সকল প্রকার বৈরাগ্য অপেক্ষা ভক্তিযোগীর বৈরাগ্য খুব স্বাভাবিক। ইহাতে কোন কঠোরতা নাই, জোর করিয়া কিছু ছাড়িতে হয় না। ভক্তের ত্যাগ অতি সহজ—চারিদিকের দৃশ্যের মতই অতি স্বাভাবিক; এই ত্যাগেরই প্রকাশ আমরা আমাদের চতুর্দিকে প্রতিদিন দেখিতে পাই—যদিও অল্প-বিস্তর বিকৃতরূপে। কোন পুরুষ কোন নারীকে ভালবাসিতে শুরু করিল; কিছুদিন বাদে সে আর একজনকে ভালবাসিল, প্রথমটিকে ছাড়িয়া দিল। ঐ প্রথম নারীটির চিন্তা ধীরে ধীরে শান্তভাবে তাহার মন হইতে চলিয়া গেল; সে আর ঐ নারীর অভাব বোধ করিল না। এবার মনে করো কোন নারী কোন পুরুষকে ভালবাসিতেছে। সে আবার যখন অপর এক পুরুষকে ভালবাসে, তখন এই প্রথম পুরুষটির কথা যেন তাহার মন হইতে সহজেই চলিয়া যায়। কোন লোক হয়তো নিজের শহরকে ভালবাসে। ক্রমশঃ সে নিজের দেশকে ভালবাসিতে আরম্ভ করিল। তখন তাহার নিজের ক্ষুদ্র শহরের জন্য যে প্রগাঢ় ভালবাসা, তাহা স্বভাবতই চলিয়া গেল। আবার মনে কর, কোন লোক সমুদয় জগৎকে ভালবাসিতে শিখিল, তখন তাহার স্বদেশানুরাগ, নিজ দেশের জন্য প্রবল উন্মত্ত ভালবাসা চলিয়া যায়। তাহাতে তাহার কিছু কষ্ট হয় না। এই ভাব তাড়াইবার জন্য তাহাকে কিছু জোর করিতে হয় না। অশিক্ষিত লোক ইন্দ্রিয়সুখে উন্মত্ত, শিক্ষিত হইতে থাকিলে সে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চায় অধিকতর সুখ পাইতে থাকে। তখন সে বিষয়ভোগে আর তত সুখ পায় না। কুকুর ও ব্যাঘ্র খাদ্য পাইলে যেরূপ স্ফূর্তির সহিত ভোজন করিতে থাকে, কোন মানুষের পক্ষে সেরূপ সম্ভব নয়। আবার মানুষ বুদ্ধিবলে নানা বিষয় জানিয়া ও নানা কার্য সম্পাদন করিয়া সে সুখ অনুভব করে, কুকুর কখনও তাহা অনুভব করিতে পারে না। প্রথমে ইন্দ্রিয় হইতে সুখানুভূতি হইয়া থাকে, কিন্তু যখনই কোন প্রাণী জীবনের উচ্চস্তরে উন্নীত হয়, তখনই এই নিম্নজাতীয় সুখের মূল্য তাহার কাছে কমিয়া যায়। মনুষ্যসমাজে দেখা যায়, মানুষ যতই পশুর তুল্য হয়, সে ততই তীব্রভাবে ইন্দ্রিয়সুখ অনুভব করে; আর যতই তাহার শিক্ষাদির উন্নতি হয়, ততই বুদ্ধিবৃত্তির পরিচালনায় ও এরূপ সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয়ে তাহার সুখানুভূতি হইতে থাকে। এইরূপে মানুষ যখন বুদ্ধির বা মনোবৃত্তির অতীত ভূমিতে আরোহণ করে, যখন সে আধ্যাত্মিকতা ও দিব্যানুভূতির ভূমিতে আরোহণ করে, তখন সে এমন এক আনন্দের অবস্থা লাভ করে, যাহার তুলনায় ইন্দ্রিয়বৃত্তি বা বুদ্ধিবৃত্তি-পরিচালনাজনিত সুখ শূন্য বলিয়া মনে হয়। এরূপ হওয়া খুবই স্বাভাবিক। যখন চন্দ্র উজ্জ্বলভাবে শোভা পায়, তখন তারাগণ নিষ্প্রভ হইয়া যায়। আবার সূর্য উদিত হইলে চন্দ্রও নিষ্প্রভ ভাব ধারণ করে। ভক্তির জন্য যে বৈরাগ্যের প্রয়োজন, তাহা কোন কিছুকে নষ্ট করিয়া পাইতে হয় না। যেমন কোন ক্রমবর্ধমান আলোকের নিকট অল্পোজ্জ্বল আলোক স্বভাবতই ক্রমশঃ নিষ্প্রভ হইতে হইতে শেষে একেবারে অন্তর্হিত হয়, সেইরূপ ভগবৎপ্রেমোন্মত্ততায় ইন্দ্রিয়বৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি-জনিত সুখসমূহ স্বভাবতই নিষ্প্রভ হইয়া যায়।
এই ঈশ্বরপ্রেম ক্রমশঃ বর্ধিত হইয়া এমন এক ভাব ধারণ করে, যাহাকে ‘পরাভক্তি’ বলে। যে সাধক ঈশ্বরের জন্য ঐরূপ প্রেম লাভ করিয়াছেন, তাঁহার পক্ষে অনুষ্ঠানের আর আবশ্যকতা থাকে না, শাস্ত্রের কোন প্রয়োজন থাকে না; প্রতিমা, মন্দির, ভজনালয়, বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়, দেশ, জাতি—এই-সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধ ভাব ও বন্ধন আপনা হইতেই চলিয়া যায়। কিছুই আর তাঁহাকে বাঁধিতে পারে না, কিছুই তাঁহার স্বাধীনতা নষ্ট করিতে পারে না। জাহাজ হঠাৎ চুম্বকপ্রস্তরের পাহাড়ের নিকট আসিলে পেরেকগুলি আকৃষ্ট হইয়া পড়িয়া যায়, আর তক্তাগুলি জলের উপর ভাসিতে থাকে। ভগবৎকৃপা এইরূপে আত্মার বন্ধন অর্থাৎ তাহার স্বরূপ-প্রকাশের বিঘ্নসমুহ অপসারিত করিয়া দেয়, তখন উহা মুক্ত হইয়া যায়। সুতরাং ভক্তিলাভের উপায়-স্বরূপ এই বৈরাগ্য-সাধনে কোন কঠোরতা নাই, কোন কর্কশ বা শুষ্ক ভাব নাই, কোনরূপ সংগ্রাম নাই। ভক্তকে তাঁহার হৃদয়ের কোন ভাবই দমন করিতে হয় না, চাপিয়া রাখিতে হয় না, তাঁহাকে বরং সেই-সকল ভাব প্রবল করিয়া ভগবানের দিকে চালিত করিতে হয়।
০২. ভক্তের বৈরাগ্য প্রেমপ্রসূত
প্রকৃতিতে আমরা সর্বত্রই প্রেমের বিকাশ দেখিতে পাই। সমাজের মধ্যে যাহা কিছু সুন্দর ও মহৎ—সবই প্রেমপ্রসূত; আবার কুৎসিত এবং পৈশাচিক ব্যাপারগুলিও সেই একই প্রেমশক্তির বিকার মাত্র। যে চিত্তবৃত্তি হইতে পতিপত্নীর বিশুদ্ধ দাম্পত্যপ্রেম উদ্ভূত, অতি নীচ কামবৃত্তিও সেই খনি হইতে সঞ্জাত। ভাব সেই একই, তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উহার প্রকাশ বিভিন্ন। এই একই প্রেম কাহাকেও ভাল কাজে প্রেরণা দেয় এবং সে দরিদ্রকে সর্বস্ব অর্পণ করে আবার কেহ বা ইহারই প্রভাবে নিজ ভ্রাতার গলা কাটিয়া তাহার যথাসর্বস্ব অপহরণ করে। দ্বিতীয় ব্যক্তি নিজেকে যেমন ভালবাসে, প্রথম ব্যক্তি অপরকে সেইরূপ ভালবাসে। দ্বিতীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রেম ভ্রান্ত পথে চালিত; কিন্তু প্রথম ক্ষেত্রে উহা ঠিক পথে প্রযুক্ত। যে-অগ্নিতে আমাদের খাদ্য প্রস্তুত হয়, তাহাই আবার একটি শিশুকে দগ্ধ করিতে পারে। ইহাতে অগ্নির কিছু দোষ নাই, ব্যবহারে ও ফলে তারতম্য হয়। অতএব যে-প্রেমকে দুই ব্যক্তির প্রবল আসঙ্গস্পৃহা বলা যায়, তাহাই আবার অবশেষে উচ্চনীচ সর্বপ্রাণীর সেই এক স্বরূপে বিলীন হইবার ইচ্ছারূপে সর্বত্র প্রকাশিত।