শিষ্য হইবার চতুর্থ এবং সর্বশেষ সাধন—নিত্যানিত্য-বিচার। ঈশ্বরই একমাত্র নিত্য বস্তু। সদাসর্বদা মন ঈশ্বরের প্রতি আকৃষ্ট থাকিবে, নিবেদিত থাকিবে। ঈশ্বরই আছেন, আর কিছুই নাই; আর সব কিছু আসে এবং চলিয়া যায়। এই সংসারের জন্য কোনরূপ বাসনাই ভ্রম, কারণ এ সংসার অনিত্য। যতক্ষণ পর্যন্ত না অন্য সব কিছু অনিত্য বলিয়া বোধ হয়, ততক্ষণ একমাত্র ঈশ্বরসম্বন্ধে ক্রমে ক্রমে—মনকে সচেতন করিয়া তুলিতে হইবে।
যিনি শিষ্য হইতে চান, তাঁহাকে এই সকল শর্ত পূর্ণ করিতে হইবে। নচেৎ তিনি প্রকৃত গুরুর সান্নিধ্যে আসিতে পারিবেন না। আর যদি সৌভাগ্যবশতঃ গুরুলাভও হয়, তথাপি গুরু যে আধ্যাত্মিক শক্তি তাঁহার মধ্যে সঞ্চার করিবেন, তাহা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হইতে পারিবেন না। এ-সকল সাধনার মধ্যে কোন আপস চলিবে না। এই শর্তগুলি পূর্ণ করিলে এবং এইরূপ প্রস্তুতি থাকিলে শিষ্যের হৃদয়কমল বিকশিত হইয়া উঠিবে, তখনই মৌমাছি আসিবে। শিষ্য তখন জানিতে পারিবেন যে, গুরু তাঁহার দেহের মধ্যেই, তাঁহার অন্তরের অন্তস্তলেই বিরাজিত ছিলেন। তখনই তিনি বিকশিত হইয়া উঠেন, তখনই তিনি উপলব্ধি করেন। সংসার-সমুদ্র পার হইয়া তিনি জন্মমৃত্যুর অতীত হইয়া যান। এ ভয়ঙ্কর সাগর তিনি পার হইয়াছেন; কোন লাভ বা প্রশংসার কথা না চিন্তা করিয়া করুণাবশতঃ তিনি তখন অপরকেও সংসার-সাগরের পারে যাইতে সাহায্য করেন।২৩
১৩. গুরুর যোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর
স্বামীজী বিশেষ জোরের সঙ্গে বললেনঃ ব্যবসায়িসুলভ হিসেবী মনোভাব ছাড়ো—সামান্য একটি জিনিষের প্রতি যে-আসক্তি আছে, তা ছাড়তে পারলে বুঝব, মুক্তির পথে পা বাড়িয়েছ। আমি তো কোন পতিতা, পাপী বা সাধু দেখিতে পাচ্ছিনে। যাকে পতিতা বলছ, সেও তো মহামায়াই। সন্ন্যাসীরা একবার বা দুবার তাকে ‘মা’ বলে আহ্বান করে, তারপর আবার তাদের ভ্রান্ত ধারণা জন্মায়, তারা বলে, ‘হে অসতী পতিতা নারী, দূরে সরে যাও’। একমুহূর্তেই সকল অজ্ঞানতা দূর হতে পারে—অজ্ঞানতা ধীরে ধীরে দূর হয় বলা মূর্খতামাত্র। বহু গুরু আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়ার পরেও শিষ্য তাঁর প্রতি অনুগত থাকে—দেখা গিয়েছে। রাজপুতানায় দেখেছি, জনৈক ভক্তের গুরু খ্রীষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার পরেও শিষ্য তাঁকে নিয়মিতভাবে পূর্বের মত সাহায্য দিত, সাহায্য বন্ধ করেনি। তোমরা পাশ্চাত্য ধারণা ছাড়। কোন বিশেষ গুরুর উপরে তোমরা যখন তোমাদের সকল বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করেছ, তখন সকল শক্তি দিয়ে তাঁকেই ধরে থাক।
একমাত্র বালকেরাই বলে থাকে যে, বেদান্তের মধ্যে কোন নৈতিকতা নেই। তাদের কথা ঠিকই—কারণ বেদান্ত নৈতিকতার ঊর্ধ্বে। তোমরা সন্ন্যাসী হয়েছ, উচ্চ চিন্ত ও আলোচনা কর।
তোমাদের জোর করে অন্ততঃ একটি বস্তুতে ব্রহ্মবুদ্ধি আনতে হবে। শ্রীরামকৃষ্ণকে ঈশ্বর বলে চিন্তা করা অনেক সহজ। কিন্তু বিপদ হল এই—আমরা মানুষে ঈশ্বরবুদ্ধি আনতে পারি না। ঈশ্বর তো নিরাকার, নিত্য, সর্বত্র বিরাজিত।
তাঁকে সাকার বলে চিন্তা করা মহাপাপ, ঐরূপ চিন্তা করলে ঈশ্বর-নিন্দা করা হয়। কিন্তু সাকার উপাসনার মূলকথা এই যে, ঐ প্রকার উপাসনার মাধ্যমে উপাসক ভগবদ্বিষয়ে ধারণার উৎকর্ষ লাভ করে।২৪
১৪. মন্ত্র ও মন্ত্রচৈতন্য
মন্ত্রবাদের সমর্থকদের বিশ্বাস—কতকগুলি শব্দ গুরু বা শিষ্যপরম্পরায় চলে এসেছে। এই-সকল শব্দের বার বার উচ্চারণে বা জপে একপ্রকার উপলব্ধি হয়। ‘মন্ত্রচৈতন্য’ শব্দের দু-রকম অর্ত করা হয়। এক মতে—মন্ত্র জপ করতে করতে জাপকের সামনে তার ইষ্টদেবতার আবির্ভাব হয়। ‘ইষ্ট’ হচ্ছেন মন্ত্রের বিষয় বা মন্ত্রের দেবতা। আর একটি মত এইঃ যে-গুরুর উপযুক্ত শক্তি নেই, তাঁর কাছে মন্ত্রদীক্ষা নিলে—সেই মন্ত্রে চেতনা সঞ্চার করতে হলে দীক্ষিতকে কতগুলি অনুষ্ঠান২৫ করতে হয়, তখন সেই মন্ত্রজপের ফল পাওয়া যায়। বিভিন্ন মন্ত্রে চেতনা সঞ্চারিত হলে তার বিভিন্ন লক্ষণ দেখা যায়। একটি সাধারণ লক্ষণ হচ্ছে—বহুক্ষণ জপ করলেও জপকারী কোন রকম অস্বস্তি বোধ করে না এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তার মনঃসংযোগ হয়। এ হচ্ছে তান্ত্রিক মন্ত্রের কথা।
বৈদিক যুগ থেকেই মন্ত্র সম্পর্কে এই দুটি মত চলে আসছে। যাস্ক ও অন্যান্যের অভিমত এই—বেদমন্ত্রের অর্থ আছে। কিন্তু প্রাচীন মন্ত্রশাস্ত্রীরা বলেনঃ এগুলির কোন অর্থই নেই। তবে কোন কোন যজ্ঞানুষ্ঠানে এই সকল মন্ত্র বার বার উচ্চারিত হলে এগুলি যজ্ঞকর্তাকে বৈষয়িক সুখ-সমৃদ্ধি অথবা আধ্যাত্মিক জ্ঞান দান করে। উপনিষদের মন্ত্র-আবৃত্তিতে আধ্যাত্মিক জ্ঞানলাভ হয়।
১৫. ঈশ্বর সম্পর্কে ধারণা
প্রকৃতির নিয়ম-বন্ধনের অতীত—সর্বপ্রকারে স্বাধীন স্বতন্ত্র কাহারও সন্ধান লাভ করাই মানুষের অন্তরের আকাঙ্ক্ষা। বেদান্তবাদীরা এরূপ নিত্য শাশ্বত পুরুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন। কিন্তু বৌদ্ধ ও সাংখ্যবাদীরা বিশ্বাস করেন ‘জন্য ঈশ্বর’-এ,—অর্থাৎ যিনি একদা মনুষ্য ছিলেন, তারপর আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন করে ঈশ্বরে পরিণত হয়েছেন। পুরাণসমূহে অবতারবাদের মাধ্যমে এই দুটি মতের সামঞ্জস্য সাধিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘জন্য ঈশ্বর’ তো নিত্য (শাশ্বত) ঈশ্বর ছাড়া অন্য কিছু নন, মায়া দ্বারা তিনি কেবল এই প্রকার রূপ পরিগ্রহ করেছেন। ‘নিত্যঈশ্বর’-এর বিরুদ্ধে সাংখ্যবাদীরা যুক্তি দেনঃ ‘মুক্ত আত্মা কি করে এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করতে পারে?’ মিথ্যা ভিত্তির উপর সাংখ্যবাদীদের এই যুক্তি স্থাপিত। মুক্ত আত্মা তো কারও অধীন নয়, তাকে তো তুমি নির্দেশ দিতে পার না—এই কর বা এই কর না। সে মুক্ত, সে যা-ইচ্ছে করতে পারে। বেদান্তের মতে ‘জন্য-ঈশ্বর’ ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি স্থিতি বা লয় করতে পারেন না।
১৬. ঈশ্বরঃ ব্যক্ত ও অব্যক্ত
যাঁকে তোমরা ব্যক্তিত্বভাবাপন্ন ঈশ্বর বল, আমার ধারণা তিনি এবং নৈর্ব্যক্তিক সত্তা একই-কালে সাকার ও নিরাকার। আমরাও ব্যক্তিত্ব-সম্পন্ন নৈর্ব্যক্তিক সত্তা। কথাটি নিরপেক্ষভাবে ব্যবহার করলে আমরা ‘অব্যক্ত’, আর আপেক্ষিকভাবে ব্যবহার করলে আমরা ‘ব্যক্তি’। তোমরা প্রত্যেকেই বিশ্ব-সত্তা, সকলেই সর্বব্যাপী। শুনলে প্রথমটা মাথা ঘুরে যায়, কিন্তু আমি তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, এ কথা যতখানি সত্য, ঐ কথাও ততখানি সত্য, আত্মা সর্বব্যাপী না হয়ে পারে কি করে? আত্মার দৈর্ঘ্য নেই, প্রস্থ নেই, বেধ নেই—জড়ের কোন ধর্মই আত্মায় নেই। আমরা সবাই যদি আত্মা হই, তা হলে দেশ (space) দ্বারা পরিচ্ছন্ন হতে পারি না, দেশ দেশকেই সীমাবদ্ধ করতে পারে, জড় জড়কে; আমরা যদি শরীরে আবদ্ধ থাকতাম, তাহলে আমাদের জড়বস্তুই হতে হত। শরীর, আত্মা—সব কিছুই জড় হতে। ‘শরীরে বাস করা’, ‘আত্মাকে শরীরে আটকে রাখা’ প্রভৃতি কথাগুলি শুধু সুবিধার জন্য ব্যবহৃত হত, এর অতিরিক্ত এদের কোন অর্থ থাকত না।