ঈশ্বরনিন্দার ভাবটি এসেছে য়াহুদীদের কাছ থেকে; য়াহুদীরা পারসীকদের আনুগত্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। ঈশ্বর বিচারকর্তা ও শাস্তা—এ-ভাবটি মন্দ না হলেও নিম্নস্তরের ও স্থূল। ত্রিভুজের তিনটি কোণঃ প্রেম কিছু চায় না; প্রেমে কোন ভয় নাই; প্রেম সর্বদাই উচ্চতম আদর্শের জন্য।
‘সেই প্রেমময় ভগবান্ যদি বিশ্বভুবন জুড়ে না থাকতেন, তবে কে-ই বা এক মুহূর্ত বাঁচতে পারত, কে-ই বা এক মুহূর্ত ভালবাসতে পারত?’
আমরা অনেকেই দেখতে পাব যে, শুধু কর্ম করতেই আমরা জন্মেছি। ফলাফল ঈশ্বরের হাতে সমর্পণ করব। ভগবানের প্রীতির জন্যই কাজ করা হয়েছে। বিফল হলেও দুঃখ করবার কিছু নাই। ভগবানের প্রীতির জন্যই তো যত কিছু কর্ম।
নারীর মধ্যে মাতৃ-ভাবটি খুব পরিস্ফুট। ঈশ্বরকে তাঁরা সন্তানভাবে উপাসনা করেন; যা কিছু করেন তার জন্য, কিছুই চান না।
ক্যাথলিক এই-সব গভীর তত্ত্বের অনেক কিছুই শেখায়, এবং একটু সংকীর্ণ হলেও অতিশয় ধর্মনিষ্ঠ। আধুনিক সমাজে প্রোটেষ্টাণ্ট মত উদার হলেও অগভীর। সত্য কতখানি মঙ্গল করেছে, তা দ্বারা সত্যের বিচার করা—একটি শিশুকে কোন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মূল্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার মতই অসঙ্গত।
সমাজ হবে প্রগতিশীল। নিয়মকে অতিক্রম করে নিয়মের ঊর্ধ্বে যেতে হবে। প্রকৃতিকে জয় করার প্রয়োজনেই আমরা তাকে স্বীকার করি। ত্যাগের অর্থই হচ্ছে—কেউই ঈশ্বর ও ধন-দেবতার উপাসনা একসঙ্গে করতে পারে না।
তোমাদের বিচার-বুদ্ধি ও প্রেম গভীর কর। তোমাদের হৃদয়-পদ্ম ফুটিয়ে তোল—মৌমাছি আপনিই এসে জুটবে। প্রথমে নিজের উপর বিশ্বাস রাখ,—তারপর ঈশ্বরে বিশ্বাস আসবে। মুষ্টিমেয় শক্তিধর মানুষই পৃথিবী তোলপাড় করে দিতে পারে। চাই পরের জন্য অনুভব করার সহানুভূতিশীল হৃদয়, উদ্ভাবনকারী মস্তিষ্ক, এবং কর্ম করার উপযোগী দৈহিক শক্তি। বুদ্ধ (মনুষ্যেতর) প্রাণিবর্গের জন্যও আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। নিজেকে কর্ম করার যোগ্য যন্ত্র করে তোল। কিন্তু ঈশ্বরই কর্ম করেন, তুমি কর না। একজনের মধ্যেই সমগ্র বিশ্ব রয়েছে। জড়বস্তুর একটি কণার মধ্যেই জগতের সমস্ত শক্তি নিহিত আছে। হৃদয় মস্তিষ্কের যদি বিরোধ দেখ, তবে হৃদয়কেই অনুসরণ কর।
পূর্বে বিধান ছিল প্রতিযোগিতা, আজকের বিধান হচ্ছে সহযোগিতা। আগামীকাল কোন বিধি-বিধানই থাকবে না। ঋষিরা তোমায় সাধুবাদ করুন, অথবা জগৎ তোমায় ধিক্কার দিক্, ভাগ্য-লক্ষ্মী তোমার প্রতি প্রসন্না হোন অথবা দারিদ্র্য ও বস্ত্রহীনতা তোমায় ভ্রুকুটি করুক, একদিন হয়তো বনের লতাপাতা আহার করবে, আবার পরদিনই পঞ্চাশ উপকরণের বিরাট ভোজে অংশ গ্রহণ করবে, ডাইনে বাঁয়ে লক্ষ্য না করে এগিয়ে যাও!১৩
[স্বামীজী তারপর প্রশ্নোত্তরে পওহারী বাবার কথা উল্লেখ করেন—কিভাবে সেই যোগী নিজের বাসনপত্রগুলি নিয়ে চোরের পিছনে ছুটেছিলেন এবং তার পায়ে লুটিয়ে পড়ে বলেছিলেন, ‘প্রভু, আমি জানতুম না যে, তুমি এসেছিলে! দয়া করে বাসনগুলি গ্রহণ কর। এগুলি তোমার! আমি তোমার সন্তান, আমাকে ক্ষমা কর।’ স্বামীজী আরও বলেন, কিভাবে এক বিষধর সাপ সেই যোগীকে দংশন করে এবং সন্ধ্যার দিকে সুস্থ বোধ করে তিনি বলতে থাকেন, ‘আমার প্রিয়তমের কাছ থেকে দূত এসেছিল!’]
১০. বিল্বমঙ্গল
‘ভক্তমাল’ নামক একখানা ভারতীয় গ্রন্থ হইতে এই কাহিনীটি গৃহীত। এক গ্রামে জনৈক ব্রাহ্মণ যুবক বাস করিত। অন্য গ্রামের এক দুশ্চরিত্রা নারীর প্রতি সে প্রণয়াসক্ত হয়। গ্রাম দুইটির মধ্যে একটি বড় নদী ছিল। প্রত্যহ খেয়া-নৌকায় নদী পার হইয়া যুবক তাহার নিকট যাইত। একদিন যুবককে পিতৃশ্রাদ্ধাদির কার্যে নিযুক্ত থাকিতে হয়; এজন্য ঐকান্তিক ব্যাকুলতা সত্ত্বেও সেদিন সে মেয়েটির কাছে যাইতে পারিল না। হিন্দুসমাজের এই অবশ্য করণীয় অনুষ্ঠান তাহাকে সম্পন্ন করিতে হইয়াছিল। যুবক ছটফট করিতে থাকিলেও তাহার কোন উপায় ছিল না। অনুষ্ঠান শেষ করিতে রাত্রি হইয়া গেল।
তখন ভীষণ গর্জন করিয়া ঝড় উঠিয়াছে। বৃষ্টি নামিল, প্রচণ্ড তরঙ্গাঘাতে নদী বিক্ষুব্ধ হইল। নদী পার হওয়া বিপজ্জনক, তথাপি যুবক নদীতীরে উপস্থিত হইল। খেয়াঘাটে নৌকা নাই; এ দুর্যোগে মাঝিরা নদী পার হইতে ভয় পায়। যুবক কিন্তু যাইবার জন্য অস্থির; মেয়েটির প্রেমে সে পাগল; তাহাকে যাইতেই হইবে। একখণ্ড কাঠ ভাসিয়া আসিতেছিল, তাই ধরিয়া সে নদী পার হইল। অপর তীরে পৌঁছিয়া কাষ্ঠখণ্ডটি টানিয়া উপরে উঠাইল এবং প্রণয়িনীর গৃহদ্বারে উপস্থিত হইল। গৃহদ্বার বন্ধ; যুবক দ্বারে করাঘাত করিলেও ঝড়ের প্রচণ্ড শব্দে কেহই তাহা শুনিতে পাইল না। সুতরাং সে গৃহপ্রাচীরের চতুর্দিক্ ঘুরিয়া ঘুরিয়া অবশেষে যাহা দেখিতে পাইল, সেটিকেই প্রাচীর-লম্বিত রজ্জু বলিয়া মনে করিল।
‘অহো! প্রিয়া আমার আরোহণের জন্য রজ্জু রাখিয়া দিয়াছে!’—মনে মনে এই বলিয়া যুবক সযত্নে সেটিকে ধরিল। সেই রজ্জুর সাহায্যে সে প্রাচীরে আরোহণ করিল এবং অপর দিকে পৌঁছিয়া পা ফসকাইয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। একটা শব্দ শুনিয়া গৃহবাসিগণ জাগিয়া উঠিল। ঘরের বাহিরে আসিয়া মেয়েটি যুবককে মূর্ছিত অবস্থায় দেখিতে পাইল এবং তাহার চৈতন্য সম্পাদন করিল। যুবকের দেহ হইতে একটা উৎকট দুর্গন্ধ পাইয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘ব্যাপার কি? তোমার গায়ে এমন দুর্গন্ধ কেন? কি করে আঙিনার ভেতরে এলে?’ যুবক উত্তর করিল, ‘কেন, আমার প্রেমিকা কি প্রাচীরে একটা দড়ি ঝুলিয়ে রাখেনি?’ স্ত্রীলোকটি হাসিয়া বলিল, ‘প্রেমিকা আবার কে? অর্থোপার্জনই আমাদের উদ্দেশ্য। তুমি কি মনে কর, তোমার জন্য আমি দড়ি ঝুলিয়ে রেখেছিলাম? কি উপায়ে তুমি নদী পার হলে? ‘কেন, একটি কাষ্ঠখণ্ড ধরেছিলাম।’ মেয়েটি বলিল, ‘চল, একবার দেখে আসি।’