এখন আমরা বুঝিতে চেষ্টা করিব, অদ্বৈতমতের শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাতা এই বিষয়ে কি বলেন। আমরা দেখিব, অদ্বৈতমত কেমন দ্বৈতবাদীর সকল আশা- আকাঙ্ক্ষা অক্ষুণ্ণ রাখিয়া সঙ্গে সঙ্গে মানবজাতির মহোচ্চ দিব্যভাবের সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া নিজ সিদ্ধান্ত স্থাপন করিতেছেন। যাঁহারা মুক্তিলাভের পরও নিজ নিজ ব্যক্তিত্ব রক্ষা করিতে ইচ্ছা করেন, ভগবান্ হইতে স্বতন্ত্র থাকিতে চান, তাঁহাদের আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করিবার ও সগুণ ব্রহ্মকে সম্ভোগ করিবার যথেষ্ট অবসর থাকিবে। ইঁহাদেরই কথা ভাগবত-পুরাণে এইরূপ বর্ণিত হইয়াছেঃ ‘হে রাজন্, হরির এতাদৃশ গুণরাশি যে, যে-সকল মুনি আত্মারাম, যাঁহাদের সকল বন্ধন চলিয়া গিয়াছে, তাঁহারও ভগবানের প্রতি অহৈতুকী ভক্তি করিয়া থাকেন।১৬
সাংখ্যেরা ইঁহাদিগকে ‘প্রকৃতিলীন’ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। সিদ্ধিলাভ করিয়া ইঁহারা পরকল্পে কতকগুলি জগতের শাসনকর্তারূপে আবির্ভূত হন। কিন্তু ইঁহাদের মধ্যে কেহ কখনই ঈশ্বরতুল্য হইতে পারেন না। যাঁহারা এমন এক অবস্থায় উপনীত হন, যেখানে সৃষ্টি সৃষ্ট বা স্রষ্টা নাই, যেখানে জ্ঞাতা জ্ঞেয় বা জ্ঞান নাই, ‘সেখানে কে কাহাকে দেখে?’—এরূপ ব্যক্তি সমুদয়ের বাহিরে গিয়াছেন, যাহাকে শ্রুতি ‘নেতি, নেতি’ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। কিন্তু যাঁহারা এরূপ অবস্থা লাভ করিতে পারেন না বা এরূপ অবস্থায় যাইতে ইচ্ছা করেন না, তাঁহারা সেই এক অবিভক্ত ব্রহ্মকে প্রকৃতি, আত্মা, এবং ঐ উভয়ের অন্তর্যামী ঈশ্বর—এই তিনরূপে বিভক্ত দেখিবেন। ভক্তির আতিশয্যে চেতনার ঊর্ধ্বতর স্তরে যখন প্রহ্লাদ নিজেকে ভুলিয়া গেলেন, তখন তিনি জগৎ ও তাঁহার কারণ—কিছুই তো দেখিতে পাইলেন না, সমুদয়ই তাঁহার নিকট নাম-রূপ দ্বারা বিভক্ত নয়—এমন এক অনন্তরূপে প্রতীয়মান হইয়াছিল। কিন্তু যখনই তাঁহার বোধ হইল—তিনি প্রহ্লাদ, অমনি তাঁহার নিকট জগৎ ও অশেষকল্যাণগুণরাশির আধারস্বরূপ জগদীশ্বর প্রকাশিত হইলেন। মহাভাগা গোপীদিগেরও এই অবস্থা ঘটিয়াছিল। যতক্ষণ তাঁহারা কৃষ্ণের প্রতি গভীর অনুরাগে ও প্রেমে অহংজ্ঞানশূন্য ছিলেন, ততক্ষণ তাঁহারা সকলেই কৃষ্ণরূপে পরিণত হইয়াছিলেন। যখন তাঁহারা কৃষ্ণকে আবার উপাস্যরূপ পৃথক্ভাবে চিন্তা করিতে লাগিলেন, তখন তাঁহারা আবার গোপীভাব প্রাপ্ত হইলেন। তখনই ‘তাঁহাদের সম্মুখে মুখকমলে মৃদুহাস্যযুত, পীতাম্বরধারী, মাল্যভূষিত ও সাক্ষাৎ মন্মথের মন-মথনকারী কৃষ্ণ আবির্ভূত হইলেন।’১৭
এখন আবার আমরা আমাদের আচার্য শঙ্করের কথায় আসিতেছি। শঙ্কর বলেনঃ যাঁহারা সগুণব্রহ্মের উপাসনা করিয়া পরমেশ্বরের সহিত মিলিত হন, অথচ যাঁহাদের মন লয় হয় না, অক্ষুণ্ণ থাকে, তাঁহাদের ঐশ্বর্য সসীম কি অসীম? এই সংশয় উপস্থিত হইলে যুক্তি দেখানো হয় যে, তাঁহাদের ঐশ্বর্য অসীম, কারণ শাস্ত্রে পাওয়া যায় ‘তিনি স্বারাজ্য লাভ করেন’, ‘সকল দেবতা তাঁহার পূজা করেন’, ‘সমগ্র জগতে তাঁহার কামনার পূর্তি হয়।’ ইহার উত্তরে ব্যাসের উক্তি ‘জগদ্ব্যাপারবর্জং; মুক্তাত্মাগণ জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় ব্যতীত অন্যান্য অণিমাদি শক্তি লাভ করেন। জগতের নিয়ন্তৃত্ব কেবল নিত্যসিদ্ধ ঈশ্বরের—কারণ সৃষ্টিসম্বন্ধে যত শাস্ত্রীয় উক্তি আছে, সবগুলিতে তাঁহারই কথা বলা হইয়াছে। কোন প্রসঙ্গে সেখানে মুক্তাত্মাদের কোন উল্লেখ নাই। সেই পরম পুরুষ একাই জগন্নিয়ন্তৃত্বে নিযুক্ত। সৃষ্টাদি বিষয়ে যত শ্রুতি আছে, সবই তাঁহাকে লক্ষ্য করিতেছে। আর তাঁহার প্রসঙ্গে ‘নিত্যসিদ্ধ’ এই বিশেষণেও প্রদত্ত হইয়াছে। শাস্ত্র আরও বলেন, মুক্তাত্মাদের অণিমাদি-শক্তি ঈশ্বরের উপাসনা ও অন্বেষণ হইতেই লব্ধ হয়। অতএব সেই শক্তিগুলি অসীম নয়—সেগুলির আদি আছে ও সেগুলি সীমাবদ্ধ, সুতরাং জগতের নিয়ন্তৃত-বিষয়ে মুক্তাত্মাদের কোন স্থান নাই। আবার তাঁহাদের নিজ নিজ মনের অস্তিত্ববশতঃ এরূপ সম্ভব যে, পরস্পরের ইচ্ছা ভিন্ন ভিন্ন হইতে পারে; একজন হয়তো সৃষ্টি ইচ্ছা করিলেন, আর একজন নাশ ইচ্ছা করিলেন। এই বিরোধ এড়াইবার একমাত্র উপায়—সমুদয় ইচ্ছা এক ইচ্ছার অধীন করা। অতএব সিদ্ধান্ত এই যে, মুক্ত পুরুষগণের ইচ্ছা সেই ‘পরম পুরুষের অধীন।’১৮
অতএব সগুণ ব্রহ্মেরই প্রতি ভক্তি প্রয়োগ সম্ভব। ‘যাহারা অব্যক্ত নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসক তাহাদের ক্লেশ অধিকতর।’১৯ ভক্তি মানবপ্রকৃতির অনুকূলে সহজভাবে প্রবাহিত। আমরা ব্রহ্মের মানবীয় ভাব ব্যতীত অপর কোন ভাব ধারণ করিতে পারি না—ইহা সত্য কথা। কিন্তু আমাদের জ্ঞাত আর সকল বস্তুর সম্বন্ধেও কি ইহা সমভাবে সত্য নয়? পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনোবিজ্ঞানবিৎ ভগবান্ কপিল বহুযুগ পূর্বে প্রমাণসহ দেখাইয়াছেন যে, আমাদের বাহ্য বা আন্তর সর্বপ্রকার বিষয়জ্ঞান বা ধারণার মধ্যে মানবীয় চেতনা বা বুদ্ধি অন্যতম উপাদান। শরীর হইতে আরম্ভ করিয়া ঈশ্বর পর্যন্ত বিচার করিলে দেখিতে পাইব, আমাদের অনুভূত সমুদয় বস্তুই বুদ্ধি ও তাহার সহিত অপর কোন বস্তুর মিশ্রণ, তা সেটি যাহাই হউক। আর যাহাকে আমরা সচরাচর ‘সত্য বস্তু’ বলিয়া মনে করি, তাহা এই অনিবার্য মিশ্রণ। বাস্তবিকই বর্তমানে বা ভবিষ্যতে মানবমনের পক্ষে সত্যের জ্ঞান যতদূর সম্ভব, তাহা ইহার অতিরিক্ত আর কিছু নয়। অতএব ঈশ্বর মানবধর্মী বলিয়া তাঁহাকে অসত্য বলা নিছক বাজে কথা। এ যেন পাশ্চাত্য দর্শনে বিজ্ঞানবাদ (Idealism) ও বাস্তববাদের (Realism) মধ্যে তুচ্ছ বিবাদের মত। ঐ বিবাদ আপাততঃ ভয়াবহ বোধ হইলেও বাস্তব (real)-শব্দের অর্থ লইয়া মারপ্যাঁচের উপর স্থাপিত। ‘সত্য’ শব্দের দ্বারা যত প্রকার ভাব সূচিত হইয়াছে, সে-সব ভাবই ‘ঈশ্বর’ ভাবটির অন্তর্গত। জগতের অন্যান্য বস্তু যতদূর সত্য, ঈশ্বরও ততদূর সত্য। আর বাস্তব-শব্দটি এখানে যে অর্থে প্রযুক্ত হইল, ঐ শব্দদ্বারা তদপেক্ষা অধিক আর কিছু বুঝায় না। ইহাই হিন্দুদর্শনে ঈশ্বরসম্বন্ধীয় ধারণা।