আমার গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণ অসুস্থ হইয়া পড়িলে জনৈক ব্রাহ্মণ রোগমুক্তির জন্য তাঁহাকে তাঁহার প্রবল মনঃশক্তি প্রয়োগ করিতে বলিয়াছিল। তাহার মতে—আচার্যদেব যদি দেহের রোগাক্রান্ত অংশটির উপর তাঁহার মন একাগ্র করেন,—তবে অসুখ সারিয়া যাইবে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলিলেন, ‘কি! যে-মন ঈশ্বরকে দিয়াছি, সেই মন এই তুচ্ছ শরীরে নামাইয়া আনিব?’ দেহ এবং রোগের কথা তিনি ভাবিতে চাহিলেন না। তাঁহার মন সর্বদা ঈশ্বরে তন্ময় হইয়া থাকিত। সে-মন সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরে অর্পিত হইয়াছিল। তিনি এই মন অন্য কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করিতে রাজী ছিলেন না।
স্বাস্থ্য, সম্পদ, দীর্ঘজীবন প্রভৃতি তথাকথিত ভাল ভাল জিনিষের জন্য এই আকাঙ্ক্ষা—মায়া বা ভ্রম ভিন্ন আর কিছুই নয়। এগুলি পাইবার জন্য মনোনিবেশ করিলে ভ্রম দৃঢ় করা হয়। ইহজীবনে আমাদের এ-সকল স্বপ্ন ও মায়া আছে, এবং পরলোকে—স্বর্গে যাইয়া আমরা এগুলি আরও বেশী পরিমাণে পাইতে চাই। মায়া বাড়িয়া যায়। মন্দের প্রতিরোধ করিও না; তাহার সম্মুখীন হও। তুমি মন্দ বা অশুভ অপেক্ষা অনেক বড়।
জগতে এই দুঃখ আছে, একজনকে তো তাহা ভোগ করিতে হইবেই। কাহারও অনিষ্ট না করিয়া তুমি কোন কাজ করিতে পার না। আর যখন তুমি পার্থিব শুভ কামনা কর, তখন শুধু আর একটি অশুভই এড়াইয়া যাও। সেই অশুভ অপর কাহাকেও ভোগ করিতে হইবে। মন্দটি সকলেই অন্যের ঘাড়ে চাপাইতে চায়। সাধক বলিবে, ‘জগতের সকল দুঃখ আমার নিকটে আসিতে দাও। আমি এগুলি সহ্য করিব। অপরকে মুক্ত হইতে দাও।’
ক্রুশবিদ্ধ মহামানবকে স্মরণ কর। জয়লাভ করিবার জন্য তিনি অসংখ্য দেবদূত আনিতে পারিতেন। কিন্তু তিনি প্রতিরোধ করিলেন না। যাহারা তাঁহাকে ক্রুশে বিদ্ধ করিল, তাহাদিগকে তিনি করুণা করিলেন। তিনি সকল দুঃখকষ্ট ও অপমান সহ্য করিলেন। সকলের ভার তিনি নিজের স্কন্ধে গ্রহণ করিলেন। ‘তোমরা যাহারা অতিশয় দুঃখ ভারাক্রান্ত, তাহারা আমার নিকটে আইস। আমি তোমাদের দুঃখ দূর করিব এবং শান্তি দিব।’১৬ ইহাই যথার্থ সহনশীলতা। তিনি এই জীবনে কত ঊর্ধ্বে ছিলেন—এত ঊর্ধ্বে যে, আমরা ক্রীতদাসগণ তাহা ধারণাও করিতে পারি না! আমার গালে কেহ চড় মারিলেই আমার হাত সশব্দে আর একটি চড় মারিয়া দেয়! আমি কিরূপে সেই মহিমময় পুরুষের মহত্ত্ব ও চিত্তের প্রশান্তি ধারণা করিতে পারি? তাঁহার মহিমা আমি কি বুঝিব?
কিন্তু আদর্শকে আমি নীচে নামাইয়া আনিব না। আমি অনুভব করি, আমি দেহ; আমি অন্যায়ের প্রতিরোধ করি। আমার মাথা ধরিলে তাহা সারাইবার জন্য সারা পৃথিবী ঘুরিয়া বেড়াই, দুই হাজার শিশি ঔষধ খাই। কেমন করিয়া আমি এ-সকল অপূর্ব চরিত্র বুঝিতে পারিব? আদর্শ আমি দেখিতে পারি—কিন্তু আদর্শের কতটুকু? এই দেহের কোন চেতনা, কোন তুচ্ছ অহং-ভাব, কোন আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ সেই স্তরে পৌঁছিতে পারে না। সর্বদা শুধু চৈতন্যবিষয়ক চিন্তা করিয়া এবং মনকে জড়বস্তুর ঊর্ধ্বে রাখিয়া আমি সেই আদর্শের আভাসমাত্র পাইতে পারি। জড়বস্তুর চিন্তা এবং ইন্দ্রিয়-জগতের রীতিনীতির কোন স্থান সেই আদর্শে নাই। ঐগুলি হইতে মন তুলিয়া আত্মায় সমাহিত কর। তোমার জীবন ও মৃত্যু, সুখ ও দুঃখ, নাম ও যশ সব ভুলিয়া যাও এবং অনুভব কর—তুমি শরীর বা মন নও, তুমি শুদ্ধ আত্মা।
আমি যখন ‘আমি’ বলি, তখন এই চৈতন্য বা আত্মাকেই বুঝি। যখন তুমি নিজের ‘আমি’ সম্বন্ধে চিন্তা কর, তখন চক্ষু মুদ্রিত করিয়া দেখ—কোন্ ছবি ফুটিয়া উঠে। তোমার দেহচিত্র কি মনে জাগিতেছে? অথবা মনের প্রকৃতি? যদি তাই হয়, তবে তুমি এখনও সত্য ‘আমি’কে জানিতে পার নাই। এমন সময় আসিবে, যখন ‘আমি’ বলিতে বলিতে সমগ্র জগৎ—সেই অনন্ত সত্তা উদ্ভাসিত দেখিতে পাইবে। তখন তুমি নিজের সত্য স্বরূপকে দেখিতে পাইবে এবং নিজের অনন্ত সত্তাকে উপলব্ধি করিবে। তুমি চৈতন্যময়, তুমি জড়পদার্থ নও—ইহাই সত্য। ভ্রম বলিয়া একটি অনুভূতি আছে—এক বস্তুকে আর এক বস্তু বলিয়া ভ্রম হয়—জড়কে চৈতন্য এবং চৈতন্যকে জড় বলিয়া মনে হয়। ইহাই প্রচণ্ড ভ্রম। ইহা দূর করিতে হইবে।
গুরুর প্রতি শিষ্যকে শ্রদ্ধাবান্ হইতে হইবে—ইহাই পরবর্তী সাধনা। পাশ্চাত্য গুরু শিষ্যকে শুধু বুদ্ধিগ্রাহ্য শিক্ষা দিয়া থাকেন। গুরুর সহিত শিষ্যের সম্পর্ক জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পর্ক। গুরু আমার নিকটতম ও প্রিয়তম আত্মীয়, তারপর মাতা, তারপর পিতা। গুরুর প্রতিই আমার শ্রদ্ধা সর্বপ্রথমে নিবেদিত। যদি পিতা বলেন, ‘ইহা কর’ এবং গুরু বলেন, ‘ইহা করিও না’—আমি তাহা করি না। গুরু আমার আত্মার মুক্তিসাধন করেন। পিতামাতা আমায় শরীর দিয়াছেন, কিন্তু গুরু আমাকে আত্মার মধ্যে নবজন্ম দান করিয়াছেন।
আমাদের কতকগুলি অদ্ভুত বিশ্বাস আছে। একটি এই—অতি অল্প কয়েকটি অসাধারণ আত্মা আছেন, যাঁহারা নিত্যমুক্ত এবং যাঁহারা জগতের কল্যাণের নিমিত্ত মানবরূপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহারা মুক্তই আছেন; নিজেদের মুক্তির জন্য তাঁহারা গ্রাহ্য করেন না, অপরকে সাহায্য করিতে চান। তাঁহাদের কিছু শিখিবার প্রয়োজন নাই। শৈশব হইতে তাঁহারা সব জানেন। ছয়মাসের শিশু হইয়াও তাঁহারা পরমসত্যের বাণী বলিতে পারেন।
এই মুক্তাত্মাদের উপরেই মনুষ্যজাতির উন্নতি নির্ভর করে। তাঁহারা যেন প্রথম প্রজ্বলিত দীপের ন্যায়—এই দীপটি হইতে অপর দীপগুলি জ্বলিয়া উঠে। ইহা সত্য যে, সকলের অন্তরের আলোক রহিয়াছে, কিন্তু অধিকাংশ ব্যক্তির অন্তরেই ইহা প্রচ্ছন্ন। মহাপুরুষগণ প্রথম হইতেই এই আলোকে ভাস্বর। যাহারা তাঁহাদের সংস্পর্শে আসে, তাহাদের হৃদয়দীপও যেন প্রজ্বলিত হইয়া উঠে। ইহা দ্বারা প্রথম দীপটির কোন ক্ষতি হয় না, প্রথম দীপটি অপর দীপগুলিতে আলোক সঞ্চার করে। কোটি কোটি দীপ প্রজ্বলিত হয়, কিন্তু প্রথম দীপটি পূর্বের মতই অনির্বাণ তেজে জ্বলিতে থাকে। প্রথম দীপটি গুরু। যে দীপটি এই প্রথম দীপের শিখা হইতে প্রজ্বলিত হয়, সে শিষ্য। ক্রমে এই দ্বিতীয় ব্যক্তিও গুরু হন—এই ভাবে চলিতে থাকে। যাঁহাদের আপনারা অবতারপুরুষ বলিয়া থাকেন, সেই মহাপুরুষগণ বিপুল অধ্যাত্মশক্তির আধার। তাঁহারা সাক্ষাৎ শিষ্যদের মধ্যে ঐ শক্তি সঞ্চার করেন এবং শিষ্য-পরম্পরা এক বিরাট অধ্যাত্মশক্তির প্রবাহ প্রবর্তন করেন।