিলাম না। কোন ব্যক্তির বা কোন কিছুর জন্য অপেক্ষা করিও না। যাহা পার করিয়া যাও, কাহারও উপর কোন আশা রাখিও না। ধর্মপাল যে তোমাদের বলিয়াছিল, আমি এ দেশ হইতে যত ইচ্ছা টাকা পাইতে পারি, সে কথা ঠিক নয়। এ বছরটা এ দেশে বড়ই দুর্বৎসর—ইহারা নিজেদের দরিদ্রদেরই সব অভাব দূর করিতে পারিতেছে না। যাহা হউক, এরূপ সময়েও আমি যে উহাদের নিজেদের বক্তাদের অপেক্ষা অনেক সুবিধা করিতে পারিয়াছি, তাহার জন্য উহাদিগকে ধন্যবাদ দিতে হয়।
কিন্তু এখানে ভয়ানক খরচ হয়। যদিও প্রায় সর্বদাই ও সর্বত্রই আমি ভাল ভাল ও বড় বড় পরিবারের মধ্যে আশ্রয় পাইয়াছি, তথাপি টাকা যেন উড়িয়া যায়।
আমি বলিতে পারি না, আগামী গ্রীষ্মকালে এদেশ হইতে চলিয়া যাইব কিনা; খুব সম্ভবতঃ না। ইতোমধ্যে তোমরা সঙ্ঘবদ্ধ হইতে এবং আমাদের কাজ যাহাতে অগ্রসর হয়, তাহার চেষ্টা কর। বিশ্বাস কর যে তোমরা সব করিতে পার। জানিয়া রাখো যে, প্রভু আমাদের সঙ্গে রহিয়াছেন, আর অগ্রসর হও, হে বীরহৃদয় বালকগণ!
আমার দেশ আমাকে যথেষ্ট আদর করিয়াছে। আদর করুক আর নাই করুক, তোমরা ঘুমাইয়া থাকিও না, তোমরা শিথিল-প্রযত্ন হইও না। মনে রাখিবে যে, আমাদের উদ্দেশ্যের এক বিন্দুও এখনও কার্যে পরিণত হয় নাই। শিক্ষিত যুবকগণের মধ্যে কার্য কর, তাহাদিগকে একত্র করিয়া সঙ্ঘবদ্ধ কর। বড় বড় কাজ কেবল খুব স্বার্থত্যাগ দ্বারাই হইতে পারে। স্বার্থের আবশ্যকতা নাই, নামেরও নয়, যশেরও নয়—তা তোমারও নয়, আমারও নয় বা আমার গুরুর পর্যন্ত নয়। ভাব ও সঙ্কল্প যাহাতে কার্যে পরিণত হয়, তাহার চেষ্টা কর; হে বীরহৃদয় মহান্ বালকগণ! উঠে পড়ে লাগো! নাম, যশ বা অন্য কিছু তুচ্ছ জিনিষের জন্য পশ্চাতে চাহিও না। স্বার্থকে একেবারে বিসর্জন দাও ও কার্য কর। মনে রাখিও—‘তৃণৈর্গুণত্বমাপন্নৈর্বধ্যন্তে মত্তদন্তিনঃ’—অনেকগুলি তৃণগুচ্ছ একত্র করিয়া রজ্জু প্রস্তুত হইলে তাহাতে মত্ত হস্তীকেও বাঁধা যায়। তোমাদের সকলের উপর ভগবানের আশীর্বাদ বর্ষিত হউক! তাঁহার শক্তি তোমাদের সকলের ভিতর আসুক—আমি বিশ্বাস করি, তাঁহার শক্তি তোমাদের মধ্যেই রহিয়াছে। বেদ বলিতেছেন, ‘ওঠ, জাগো, যত দিন না লক্ষ্যস্থলে পঁহুছিতেছ, থামিও না। জাগো, জাগো, দীর্ঘ রজনী প্রভাতপ্রায়। দিনের আলো দেখা যাইতেছে। মহাতরঙ্গ উঠিয়াছে। কিছুতেই উহার বেগ রোধ করিতে পারিবে না। আমি পত্রের উত্তর দিতে দেরী করিলে বিষণ্ণ হইও না বা নিরাশ হইও না। লেখায়—আঁচড় কাটায় কি ফল? উৎসাহ, বৎস, উৎসাহ—প্রেম, বৎস, প্রেম। বিশ্বাস, শ্রদ্ধা। আর ভয় করিও না, সর্বাপেক্ষা গুরুতর পাপ—ভয়!