আমি এই জীবনে এরূপ ব্যক্তি প্রত্যক্ষ করিয়াছি। বাইবেল প্রভৃতি শাস্ত্র আমি পড়িয়াছি। এগুলি অপূর্ব। কিন্তু পুস্তকে সেই প্রাণবন্ত শক্তির সাক্ষাৎ পাইবেন না, যে-শক্তি মু্হূর্তে জীবন পরিবর্তন করিতে পারে, তাহা শুধু জীবন্মুক্ত মহাপুরুষগণের মধ্যেই দেখিতে পাওয়া যায়; জ্ঞানের উজ্জ্বল বিগ্রহ এই মহাপুরুষগণ মাঝে মাঝে আমাদের মধ্যে আবির্ভূত হন। তাঁহারাই গুরু হইবার উপযুক্ত। তুমি আমি কেবল বৃথা বচনবাগীশ, গুরু বা আচার্য নই; শুধু কথার কোলাহলে জগৎকে বিব্রত করিতেছি, চিন্তাজগতে অশুভ কম্পনের সৃষ্টি করিতেছি। আশা, প্রার্থনা ও সংগ্রামের মধ্য দিয়া আমরা অগ্রসর হই, একদিন আমরা সত্যে উপনীত হইব, তখন আর আমাদের কথা বলিতে হইবে না।
‘গুরুর বয়ঃক্রম ষোড়শবর্ষ; তিনি অশীতিপর বৃদ্ধকে শিক্ষা দিতেছেন। গুরুর শিক্ষাপদ্ধতি নীরবতা আর শিষ্যের সমস্ত সংশয় ছিন্ন হইতেছে।’১৮ ইহাই গুরুর বর্ণনা। ভাবিয়া দেখুন, এইরূপ এক ব্যক্তিকে পাইলে তাঁহার প্রতি আপনার কিরূপ বিশ্বাস ও ভালবাসা হইবে। কারণ তিনি স্বয়ং ভগবান্ অপেক্ষা কিছু কম নন! এ জন্যই খ্রীষ্টের শিষ্যগণ তাঁহাকে ঈশ্বর বলিয়া পূজা করিতেন। শিষ্য গুরুকে সাক্ষাৎ ঈশ্বর বলিয়া পূজা করিবে। যতক্ষণ না মানুষ ভগবানকে সাক্ষাৎভাবে উপলব্ধি করিতেছে, ততক্ষণ সে ভগবানের যতটুকু জানিতে পারে, তাহা এই মানবদেহধারী নরদেবতারূপেই জানিতে পারে। আর অন্য কী ভাবে সে ভগবানকে জানিতে পারে?
এখানে আমেরিকায় একজন ব্যক্তি—খ্রীষ্টজন্মের উনিশ-শত বৎসর পরে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, খ্রীষ্ট যে জাতিতে জন্মিয়াছিলেন, সে সেই য়াহুদীজাতিসম্ভূতও নয়, সে যীশু অথবা তাঁহার পরিবারবর্গকে দেখে নাই। সে বলে, ‘যীশু ছিলেন ভগবান্। যদি বিশ্বাস না কর, তবে নরকে যাইবে।’ আমরা বুঝিতে পারি, যীশুর শিষ্যগণ কিভাবে বিশ্বাস করিতেন, খ্রীষ্ট ভগবান্। তিনি তাঁহাদের গুরু ছিলেন। সুতরাং তাঁহারা যীশুকে অবশ্যই ঈশ্বর বলিয়া বিশ্বাস করিতেন। উনিশ-শত বৎসর পূর্বে আবির্ভূত মানুষটিকে লইয়া এই আমেরিকান কি করিবে? এই যুবকটি আমায় বলিতেছে, যীশুকে আমি বিশ্বাস করি না, অতএব আমাকে নরকে যাইতে হইবে। যীশু সম্বন্ধে সে কি জানে? সে পাগলা-গারদে থাকিবার উপযুক্ত। এরূপ বিশ্বাস চলিবে না। তাহাকে তাহার গুরু খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে।
যীশু আবার জন্মগ্রহণ করিতে পারেন, আপনার নিকট আসিতে পারেন। তখন যদি আপনি তাঁহাকে ভগবান্ বলিয়া পূজা করেন, ভাল কথা। গুরুর আবির্ভাব অবধি আমরা অবশ্যই প্রতীক্ষা করিব এবং গুরুকে ঈশ্বরের ন্যায় পূজা করিতে হইবে। তিনি ঈশ্বর, ঈশ্বর অপেক্ষা কিছু কম নন। গুরুকে লক্ষ্য করিলে দেখিতে পাইবে, ক্রমে তিনি লীন হইয়া যাইতেছেন। পরে কি থাকে? গুরুমূর্তি ভগবানের জন্য আসন ছাড়িয়া দেন। আমাদের নিকট আসিবার জন্য ভগবান্ গুরুর জ্যোতির্ময় মূর্তি ধরিয়া থাকেন। স্থিরভাবে নিরীক্ষণ করিতে থাকিলে এই মূর্তির আবরণ ক্রমশঃ খসিয়া যায়, ভগবান্ প্রকাশিত হন।
‘আমি গুরুকে প্রণাম করি, যিনি ব্রহ্মানন্দের মূর্ত বিগ্রহ, পরমসুখদ ও পরমজ্ঞানের প্রতিমূর্তি, যিনি পবিত্র পূর্ণ অদ্বিতীয় অনন্ত সুখ-দুঃখের অতীত অচিন্ত্য ভাবাতীত ও ত্রিগুণরহিত’।১৯ ইনিই প্রকৃত গুরু। শিষ্য যে তাঁহাকে স্বয়ং ভগবান্ বলিয়া মনে করিবে, তাঁহাকে বিশ্বাস করিবে, শ্রদ্ধা করিবে, এবং সন্দেহাতীত ভাবে অনুসরণ করিবে, তাহাতে আশ্চর্যের কিছু নাই। গুরু-শিষ্যের মধ্যে ইহাই সম্বন্ধ।
মুক্তিলাভের জন্য শিষ্যকে প্রবল আকাঙ্ক্ষা করিতে হইবে—ইহাই পরবর্তী সাধন। ইন্দ্রিয়নিচয় আমাদিগকে কেবল দগ্ধ করে, বাসনা বৃদ্ধি করে—ইহা জানিয়াও পতঙ্গের ন্যায় আমরা অগ্নিশিখায় ঝাঁপাইয়া পড়িতেছি। ‘উপভোগের দ্বারা বাসনা কখনও তৃপ্ত হয় না। ঘৃতাহুতির দ্বারা অগ্নি যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি ভোগের দ্বারা ভোগ বাড়িয়াই চলে।২০ বাসনা দ্বারা বাসনা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ইহা জানিয়াও মানুষ সর্বদাই ইহাতে ঝাঁপাইয়া পড়ে। জন্ম জন্ম ধরিয়া তাহারা ভোগ্য বস্তুর পশ্চাতে ধাবিত হইতেছে এবং ফলে অপরিসীম দুঃখ ভোগ করিতেছে, তথাপি বাসনা ত্যাগ করিতে পারে না। যে-ধর্ম তাহাদিগকে এই ভীষণ বাসনার বন্ধন হইতে মুক্ত করিবে, তাহাকেও তাহারা বাসনা-পরিতৃপ্তির উপায় করিয়া তুলিয়াছে। শরীর ও ইন্দ্রিয়ের বন্ধন এবং বাসনার দাসত্ব হইতে মুক্তিলাভের জন্য তাহারা ক্বচিৎ কখনও ভগবানের নিকট প্রার্থনা করিয়া থাকে। তৎপরিবর্তে তাহারা স্বাস্থ্য ও দীর্ঘজীবনের জন্য প্রার্থনা করে, ‘হে ঈশ্বর! আমার মাথার বেদনা সারাইয়া দাও। আমায় কিছু টাকাকড়ি বা অন্য কিছু দাও।’
দৃষ্টির পরিধি এত সঙ্কীর্ণ, এত নীচু, এত পশুবৎ হইয়া দাঁড়াইয়াছে! কেহই এই দেহের ঊর্ধ্বে কিছু চাহিতেছে না। হায়, কি ভয়ঙ্কর অবনতি! কি ভায়ানক দুর্দশা! এই মাংসপিণ্ড, পাঁচটি ইন্দ্রিয় আর উদর! শিশ্ন ও উদরের সমাবেশ ছাড়া জগৎটা আর কি? কোটি কোটি নরনারীর পানে চাহিয়া দেখ—তাহারা এইজন্যই জীবনধারণ করিয়া আছে। তাহাদের নিকট হইতে এই বস্তু-দুইটি সরাইয়া লও, তাহারা মনে করিবে জীবন শূন্য অর্থহীন ও অসহনীয়। আমরা এইরূপ, আর আমাদের মনও এইরূপ। এই মন সর্বদা ক্ষুধা ও কাম চরিতার্থ করিবার পথ ও উপায় খুঁজিতেছে। সর্বদাই এইরূপ চলিতেছে। দুঃখকষ্টও তেমনি অনন্ত। দেহের এই সকল তৃষ্ণা শুধু ক্ষণিক তৃপ্তি এবং অশেষ দুঃখের কারণ হয়। এ যেন পয়োমুখ বিষকুম্ভের অবস্থা। কিন্তু তথাপি আমরা এগুলির জন্য লালায়িত হই।