পরাভক্তি-লাভের জন্য এইভাবে প্রস্তুত হওয়াই আবশ্যক। এই বৈরাগ্য-লাভ হইলে পরাভক্তির উচ্চতম শিখরে উঠিবার দ্বার যেন খুলিয়া যায়। তখনই আমরা বুঝিতে আরম্ভ করি, পরাভক্তি কি। আর যিনি পরাভক্তির রাজ্যে প্রবেশ করিয়াছেন, একমাত্র তাঁহারই বলিবার অধিকার আছে, ধর্মানুভূতির জন্য তাঁহার পক্ষে প্রতিমাপূজা বা অনুষ্ঠানাদি নিষ্প্রয়োজন। তিনিই কেবল সেই পরম প্রেমাবস্থা লাভ করিয়াছেন, যেখানে সকল মানবের ভ্রাতৃত্ব অনুভব করা সম্ভব; অপরে কেবল ইহা লইয়া বৃথা বাক্যব্যয় করে। তিনি তখন আর কোন ভেদ দেখিতে পান না; মহান্ প্রেমসমুদ্র তাঁহার অন্তরে প্রবেশ করিয়াছে; তখন তিনি আমাদের মত মানুষ পশু তরু লতা সূর্য চন্দ্র তারা দেখেন না, তিনি সর্বত্র সব কিছুর মধ্যে তাঁহার প্রিয়তমকে দেখিতে পান। যাহার মুখের দিকে তিনি তাকান, তাহারই ভিতর তিনি হরির প্রকাশ দেখিতে পান। সূর্য বা চন্দ্রের আলোক তাঁহারই প্রকাশমাত্র। যেখানেই তিনি কোন সৌন্দর্য বা মহত্ত্ব দেখিতে পান, সেখানেই তিনি অনুভব করেন—সবই সেই ভগবানের। এরূপ ভক্ত জগতে এখনও আছেন, জগৎ কখনই এরূপ ভক্ত-বিরহিত হয় না। এরূপ ভক্ত সর্পদষ্ট হইলে বলে—আমার প্রিয়তমের নিকট হইতে দূত আসিয়াছিল। এইরূপ ব্যক্তিরই কেবল বিশ্বজনীন ভ্রাতৃভাব সম্বন্ধে কিছু বলিবার অধিকার আছে। তাঁহার হৃদয়ে কখনও ক্রোধ বা ক্ষোভের সঞ্চার হয় না। বাহ্য ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ তাঁহার নিকট হইতে চিরকালের জন্য অন্তর্হিত। যখন প্রেমবলে অতীন্দ্রিয় সত্যকে তিনি সর্বদা দেখিতে পান, তখন কি করিয়া তিনি ক্রুদ্ধ হইবেন?
০৩. ভক্তিযোগের স্বাভাবিকতা ও উহার রহস্য
অর্জুন শ্রীভগবানকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, ‘যাঁহারা সর্বদা অবহিত হইয়া তোমার উপাসনা করেন, আর যাঁহারা অব্যক্ত নির্গুণের উপাসক, এতদুভয়ের মধ্যে কাহারা শ্রেষ্ঠ যোগী?’ শ্রীভগবান্ বলেন, ‘যাঁহারা আমাতে মন সংলগ্ন করিয়া নিত্যযুক্ত হইয়া পরম শ্রদ্ধার সহিত আমার উপাসনা করেন, তাঁহারাই আমার শ্রেষ্ঠ উপাসক, তাঁহারাই শ্রেষ্ঠ যোগী। যাঁহারা ইন্দ্রিয়সংযম ও বিষয়ে সমবুদ্ধি অবলম্বন করিয়া নির্গুণ, অনির্দেশ্য, অব্যক্ত, সর্বব্যাপী, অচিন্ত্য, নির্বিকার, অচল নিত্যস্বরূপকে উপাসনা করেন, সেই সর্বভূতহিতে রত ব্যক্তিগণও আমাকে লাভ করেন। কিন্তু যাঁহাদের মন অব্যক্তে আসক্ত, তাঁহাদের অধিকতর কষ্ট হইয়া থাকে; কারণ দেহাভিমানী ব্যক্তি অতি কষ্টে এই নির্গুণ ব্রহ্মে নিষ্ঠা লাভ করিতে পারে। কিন্তু যাঁহারা সমুদয় কার্য আমাতে সমর্পণ করিয়া মৎপরায়ণ হইয়া আমার ধ্যান ও উপাসনা করেন, আমি তাঁহাদিগকে শীঘ্রই পুনঃপুনঃ জন্মমৃত্যুরূপ মহাসমুদ্র হইতে উদ্ধার করি, কারণ তাঁহাদের মন সর্বদাই আমার প্রতি সম্পূর্ণরূপে আসক্ত।’৪এখানে জ্ঞানযোগ ভক্তিযোগ উভয়কেই লক্ষ্য করা হইয়াছে। এমন কি, উদ্ধৃতাংশে উভয়েরই লক্ষণ প্রকাশ করা হইয়াছে, বলা যাইতে পারে। জ্ঞানযোগ অবশ্য অতি মহান্; উহা তত্ত্ববিচারের দ্বারা পরব্রহ্মকে অনুভব করিবার পথ। আর আশ্চর্যের বিষয়, প্রত্যেকেই ভাবে—তত্ত্ববিচারের দ্বারা সে সব কিছু করিতে পারে। কিন্তু বাস্তবিক জ্ঞানযোগ অনুসারে জীবন-যাপন বড় কঠিন ব্যাপার, উহাতে অনেক বিপদাশঙ্কা আছে।
জগতে দুই প্রকার লোক দেখিতে পাওয়া যায়। একদল আসুর-প্রকৃতি—তাহারা এই শরীরটাকে সুখস্বাচ্ছন্দ্যে রাখাই জীবনের চরম উদ্দেশ্য মনে করে। আর যাঁহারা দেবপ্রকৃতি, তাঁহারা এই শরীরকে কেবল কোন বিশেষ উদ্দেশ্য-সাধনের উপায় মনে করেন। তাঁহারা মনে করেন, উহা যেন আত্মার উন্নতিসাধনের যন্ত্রবিশেষ। কথিত আছে, শয়তান নিজ উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য উদ্ধৃত করিতে পারে, করিয়াও থাকে। সুতরাং জ্ঞানমার্গ যেমন সাধুব্যক্তির উচ্চতম আদর্শলাভের প্রবল উৎসাহদাতা, সেইরূপ অসাধু ব্যক্তিরও কার্যের সমর্থক বলিয়া মনে হয়। জ্ঞানযোগে ইহাই মহা বিপদাশঙ্কা। কিন্তু ভক্তিযোগ অতি স্বাভাবিক ও মধুর। ভক্ত জ্ঞানযোগীর মত অত উচ্চ স্তরে উঠেন না, সুতরাং তাঁহার গভীর পতনের আশঙ্কাও নাই। এইটুকু বুঝিতে হইবে যে, সাধক যে পথেই অবলম্বন করুন না কেন, যতদিন না সমুদয় বন্ধন মোচন হইতেছে, ততদিন তিনি কখনই মুক্ত হইতে পারেন না। প্রশ্ন করা যাইতে পারে, ভক্ত এই সহজ পথ বাছিয়া লইয়া কিভাবে মুক্তিলাভ করিবেন?
এই কয়েকটি শ্লোকে দেখা যায়, প্রগাঢ় ভক্তি দ্বারা কিরূপে জনৈকা ভাগ্যবতী গোপীর জীবাত্মার পাপপুণ্যরূপ বন্ধন চূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। ‘ভগবানের চিন্তাজনিত পরমাহ্লাদে তাঁহার সমুদয় পুণ্যকর্মজনিত বন্ধন ক্ষয়প্রাপ্ত হইল, আর ভগবানকে কাছে না পাওয়ার মহাদুঃখে তাঁহার সমুদয় পাপ ধৌত হইয়া গেল। তখন কোন বন্ধন না থাকায় সেই গোপকন্যা মুক্তিলাভ করিলেন।’৫ এই শাস্ত্রবাক্য হইতে বেশ বুঝা যায়, ভক্তিযোগের গুহ্য রহস্য এই যে, মনুষ্যহৃদয়ের যত প্রকার বাসনা বা ভাব আছে, উহার কোনটিই স্বরূপতঃ মন্দ নয়; উহাদিগকে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রিত করিয়া ক্রমশঃ উচ্চাভিমুখী করিতে হইবে—যতদিন না ঐ ভাবগুলি চরমোৎকর্ষ লাভ করে। উহাদের সর্বোচ্চ গতি ভগবান্, এবং অন্যান্য সকল গতিই নিম্নাভিমুখী। ফল অনুসারে আমাদের সমুদয় মনোভাবকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়—সুখ ও দুঃখ; শেষোক্ত মনোভাবকে কি করিয়া উচ্চাভিমুখী করা যায়, তাহা ভাবিয়া সাধক দিশেহারা হন। কিন্তু ভক্তিযোগ শিক্ষা দেয়—ইহা সত্য-সত্যই সম্ভব। দুঃখের প্রয়োজনীয়তা আছে। বিষয় বা ধন লাভ করিতে না পারিয়া যখন কেহ দুঃখ পায়, তখন দুঃখবৃত্তিকে ভুল পথে চালিত করা হইতেছে। ‘কেন আমি সেই পরম পুরুষকে লাভ করতে পারিলাম না? কেন আমি ভগবানকে পাইলাম না?’—এই বলিয়া যদি কেহ যন্ত্রণায় অস্থির হয়, তবে সেই যন্ত্রণা তাহার মুক্তির কারণ হইবে। কয়েকটি মুদ্রা পাইলে যখন তোমার আহ্লাদ হয়, তখন বুঝিতে হইবে, তুমি তোমার আহ্লাদ-বৃত্তিকে ভুল পথে চালাইতেছ। উহাকে উচ্চতর বিষয়ে প্রেরণ করিতে হইবে, আমাদের সর্বোচ্চ লক্ষ্য ভগবানের চিন্তায় আনন্দ বোধ করিতে হইবে। অন্যান্য ভাব সম্বন্ধেও এই একই কথা। ভক্ত বলেন, উহাদের কোনটিই মন্দ নয়; সুতরাং তিনি ঐ ভাবগুলি বশীভূত করিয়া নিশ্চিতভাবে ঈশ্বরাভিমুখী করেন।
০৪. ভক্তির প্রকাশভেদ
ভগবানে ভক্তি যতভাবে প্রকাশিত হয়, এখানে তাহার কয়েকটি আলোচিত হইতেছে।৬ প্রথম—‘শ্রদ্ধা’। লোকে মন্দির ও তীর্থস্থানসমূহের প্রতি এত শ্রদ্ধাসম্পন্ন কেন? এই-সকল স্থানে ঈশ্বরের পূজা হয় বলিয়া, এই-সকল স্থানে গেলে ঈশ্বরের ভাবের উদ্দীপনা হয় বলিয়া, এই-সকল স্থানের সহিত ঈশ্বরের সত্তা জড়িত। সকল দেশেই লোকে ধর্মাচার্যগণের প্রতি এত শ্রদ্ধাসম্পন্ন কেন? তাঁহারা সকলেই সেই এক ভগবানের মহিমাই প্রচার করেন; তাঁহাদের প্রতি শ্রদ্ধাসম্পন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। এই শ্রদ্ধার মূল ভালবাসা। যাহাকে আমরা ভালবাসি না, তাহার প্রতি শ্রদ্ধাসম্পন্ন হইতে পারি না।