এক রানীর সম্বন্ধে একটি গল্প আছে। তিনি রাস্তায় রাস্তায় (ভগবৎপ্রেমের বিষয়) প্রচার করিতেন। ইহাতে তাঁহার স্বামী ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহাকে দেশের সর্বত্র অত্যন্ত নির্যাতন করিয়া তাড়া করিতেন। রানী তাঁহার ভগবৎপ্রেম বর্ণনা করিয়া গান গাহিতেন। তাঁহার গানগুলি সর্বত্র গীত হয়। ‘চোখের জলে আমি (প্রেমের অক্ষয়লতা পুষ্ট করিয়াছি)’।৮ ইহাই চরম, মহান্ (লক্ষ্য)। ইহা ব্যতীত আর কি আছে? (লোকে) ইহা চায়, উহা চায়। তাহারা সবাই পাইতে ও সঞ্চয় করিতে চায়। এই জন্যই এত কম লোক (প্রেম) বুঝিতে পারে, এত কম লোক ইহা লাভ করিতে পারে। তাহাদিগকে জাগাও এবং বল। তাহা হইলে তাহারা এ-বিষয়ে আরও কিছু সঙ্কেত পাইবে।
প্রেম স্বয়ং শাশ্বত, অন্তহীন ত্যাগ-স্বরূপ। তোমাকে সবকিছু ছাড়িতে হইবে। কিছুই তোমার অধিকারে রাখা চলিবে না। প্রেম লাভ করিলে তোমার আর কিছুরই প্রয়োজন হইবে না। … ‘চিরকালের জন্য কেবল তুমিই আমার ভালবাসার ধন থাকিও।’ প্রেম ইহাই চায়। ‘আমার প্রেমাস্পদের অধরোষ্ঠের একটি মাত্র চুম্বন! আহা, যে তোমার চুম্বনের সৌভাগ্য লাভ করিয়াছে, তাহার সমস্ত দুঃখ যে চলিয়া গিয়াছে। একটি মাত্র চুম্বনে মানুষ এত সুখী হয় যে, অন্য বস্তুর উপর ভালবাসা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হইয়া যায়। সে শুধু তোমারই স্তুতিতে মগ্ন থাকে, আর একমাত্র তোমাকেই দেখে।’৯ মানবীয় ভালবাসাতেও (দিব্য প্রেমের সত্তা লুকান থাকে)। গভীর প্রেমের প্রথমক্ষণে সমস্ত জগৎ যেন এক সুরে তোমার হৃদয়-বীণার সঙ্গে ঝঙ্কৃত হইয়া উঠে। বিশ্বের প্রত্যেকটি পাখি যেন তোমারই প্রেমের গান গাহিয়া থাকে, প্রতিটি ফুল যেন তোমার জন্যই ফুটিয়া থাকে। চিরন্তন অসীম প্রেম হইতেই (মানবীয়) ভালবাসা উদ্ভূত।
ঈশ্বরপ্রেমিক কোন কিছুকে ভয় করিবেন কেন? দস্যু-তস্করের, দুঃখ-দুর্বিপাকের—এমন কি নিজের জীবনের ভয়ও তাঁহার নাই। … প্রেমিক অনন্ত নরকে যাইতেও প্রস্তুত, কিন্তু উহা কি নরক থাকিবে? স্বর্গ, নরক—এই-সব ধারণা ত্যাগ করিয়া আমাদিগকে উচ্চতর প্রেম আস্বাদন করিতে হইবে। … শত শত লোক প্রেমের অনুসন্ধানে তৎপর, কিন্তু উহা আসিলে ভগবান্ ছাড়া আর সবই অদৃশ্য হইয়া যায়।
অবশেষে প্রেম, প্রেমাস্পদ এবং প্রেমিক এক হইয়া যায়। ইহাই লক্ষ্য। … আত্মা ও মানুষের মধ্যে এবং আত্মা ও ঈশ্বরের মধ্যে পার্থক্য রহিয়াছে কেন? … কেবল এই প্রেম উপভোগ করিবার জন্য। ঈশ্বর নিজেকে ভালবাসিতে চাহিলেন, সেই জন্য তিনি নিজেকে নানা ভাগে বিভক্ত করিলেন। … প্রেমিক বলেন, ‘সৃষ্টির সমগ্র তাৎপর্য ইহাই’। আমরা সকলেই এক। ‘আমি ও আমার পিতা এক।’ এইক্ষণে ঈশ্বরকে ভালবাসিবার জন্য আমি পৃথক্ হইয়াছি। … কোন্টি ভাল—চিনি হওয়া, না চিনি খাওয়া? চিনি হওয়া—তাহাতে আর কী আনন্দ? চিনি খাওয়া—ইহাই হইল প্রেমের অনন্ত উপভোগ।
প্রেমের সমগ্র আদর্শ—(ঈশ্বরকে) আমাদের পিতা, মাতা, সখা, সন্তানভাবে (ভাবিবার প্রণালী—ভক্তিকে দৃঢ় করিবার এবং গভীরতরভাবে তাঁহার সান্নিধ্য লাভ করিবার জন্য)। স্ত্রী-পুরষের মধ্যেই ভালবাসার তীব্র অভিব্যক্তি। ঈশ্বরকে এইভাবেও ভালবাসিতে হইবে। নারী তাহার পিতাকে ভালবাসে,—মাতা, সন্তান এবং বন্ধুকেও ভালবাসে; কিন্তু পিতা, মাতা, সন্তান বা বন্ধুর কাছে সে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করিতে পারে না। কেবল একজনের কাছে তাহার গোপনীয় কিছুই থাকে না। এইরূপ পুরুষের পক্ষেও। … পতি-পত্নীর সম্পর্ক সর্বাঙ্গীণ। এই সম্পর্কে অন্য সব ভালবাসা একীভূত হইয়াছে। পত্নী স্বামীর মধ্যে পিতা মাতা, সন্তান সবই পায়। স্বামীও পত্নীর মধ্যে মাতা, কন্যা প্রভৃতি সবকিছু লাভ করে। স্ত্রী-পুরুষের এই সর্বগ্রাসী পরিপূর্ণ প্রেম ঈশ্বরের দিকে পরিচালিত করিতে হইবে—যে-প্রেম নারী সম্পূর্ণ নির্ভয়ে লজ্জা না করিয়া, রক্তের সম্বন্ধ না মানিয়া তাহার প্রিয়তমকে নিবেদন করে। কোন অন্ধকার নাই। তাহার নিজের নিকট হইতে যেমন গোপন করিবার কিছু নাই, সেইরূপ তাহার প্রেমাস্পদের নিকটেও গোপনীয় বলিতে কিছুই থাকে না। এইরূপ প্রেম (ঈশ্বরের উপর) আসা চাই। এই বিষয়গুলি ধারণা করা অত্যন্ত কঠিন। তোমরা ধীরে ধীরে এই-সব বুঝিতে পারিবে, তখন সমস্ত যৌন ভাবও দূরে চলিয়া যাইবে। ‘তাতল সৈকতে বারিবিন্দুসম’ এই জীবন ও ইহার সকল সম্পর্কগুলি।
তিনি স্রষ্টা ইত্যাদি—এই-সমস্ত ধারণা তো বালকদিগের উপযুক্ত। তিনি আমার প্রিয়, আমার জীবন—ইহাই আমার অন্তরের ধ্বনি হউক। …
‘আমার একমাত্র আশা আছে। লোকে তোমাকে বলে জগতের প্রভু।১০ ভালমন্দ, ছোটবড় সবই তুমি। আমিও তোমার এই জগতের অংশ এবং তুমিও আমার প্রিয়। আমার শরীর, মন, আত্মা তোমারই পূজাবেদীতলে। হে প্রিয়, আমার এই উপহারগুলি প্রত্যাখ্যান করিও না।’
০৯. প্রেমের ধর্ম
[১৮৯৫ খ্রীঃ ১৬ নভেন্বর লণ্ডনে প্রদত্ত ভাষণের অনুলিপি]
অনুভূতির গভীরে উপনীত হতে প্রতীক-উপাসনা এবং অনুষ্ঠানাদির মধ্য দিয়ে যাবার প্রয়োজন মানুষের আছে বলেই ভারতবর্যে আমরা বলে থাকি, ‘কোন ধর্মমতের গণ্ডীর মধ্যে জন্মান ভাল, কিন্তু সেই মত নিয়েই মরা ভাল নয়।’ চারাগাছকে রক্ষা করার জন্য বেড়ার আবশ্যকতা আছে, কিন্তু চারা যখন বৃক্ষে পরিণত হয়, তখন বেড়াই আবার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং প্রাচীন পদ্ধতিগুলি সমালোচনা ও নিন্দা করার কোন প্রয়োজন নেই। আমরা ভুলে যাই যে, ধর্মের ক্রমবিকাশ অবশ্যই থাকবে।