মিসিং
===========
অনুষ্ঠানগুলিকে মরণ-কামড়ে ধরিয়া থাকে, কোনমতে ছাড়িতে চায় না। যদি ঐ অনুষ্ঠানগুলি আধ্যাত্মিক জীবনের পরিচায়ক হয়, তবেই উহাদের উপযোগিতা আছে বলিতে হইবে। প্রাণশূন্য হইলে উহাদিগকে নির্দয়ভাবে উৎপাটন করিয়া ফেলা উচিত।
‘অনবসাদ’ বা বল ভক্তিলাভের পরবর্তী সাধন। শ্রুতি বলেন, ‘বলহীন ব্যক্তি তাঁহাকে লাভ করিতে পারে না।’৪৩ এখানে শারীরিক বা মানসিক উভয় প্রকার দৌর্বল্য লক্ষিত হইয়াছে। ‘বলিষ্ঠ, দ্রঢ়িষ্ঠ’৪৪ ব্যক্তিই প্রকৃত শিষ্য হওয়ার উপযুক্ত। দুর্বল, শীর্ণকায়, জরাজীর্ণ ব্যক্তি কী সাধন করিবে? শরীর ও মনের মধ্যে যে অদ্ভূত শক্তিসমূহ লুক্কায়িত আছে কোনরূপ যোগাভ্যাসের দ্বারা তাহারা কিঞ্চিৎ পরিমাণে জাগ্রত হইলেও দুর্বল ব্যক্তি একেবারে খণ্ড খণ্ড হইয়া যাইবে। যুবা, সুস্থকায়, সবল ব্যক্তিই সিদ্ধ হইতে পারেন। সুতরাং সিদ্ধি লাভের জন্য মানসিক বল যে পরিমাণে প্রয়োজন, শারীরিক বলও সেই পরিমাণে চাই। ইন্দ্রিয়সংযমের প্রতিক্রিয়া খুব সবল দেহই সহ্য করিতে পারে। অতএব ভক্ত হইতে যাঁহার সাধ, তাঁহাকে সবল ও সুস্থকায় হইতে হইবে। যাহারা দুর্বল তাহারা যদি কোনরূপ যোগাভ্যাসের চেষ্টা করে, তবে হয় তাহারা কোন দুশ্চিকিৎস্য ব্যাধিগ্রস্ত হইবে, নতুবা মনকে ভয়ানক দুর্বল করিয়া ফেলিবে। ইচ্ছাপূর্বক শরীরকে দুর্বল করা ভক্তি-বা জ্ঞান লাভের অনুকূল ব্যবস্থা নয়।
যাহার চিত্ত দুর্বল, সেও আত্মলাভে কৃতকার্য হয় না। যে ভক্ত হইতে ইচ্ছুক, সে সর্বদা প্রফুল্ল থাকিবে। পাশ্চাত্যে অনেকের কাছে ধার্মিক এর লক্ষণ—সে কখনও হাসিবে না, তাহার মুখ সর্বদা বিষাদমেঘে আবৃত থাকিবে, তাহার চোয়াল বসা ও মুখ লম্বা হওয়া আবশ্যক। শুষ্কশরীর ও লম্বামুখ লোক ডাক্তারের তত্ত্বাবধানের যোগ্য বটে, কিন্তু তাহারা কখনও যোগী হইতে পারে না। প্রফুল্লচিত্ত ব্যক্তিই অধ্যবসায়শীল হইতে পারে। দৃঢ়চেতা ব্যাক্তিই সহস্র বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করিয়া যাইতে পারে। মায়াজাল ছিন্ন করিয়া বাহিরে যাওয়া—যোগ সাধন করা মহা কঠিন কার্য, দৃঢ় ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন বীরগণের দ্বারাই ইহা সম্ভব।
৪০ আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধিঃ সত্ত্বশুদ্ধোঃধ্রুবা স্মৃতিঃ।—ছান্দোগ্য উপনিষদ্, ৭।২৬২
৪১ আহ্নিয়তে ইত্যাহারঃ শব্দাদিবিষয়জ্ঞানম্ ভোক্তুর্ভোগায়াহ্রিয়তে। তস্য বিষয়োপলব্ধিলক্ষণস্য বিজ্ঞানস্য শুদ্ধিরাহারশুদ্ধিঃ রাগদ্বেষমোহদোষৈরসংসৃষ্টং বিষয়বিজ্ঞানামিত্যর্থঃ। তস্যামাহারশুদ্ধৌ সত্যাং তদ্বতোহন্তঃকরণস্য সত্ত্বস্য শুদ্ধির্নৈল্যাং ভবতি; সত্ত্বশুদ্ধৌ চ সত্যাং যথাবগতে ভূমাত্মনি ধ্রুবাবিচ্ছিন্না স্মৃতিরবিস্মরণং ভবতি।—শাঙ্করভাষ্য, ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৭।২৬
৪২ অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে। —গীতা, ৬।৩৫
৪৩ ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ।’ —মুণ্ডক উপ., ৩।২।৪
৪৪ আশিষ্ঠো দ্রঢ়িষ্ঠো বলিষ্ঠঃ।’ —তৈত্তি. উপ., ২।৮।১
০২. পরাভক্তি
০১. ভক্তির প্রস্তুতি-ত্যাগ
গৌণী ভক্তির কথা সংক্ষেপে শেষ করিয়া আমরা পরাভক্তির আলোচনায় প্রবেশ করিতেছি। এখন এই পরাভক্তি-অভ্যাসের জন্য প্রস্তুত হইবার শেষ সাধনটির কথা বিবেচনা করা যাক। সর্বপ্রকার সাধনের উদ্দেশ্য আত্মশুদ্ধি—নাম-সাধন, প্রতীক ও প্রতিমাদির উপাসনা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠান কেবল আত্মশুদ্ধির জন্য। কিন্তু শুদ্ধিকারক সমুদয় সাধনের মধ্যে ত্যাগই সর্বশ্রেষ্ঠ—উহা ব্যতীত কেহ এই পরাভক্তির রাজ্যে প্রবেশই করিতে পারে না। অনেকের পক্ষে এই ত্যাগ অতি ভয়াবহ ব্যাপার বোধ হইতে পারে, কিন্তু ত্যাগ ব্যতীত কোনরূপ আধ্যাত্মিক উন্নতিই সম্ভব নয়; সকল যোগেই এই ত্যাগ আবশ্যক। এই ত্যাগই ধর্মের সোপান—সমুদয় সাধনের অন্তরঙ্গ সাধন। সংক্ষেপে বলিতে গেলে—ত্যাগই প্রকৃত ধর্ম। যখন মানবাত্মা সংসারের সমুদয় বস্তু দূরে ফেলিয়া গভীর তত্ত্বসমূহ অনুসন্ধান করে, যখন চৈতন্যস্বরূপ মানব বুঝিতে পারে, দেহরূপ জড়ে বদ্ধ হইয়া জড় হইয়া যাইতেছি এবং ক্রমশঃ বিনাশের পথে অগ্রসর হইতেছি, তখন সে জড়পদার্থ হইতে নিজের দৃষ্টি সরাইয়া লয়—তখনই ত্যাগ আরম্ভ হয়, তখনই প্রকৃত আধ্যাত্মিক উন্নতি আরম্ভ হয়। কর্মযোগী সমুদয় কর্মফল ত্যাগ করেন, তিনি যে-সকল কর্ম করেন, তাহার ফলে তিনি আসক্ত হন না, তিনি ঐহিক বা পারত্রিক কোন লাভের জন্য আগ্রহান্বিত হন না। রাজযোগীর মতে সমুদয় প্রকৃতির লক্ষ্য—পুরুষ বা আত্মাকে বিচিত্র সুখদুঃখ ভোগ করানো। ইহার ফলে আত্মা বুঝিতে পারেন, প্রকৃতি হইতে তিনি নিত্য স্বতন্ত্র বা পৃথক্। মানবাত্মাকে জানিতে হইবে—তিনি চিরকাল চৈতন্যস্বরূপই ছিলেন, আর জড়ের সহিত তাঁহার সংযোগ কেবল সাময়িক, ক্ষণিকমাত্র। রাজযোগী প্রকৃতির সমুদয় সুখদুঃখ ভোগ করিয়া অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়া বৈরাগ্যের শিক্ষা লাভ করেন। জ্ঞানযোগীর বৈরাগ্য সর্বাপেক্ষা কঠোর। কারণ তাঁহাকে প্রথম হইতেই এই বাস্তবরূপে দৃশ্যমান প্রকৃতিকে মিথ্যা মায়া বলিয়া জানিতে হয়। তাঁহাকে বুঝিতে হয়, প্রকৃতিতে যত কিছু শক্তির প্রকাশ দেখিতেছি, সবই আত্মার শক্তি, প্রকৃতির নয়। তাঁহাকে প্রথম হইতেই জানিতে হয়, সর্বপ্রকার জ্ঞান—সর্বপ্রকার অভিজ্ঞতা আত্মাতেই অন্তর্নিহিত রহিয়াছে, প্রকৃতিতে নাই। সুতরাং কেবল বিচারজনিত ধারণার বলে তাঁহাকে একেবারে সমুদয় প্রাকৃতিক বন্ধন ছিন্ন করিতে হয়। প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সমুদয় পদার্থ ইন্দ্রজালের ন্যায় তাঁহার সম্মুখ হইতে অন্তর্হিত হয়, তিনি স্ব-মহিমায় বিরাজ করিতে চেষ্টা করেন।