এগুলি অবশ্য সগুণ ঈশ্বরের সংজ্ঞা। তবে কি ঈশ্বর দুইটি? ‘নেতি নেতি’ করিয়া জ্ঞানী যে সচ্চিদানন্দে উপনীত হন, তিনি একটি এবং ভক্তের প্রেমময় ভগবান্ আর একটি? না, সেই একই সচ্চিদানন্দ—প্রেমময় ভগবান্, একাধারে তিনি সগুণ ও নির্গুণ। সর্বদাই বুঝিতে হইবে, ভক্তের উপাস্য সগুণ ঈশ্বর, ব্রহ্ম হইতে স্বতন্ত্র বা পৃথক্ নন। সবই সেই ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্ ব্রহ্ম’। তবে নির্গুণ পরব্রহ্মের এই নির্গুণ স্বরূপ অতি সূক্ষ্ম বলিয়া প্রেম বা উপাসনার পাত্র হইতে পারেন না। এইজন্য ভক্ত ব্রহ্মের সগুণ ভাব অর্থাৎ পরমনিয়ন্তা ঈশ্বরকে উপাস্যরূপে নির্বাচন করেন। একটি উপমার দ্বারা বুঝা যাকঃ
ব্রহ্ম যেন মৃত্তিকা বা উপাদান—তাহা হইতে অনেক বস্তু নির্মিত হইয়াছে। মৃত্তিকারূপে ঐগুলি এক বটে, কিন্তু রূপ বা প্রকাশ উহাদিগকে পৃথক্ করিয়াছে। উৎপত্তির পূর্বে তাহারা ঐ মৃত্তিকাতেই অব্যক্তভাবে ছিল। উপাদান হিসাবে এক, কিন্তু যখন বিশেষ বিশেষ রূপ ধারণ করে, আর যতদিন সেই রূপ থাকে, ততদিন সেগুলি পৃথক্ পৃথক্। মাটির ইঁদুর কখনও মাটির হাতি হইতে পারে না। কারণ আকার গ্রহণ করিলে বিশেষ আকৃতিই বস্তুর বিশেষত্বের জ্ঞাপক। বিশেষ কোন আকৃতিহীন মৃত্তিকা হিসাবে অবশ্য উহারা একই। ঈশ্বর সেই পূর্ণ সত্যস্বরূপের উচ্চতম অভিব্যক্তি অথবা মনুষ্যমনের সর্বোচ্চ উপলব্ধি। সৃষ্টি অনাদি, ঈশ্বরও অনাদি। বেদান্তসূত্রের চতুর্থ অধ্যায়ের চতুর্থ পাদে মুক্তাত্মা যে প্রায়-অনন্ত শক্তি ও জ্ঞানের অধিকারী হয়, তাহা বর্ণন করিয়া ব্যাস আর একটি সূত্রে বলিতেছেন, ‘কিন্তু কেহই সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের শক্তিলাভ করিবে না, তাহা কেবল ঈশ্বরের।’১৩ এই সূত্রব্যাখ্যার সময় দ্বৈতবাদী ভাষ্যকারগণ পরতন্ত্র জীবের পক্ষে ঈশ্বরের অনন্ত শক্তি ও পূর্ণ স্বতন্ত্রতা লাভ করা যে কোন কালে সম্ভব নয়, তাহা অনায়াসে দেখাইতে পারেন। পূর্ণ দ্বৈতবাদী ভাষ্যকার মধ্বাচার্য বরাহপুরাণ হইতে একটি শ্লোক তুলিয়া তাঁহার প্রিয় সংক্ষিপ্ত উপায়ে এই সূত্রটির ব্যাখ্যা করিয়াছেন।
এই সূত্র ব্যাখ্যা করিতে গিয়া বিশিষ্টাদ্বৈত-ভাষ্যকার রামানুজ বলেনঃ
সংশয় উপস্থিত হয় যে, মুক্তাত্মাদিগের শক্তির মধ্যে পরম পুরুষের অসাধারণ শক্তি অর্থাৎ জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-লয়শক্তি ও সর্বনিয়ন্তৃত্ব অন্তর্ভুক্ত কিনা? অথবা উহার অভাবে পরম পুরুষের সাক্ষাৎ দর্শনই কেবল তাঁহাদের ঐশ্বর্য কিনা? মুক্তাত্মা জগতের নিয়ন্তৃত্ব লাভ করেন, ইহা যুক্তিযুক্ত মনে করা যাক। কেন? কারণ শ্রুতি বলেন, ‘মুক্তাত্মা পরম একত্ব লাভ করেন’ (মুণ্ডক উপনিষদ্, ৩।১।৩)। আরও উক্ত হইয়াছে, ‘তাঁহার সমুদয় বাসনা পূর্ণ হয়’। এখন কথা এই, পরম একত্ব ও সকল বাসনার পরিপূরণ পরম পুরুষের অসাধারণ শক্তি-জগন্নিয়ন্তৃত্ব ব্যতীত হইতে পারে না। অতএব সকল বাসনার পরিপূরণ ও পরম একত্ব লাভ হয় বলিলেই মানিতে হইবে, মুক্তাত্মা সমগ্র জগতের নিয়ন্তৃত্বও লাভ করেন। ইহার উত্তরে আমরা বলি, মুক্তাত্মা কেবল জগন্নিয়ন্তৃত্ব ব্যতীত আর সমুদয় শক্তিলাভ করেন। ‘জগন্নিয়মন’ অর্থে—জগতের সমুদয় স্থাবর জঙ্গমের বিভিন্ন প্রকার রূপ, স্থিতি ও বাসনার নিয়ন্তৃত্ব। মুক্তাত্মাদিগের কিন্তু এই জগন্নিয়মন—শক্তি নাই, যাহা কিছু ঈশ্বরের স্বরূপ আবৃত করে, তাঁহাদের দৃষ্টিপথ হইতে সে-সকল আবরণ চলিয়া গিয়াছে এবং তাঁহাদের প্রত্যক্ষ ব্রহ্মানুভূতি হয়—ইহাই তাঁহাদের একমাত্র ঐশ্বর্য। ইহা কিরূপে জানিলে? নিখিল-জগন্নিয়ন্তৃত্ব কেবল পরব্রহ্মেরই গুণ বলিয়া যে শাস্ত্রে কথিত হইয়াছে, সেই শাস্ত্রবাক্যবলেই ইহা জানিয়াছি। ‘যাঁহা হইতে সমুদয় বস্তু জন্মায়, যাঁহাতে অবস্থান করে এবং যাঁহাতে প্রলয়কালে প্রবেশ করে, তাঁহার সম্বন্ধে জানিবার ইচ্ছা কর, তিনি ব্রহ্ম।’—(তৈত্তি. উপ., ৩।১)। যদি এই জগন্নিয়ন্তৃত্ব মুক্তাত্মাদেরও সাধারণ গুণ হয়, তবে উদ্ধৃত শ্লোক ব্রহ্মের লক্ষণ হইতে পারে না, কারণ তাঁহার নিয়ন্তৃত্ব-গুণের দ্বারা তাঁহার লক্ষণ করা হইয়াছে। অসাধরণ গুণগুলিকেই বিশেষ লক্ষণ বলা হয়। অতএব নিম্নোদ্ধৃত শ্রুতিবাক্যসমূহে পরমপুরুষকেই জগন্নিয়মনের কর্তারূপে ব্যাখ্যা করা হইয়াছে, আর ঐ ঐ স্থলে মুক্তাত্মার এমন বর্ণনা নাই, যাহাতে জগন্নিয়ন্তৃত্ব তাঁহাদের উপর আরোপিত হইতে পারে। বেদবাক্যগুলি এইঃ ‘বৎস, আদিতে একমেবাদ্বিতীয়ম্ ছিলেন। তিনি আলোচনা করিলেন আমি বহু সৃষ্টি করিব। তিনি তেজ সৃজন করিলেন। কেবল ব্রহ্মই আদিতে ছিলেন। তিনি পরিণত হইলেন। তিনি ক্ষত্র নামে এক সুন্দর রূপ সৃজন করিলেন। বরুণ, সোম, রুদ্র, পর্জন্য, যম, মৃত্যু, ঈশান এই-সকল দেবতাই ক্ষত্র।’ ‘আদিতে আত্মাই ছিলেন। ক্রিয়াশীল আর কিছুই ছিল না। তিনি আলোচনা করিলেন, আমি জগৎ সৃষ্টি করিব—পরে তিনি এই জগৎ সৃজন করিলেন।’ ‘একমাত্র নারায়ণই ছিলেন। ব্রহ্ম, ঈশান, দ্যাবা-পৃথিবী, তারা, জল, অগ্নি, সোম কিংবা সূর্য—কিছুই ছিল না, তিনি একাকী সুখী হইলেন না। ধ্যানের পর তাঁহার একটি কন্যা ও দশ ইন্দ্রিয় জন্মিল।’ ‘যিনি পৃথিবীতে বাস করিয়া পৃথিবী হইতে স্বতন্ত্র’, ‘যিনি আত্মাতে বাস করিয়া’ ইত্যাদি।১৪
পরসূত্র-ব্যাখ্যায় রামানুজ বলিতেছেন, ‘যদি বল ইহা সত্য নয়, কারণ বেদে ইহার বিপরীতার্থপ্রতিপাদক অনেক শ্লোক আছে, তাহা হইলে বলিব—তাহা নিম্নদেবলোকে মুক্তাত্মার ঐশ্বর্য-বর্ণনা মাত্র।’১৫ ইহাও একরূপ সহজ মীমাংসা হইল।যদিও রামানুজের মতে সমষ্টির ঐক্য স্বীকৃত হইয়াছে, তথাপি তাঁহার মতে এই সমষ্টির মধ্যে নিত্য ভেদসমূহ আছে। অতএব এই মতও কার্যতঃ দ্বৈত বলিয়া জীবাত্ম ও সগুণ ঈশ্বরের স্পষ্ট ভেদ রক্ষা করা রামানুজের পক্ষে সহজ হইয়াছে।