পরদিন যথাকালে বনপথে যাবার সময় গোপাল তার ভাইকে ডাক দিল এবং পূর্বের মত উত্তরও এল বন থেকে। কিন্তু এবার মার কথামত গোপাল তার দাদাকে দেখা দেবার জন্য একান্ত অনুরোধ করল। বলল, ‘গোপাল দাদা, তোমাকে তো কোনদিন আমি দেখিনি। আজ আমাকে দেখা দাও।’
তখন উত্তর শোনা গেল, ‘ভাই, এখন বড় ব্যস্ত আছি। আজ আমি আসতে পারব না।’ কিন্তু গোপাল ছাড়বে না, সে বার বার কাতরভাবে অনুরোধ করতে লাগল। তখন অকস্মাৎ বনের ছায়াচ্ছন্ন প্রদেশ থেকে বেরিয়ে এল বনের রাখাল। পরনে গোপালকের বেশ, মাথায় ছোট্ট মুকুট—তাতে বসানো শিখিপুচ্ছ, হাতে বাঁশের বাঁশী।
দুইটি বালকই তখন মহাখুশী। একসঙ্গে তারা খেলা করল, গাছে উঠল, ফল কুড়াল, ফুল কুড়াল—বনের গোপাল আর দুঃখিনী মায়ের গোপাল—দু-টি ভাই। খেলতে খেলতে পাঠশালার সময় প্রায় উত্তীর্ণ হয়ে এল এবং গোপাল একান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও পাঠশালার পথে চলে গেল।
সেদিন তার পাঠ প্রায় ভুল হয়ে গেছে। সমগ্র অন্তর উৎসুক হয়ে রয়েছে কেবল বনে ফিরে রাখাল দাদার সঙ্গে আবার খেলা করবার প্রবল আকাঙ্ক্ষায়। …
এইভাবে কয়েকমাস সময় কেটে গেল। দিনের পর দিন সন্তানের বিচিত্র কাহিনী শুনতেন মা, আর ভগবানের অপার করুণার কথা চিন্তা করে নিজের দৈন্য বৈধব্য প্রভৃতি সব কিছু ভুলে যেতেন। দুঃখকে মনে মনে গ্রহণ করতেন ভগবানের অনন্ত আশীর্বাদ বলে।
এরপর পাঠশালার গুরুমশায়ের গৃহে একটি শ্রাদ্ধ-অনুষ্ঠানের দিন এল। সে-কালে গ্রাম্য-পাঠশালার পণ্ডিতগণ একাই অনেকগুলি ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতেন। নির্ধারিত বেতন হিসাবেও তাঁরা বিশেষ কিছু গ্রহণ করতেন না। কিন্তু বিশেষ বিশেষ ক্রিয়াকর্ম উপস্থিত হলে ছাত্রেরা নানা উপঢৌকন দিত শিক্ষককে এবং সে-সবের উপর তাঁরা অনেকাংশে নির্ভরও করতেন।
কাজেই গোপালের গুরুমশায়ও ছাত্রদের কাছে অনুষ্ঠান উপলক্ষে উপঢৌকনের জন্য অনুরোধ জানালেন এবং প্রত্যেক ছাত্র সাধ্যমত সে অনুরোধ রক্ষাও করল। কেউ দিল অর্থ, কেউ দিল অন্য কোন দ্রব্য-সামগ্রী। কিন্তু দুঃখিনী বিধবার পুত্র গোপাল! হায়, উপঢৌকনের সামগ্রী সে কোথায় পাবে? তাই অন্য পড়ুয়ারা একটু বিদ্রূপের হাসি হেসে—কে কি দেবে, তার বিবরণ গোপালকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে বেড়াতে লাগল।
সে রাত্রে মনে গভীর দুঃখ নিয়ে গোপাল মাকে সব কথা বলল। বলল—‘গুরুমশায়ের জন্য কিছু দিতেই হবে।’ কিন্তু মায়ের তো কোন সম্বলই নেই, কি দেবেন তিনি?
অবশেষে তিনি স্থির করলেন, যা চিরদিন করে এসেছেন জীবনের সর্বাবস্থায়, আজও তাই করবেন, রাখালরূপী শ্রীকৃষ্ণের উপর নির্ভর করবেন। তাঁর কাছেই চাইবেন, যদি কিছু প্রয়োজন হয়। সুতরাং ছেলেকে বললেন, সে যেন তার বনের রাখাল-দাদার কাছে গুরুমশায়ের জন্য কিছু চেয়ে নেয়।
পরদিন বনের পথে রাখাল-দাদার সঙ্গে যথানিয়মে গোপালের দেখা হল, দুজনে কিছুক্ষণ খেলাধুলাও করল। তারপর বিদায় নেবার কালে গোপাল তার দুঃখের কথা জানাল রাখাল-দাদাকে, অনুরোধ করল গুরুমশায়কে দেবার মত কিছু উপহার সে যেন তাকে দেয়।
রাখাল বলল, ‘ভাই গোপাল, আমি সামান্য বনের রাখাল। মাঠে মাঠে গোরু চরাই। আমার তো টাকা-পয়সা নেই, ভাই। তবে তোমার রাখাল-দাদার উপহারস্বরূপ এই ছোট ক্ষীরের বাটিটি তুমি নাও, এইটি তোমার গুরুমশাকে উপহার দিও।’
গোপালের তখন আনন্দ আর ধরে না। একে তো গুরুমশায়ের জন্য কিছু উপহার হাতে পেয়েই সে খুশী, তার উপর সে-উপহার এসেছে রাখাল-দাদার কাছ থেকে। অতি দ্রুত সে পাঠশালায় চলে গেল। পাঠশালার অন্যান্য ছাত্রেরা তখন সার দিয়ে দাঁড়িয়ে এক এক করে গুরুমশায়ের হাতে তাহাদের উপহার তুলে দিচ্ছে। গোপালও কম্পিতবক্ষে সবার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। ভিন্ন ভিন্ন ছাত্রের হাতে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ভাল ভাল উপহার ছিল, সুতরাং পিতৃহীন দরিদ্র বালকের তুচ্ছ উপহারের দিকে কেউ তাকিয়েও দেখল না।
সে-তাচ্ছিল্যে গোপাল যেন দমে গেল, দুঃখে তার চোখে জল এল। অবশেষে হঠাৎ গুরুমশায়ের চোখ পড়ল তার দিকে। তিনি তখন তার হাত থেকে ক্ষীরের পাত্রটি নিয়ে অন্য একটি বৃহৎ পাত্রে ঢেলে দিলেন। কিন্তু একি! মুহূর্তে সে শূন্যপাত্র আবার ক্ষীরে পূর্ণ হয়ে গেল! আবার ঢাললেন, আবারও পূর্ণ হল! এমনি যতবার তিনি ঢালেন, ততবারই পাত্রটি মুহূর্তে ভরে ওঠে!
উপস্থিত সকলে তো একেবারে স্তম্ভিত। গুরুমশায় তখন দু-হাতে গোপালকে কোলে তুলে নিলেন। বললেন, ‘এ-পাত্র তুই কোথায় পেলি, বাবা?’
গোপাল তখন পণ্ডিতমশায়ের কাছে তার বনের রাখাল-দাদার কাহিনী আনুপূর্বিক বর্ণনা করল। কেমন করে সে তাঁকে প্রতিদিন ডাকে এবং সাড়া পায়; কেমন করে প্রতিদিন দু-জনে তারা খেলা করে এবং কেমন করে ঐ ক্ষীরের ছোট পাত্রটিও রাখাল-দাদার হাত থেকেই সে পেয়েছে।
সব কথা শুনে গুরুমশায় তখনই তার সঙ্গে বনে গিয়ে সেই অদ্ভুত রাখাল-বালককে দেখতে চাইলেন এবং গোপালও মহানন্দে তাঁকে নিয়ে চলল। বনস্থলীতে গিয়ে অন্যদিনের মত আজও সে তার দাদাকে ডাকল, কিন্তু সেদিন কোন উত্তর শোনা গেল না। গোপাল বার বার ডাকতে লাগল, তবু কোন জবাব এল না। তখন অতি করুণ স্বরে গোপাল বলল, ‘রাখাল-দাদা, আজ তুমি আমার ডাকে সাড়া দিচ্ছ না? তুমি উত্তর না দিলে এঁরা যে মনে করবেন, আমি মিথ্যা কথা বলছি।’