ভগবান্ শ্রীরামকৃষ্ণ একটি গল্প বলিতেনঃ এক আম-বাগানে কয়েকজন লোক বেড়াইতে গিয়াছিল; বাগানে ঢুকিয়া তাহারা গনিতে আরম্ভ করিল, কটা আম গাছ, কোন্ গাছে কত আম, এক-একটা ডালে কত পাতা, আমের বর্ণ, আকার, প্রকার ইত্যাদি নানাবিধ পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিচার করিতে লাগিল। আর একজন ছিল বিচক্ষণ, সে এসব গ্রাহ্য না করিয়া আম পাড়িতে লাগিল ও খাইতে লাগিল। বলো দেখি, কে বেশী বুদ্ধিমান্? আম খাও, পেট ভরিবে, কেবল পাতা গনিয়া—হিসাব করিয়া লাভ কি? এই পাতা-ডালপালা গোনা ও অপরকে উহার সংখ্যা জানাইবার চেষ্টা একেবারে ছাড়িয়া দাও। অবশ্য এরূপ কার্যের উপযোগিতা আছে, কিন্তু ধর্মরাজ্যে নয়। যাহারা এরূপ পাতা গনিয়া বেড়ায়, তাহাদের ভিতর হইতে কখনও একটিও ধর্মবীর বাহির করিতে পারিবে না। ধর্ম—যাহা মানবজীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য, মানুষের শ্রেষ্ঠ গৌরবের জিনিষ, তাহাতে পাতা-গোনারূপ অত পরিশ্রমের প্রয়োজন নাই। যদি তুমি ভক্ত হইতে চাও, তাহা হইলে কৃষ্ণ মথুরায় কি ব্রজে জন্মিয়াছিলেন, তিনি কি করিয়াছিলেন বা ঠিক কোন্ দিনে গীতা বলিয়াছিলেন, তাহা জানিবার কিছু আবশ্যক নাই। গীতায় কর্তব্য ও প্রেম সম্বন্ধে যে সুন্দর শিক্ষা আছে, আগ্রহের সহিত তাহা অনুসরণ করাই তোমার কাজ। উহার সম্বন্ধে বা উহার প্রণেতার সম্বন্ধে অন্যান্য বিশেষ বিবরণ জানা কেবল পণ্ডিতদের আমোদের জন্য। তাহারা যাহা চায় তাহা লইয়াই থাকুক। তাহাদের পণ্ডিতী তর্কবিচারে ‘শান্তিঃ শান্তিঃ’ বলিয়া এস আমরা আম খাইতে থাকি।
দ্বিতীয়তঃ গুরুর নিষ্পাপ হওয়া আবশ্যক। অনেক সময়ে লোকে বলিয়া থাকে, ‘গুরুর চরিত্র, গুরু কি করেন না করেন, দেখিবার প্রয়োজন কি? তিনি যা বলেন তাহাই বিচার করিতে হইবে। সেইটি লইয়াই কাজ করা প্রয়োজন।’ এ কথা ঠিক নয়। গতি-বিজ্ঞান, রসায়ন বা অন্য কোন জড়-বিজ্ঞানের শিক্ষক যাহাই হউন না কেন, কিছু আসে যায় না। কারণ উহাতে কেবল বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োজন হয়। কিন্তু অধ্যাত্মবিজ্ঞানের আচার্য অশুদ্ধচিত্ত হইলে তাঁহাতে আদৌ ধর্মালোক থাকিতে পারে না। অশুদ্ধচিত্ত ব্যক্তি কী ধর্ম শিখাইবে? নিজে আধ্যাত্মিক সত্য উপলব্ধি করিবার বা অপরে শক্তি সঞ্চার করিবার একমাত্র উপায়—হৃদয় ও মনের পবিত্রতা। যতদিন না চিত্তশুদ্ধি হয়, ততদিন ভগবদ্দর্শন বা সেই অতীন্দ্রিয় সত্তার আভাসজ্ঞানও অসম্ভব। সুতরাং ধর্মাচার্যের সম্বন্ধে প্রথমেই দেখা আবশ্যক তিনি কি চরিত্রের লোক; তারপর তিনি কি বলেন তাহাও দেখিতে হইবে। তাঁহার সম্পূর্ণরূপে শুদ্ধচিত্ত হওয়া আবশ্যক, তবেই তাঁহার কথার প্রকৃত একটা গুরুত্ব থাকে; কারণ তাহা হইলেই তিনি প্রকৃত শক্তি-সঞ্চারকের যোগ্য হইতে পারেন। নিজের মধ্যেই যদি সেই শক্তি না থাকে, তবে তিনি সঞ্চার করিবেন কী? গুরুর মন এরূপ প্রবল আধ্যাত্মিকস্পন্দন-বিশিষ্ট হওয়া চাই যে, তাহা যেন সমবেদনাবশে শিষ্যে সঞ্চারিত হইয়া যায়। গুরুর বাস্তবিক কার্যই এই—কিছু সঞ্চার করা, কেবল শিষ্যের বুদ্ধিশক্তি বা অন্য কোন শক্তি উত্তেজিত করিয়া দেওয়া নয়। বেশ স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়, গুরু হইতে শিষ্যে যথার্থই একটি শক্তি আসিতেছে। সুতরাং গুরুর শুদ্ধচিত্ত হওয়া আবশ্যক।
তৃতীয়তঃ দেখা আবশ্যক, গুরুর উদ্দেশ্য কি? গুরু যেন অর্থ, নাম-যশ বা কোন স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মশিক্ষাদানে প্রবৃত্ত না হন—সমগ্র মানবজাতির প্রতি শুদ্ধ প্রেমই যেন তাঁহার কার্যের নিয়ামক হয়। আধ্যাত্মিক শক্তি শুদ্ধ প্রেমের মাধ্যমেই সঞ্চারিত করা যাইতে পারে। কোনরূপ স্বার্থপূর্ণ ভাব, লাভ বা যশের ইচ্ছা এক মুহূর্তে এই সঞ্চারের মাধ্যম নষ্ট করিয়া ফেলে। ভগবান্ প্রেমস্বরূপ, আর যিনি ভগবানকে প্রেমস্বরূপ বলিয়া জানিয়াছেন, তিনিই মানুষকে ভগবদ্ভাব শিক্ষা দিতে পারেন।
যদি দেখ—গুরুতে এইসব লক্ষণ বর্তমান, তবে জানিবে তোমার কোন আশঙ্কা নাই। নতুবা তাঁহার নিকট শিক্ষায় বিপদ আছে; যেহেতু তিনি যদি হৃদয়ে সদ্ভাব সঞ্চার করিতে না পারেন, তিনি হয়তো অসদ্ভাব সঞ্চার করিবেন। এই বিপদ হইতে নিজেকে সর্বতোভাবে সাবধান রাখিতে হইবে। ‘যিনি বিদ্বান্ নিষ্পাপ ও কামগন্ধহীন, যিনি শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবিৎ’,২৫ তিনিই প্রকৃত সদ্গুরু।
যাহা বলা হইল, তাহা হইতে ইহা সহজেই প্রতীত হইবে যে, ধর্মে অনুরাগী হইবার, ধর্মের মর্মবোধ করিবার এবং উহা জীবনে পরিণত করিবার উপযোগী শিক্ষা যে-কোন ব্যক্তির নিকট হইতে পাওয়া যায় না। ‘শিলাখণ্ডের নিকট ধর্মোপদেশ-শ্রবণ, নদীর কলনাদে গ্রন্থপাঠ ও সর্বত্র শুভদর্শন’২৬ আলঙ্কারিক বর্ণনাহিসাবে সত্য বটে, কিন্তু যাহার নিজের মধ্যে সত্য বিকশিত হয় নাই, সে কখনও এগুলি হইতে এতটুকু জ্ঞান আহরণ করিতে পারে না। পর্বত, নদী প্রভৃতি কাহাকে শিক্ষা দিতে পারে?—যাহার পবিত্র হৃদয়ে ভক্তিকমল ফুটিয়া উঠিয়াছে, সেই মানবাত্মাকে। আর যে আলোকে এই কমল সুন্দররূপে ফুটিয়া উঠে, তাহা ব্রহ্মবিৎ সদ্গুরুরই জ্ঞানালোক। যখন এইভাবে হৃদয় উন্মুক্ত হয়, তখন সেই হৃদয়—পর্বত, নদী, তারা, সূর্য, চন্দ্র অথবা এই বিশ্বে যাহা কিছু আছে, তাহা হইতেই শিক্ষা লাভ করিতে পারে। কিন্তু যাহার হৃদয় এখনও উন্মুক্ত হয় নাই, সে এ-সকলে পর্বতাদি ব্যতীত আর কিছু দেখিতে পাইবে না। চিত্রশালায় গিয়া অন্ধের কিছু লাভ নাই। আগে তাহাকে চক্ষু দাও, তবেই সে সেখানকার দর্শনীয় বস্তুসমূহ হইতে কি শিক্ষা পাওয়া যায়, বুঝিতে পারিবে।