শ্রুতি বলেন, ওঙ্কার—কেবলমাত্র ওঙ্কারই এইরূপ শব্দপ্রতীক। কারণ অ, উ, ম—এই তিনটি অক্ষর একত্রে ‘অউম’ এইরূপে উচ্চারিত হইলে উহাই সর্বপ্রকার শব্দের সাধারণ বাচক হইতে পারে। সমুদয় শব্দের মধ্যে ‘অ’ সর্বাপেক্ষা কম বিশেষভাবাপন্ন। এই কারণেই শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলিয়াছেন, ‘অক্ষরের মধ্যে আমি অকার।’৩৩ আর সমুদয় স্পষ্টোচ্চারিত শব্দই মুখগহ্বরের মধ্যে জিহ্বামূল হইতে আরম্ভ করিয়া ওষ্ঠ পর্যন্ত স্পর্শ করিয়া উচ্চারিত হয়। ‘অ’ কণ্ঠ হইতে উচ্চারিত, ‘ম’ শেষ ওষ্ঠ্য বর্ণ। আর ‘উ’ জিহ্বামূল হইতে যে শক্তি আরম্ভ হইয়া ওষ্ঠে শেষ হয়, সেই শক্তিটি যেন গড়াইয়া যাইতেছে—এই ভাব প্রকাশ করে। প্রকৃতরূপে উচ্চারিত হইলে এই ওঙ্কার সমুদয় শব্দোচ্চারণ ব্যাপারটির সূচক; অন্য কোন শব্দেরই সেই শক্তি নাই; সুতরাং এই শব্দটিই স্ফোটের যোগ্যতম বাচক, আর এই স্ফোটেই ওঙ্কারের প্রকৃত বাচ্য। এবং বাচ্য হইতে বাচক পৃথক্ করা যাইতে পারে না, সুতরাং এই ‘ওঁ’ এবং ‘স্ফোট’ এক ও অভিন্ন। এই জন্য স্ফোটকে বলা হয় ‘নাদব্রহ্ম’, আর যেহেতু এই স্ফোট ব্যক্ত জগতের সূক্ষ্মতর দিক্ বলিয়া ঈশ্বরের নিকটতর এবং ঈশ্বরীয় জ্ঞানের প্রথম প্রকাশ, সেই হেতু ওঙ্কারই ঈশ্বরের প্রকৃত বাচক। আর সেই একমাত্র ‘অখণ্ড সচ্চিদানন্দ’ ব্রহ্মকে যেমন অপূর্ণ জীবাত্মাগণ বিশেষ বিশেষ ভাবে ও বিশেষ বিশেষ গুণযুক্তরূপে চিন্তা করিতে পারে, তেমনি তাঁহার দেহরূপ এই জগৎকেও সাধনের মনোভাব-অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্নরূপে চিন্তা করিতে হইবে।
উপাসকের মনে সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ—এই তিনটি গুণের যখন যেটি প্রবল থাকে, তখন তাহার মনে ঈশ্বর সম্বন্ধে তদনুযায়ী ভাবই উদিত হয়। ইহার ফল এই—একই ব্রহ্ম ভিন্ন ভিন্ন গুণপ্রাধান্যে দৃষ্ট হইবেন, আর সেই এক জগৎই ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রতিভাত হইবে। সর্বাপেক্ষা অল্প বিশেষভাবাপন্ন সার্বভৌম বাচক ওঙ্কারে যেমন বাচ্য ও বাচক ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে সম্বন্ধ, তেমনি এই বাচ্য-বাচকের অবিচ্ছিন্ন সম্বন্ধ ভগবানের ও জগতের বিশেষ বিশেষ খণ্ডভাব সম্বন্ধেও খাটিবে। আর ইহার সবগুলিরই বিশেষ বিশেষ বাচক শব্দ থাকা আবশ্যক। মহাপুরুষদের গভীর আধ্যাত্মিক অনুভূতি হইতে উত্থিত এই বাচক শব্দসমূহ যথাসম্ভব ভগবান্ ও জগতের এই বিশেষ বিশেষ খণ্ডভাব প্রকাশ করে। ওঙ্কার যেমন অখণ্ডব্রহ্মের বাচক, অন্যান্য মন্ত্রগুলিও সেইরূপ সেই পরমপুরুষের খণ্ড-ভাবগুলির বাচক। ঐ সবগুলিই ঈশ্বরধ্যানের ও প্রকৃত জ্ঞানলাভের সহায়ক।
৩২ ‘যথা সৌম্যৈকেন মৃৎপিণ্ডেন সর্বং মৃন্ময়ং বিজ্ঞাতং স্যাৎ ইত্যাদি।–ছান্দোগ্য উপ., ৬।১।৪
৩৩ অক্ষরাণামকারোঽস্মি।–গীতা, ১০।৩৩
০৮. প্রতীক ও প্রতিমা-উপাসনা
এইবার প্রতীকোপাসনা ও প্রতিমাপূজার বিষয় আলোচনা করিব। প্রতীক অর্থে যে- সকল বস্তু ব্রহ্মের পরিবর্তে উপাসনার যোগ্য। প্রতীকে ভগবদুপাসনার অর্থ কি? ভগবান্ রামানুজ বলিয়াছেনঃ ‘ব্রহ্ম নয়, এমন বস্তুতে ব্রহ্মবুদ্ধি করিয়া ব্রহ্মের অনুসন্ধানকে প্রতীকোপাসনা বলে।’৩৪ শঙ্কারাচার্য বলিয়াছেনঃ ‘মনকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করিবে—ইহা আধ্যাত্মিক, আকাশ ব্রহ্ম—ইহা আধিদৈবিক। মন আধ্যাত্মিক প্রতীক, এবং আকাশ বাহ্য প্রতীক—এই উভয়কেই ব্রহ্মস্বরূপে উপাসনা করিতে হইবে। এইরূপ আদিত্যই ব্রহ্ম, ইহাই আদেশ…যিনি নামকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন—ইত্যাদি স্থলে প্রতীকোপাসনা সম্বন্ধে সংশয় হয়।’৩৫ প্রতীক শব্দের অর্থ—বাহিরের দিকে যাওয়া, আর প্রতীকোপাসন-অর্থে ব্রহ্মের পরিবর্তে এমন এক বস্তুর উপাসনা, যাহা একাংশে অথবা অনেকাংশে ব্রহ্মের খুব সন্নিহিত, কিন্তু ব্রহ্ম নয়। শ্রুতিতে বর্ণিত প্রতীকের ন্যায় পুরাণ-তন্ত্রেও বহু প্রতীকের বর্ণনা আছে। সমুদয় পিতৃ-উপাসনা ও দেবোপাসনা এই প্রতীকোপাসনার অন্তর্ভুক্ত করা যাইতে পারে।
এখন কথা এইঃ ঈশ্বরকে—কেবল ঈশ্বরকে উপাসনা করার নামই ভক্তি। দেব, পিতৃ অথবা অন্য কোন উপাসনা ভক্তি-শব্দবাচ্য হইতে পারে না। ভিন্ন ভিন্ন উপাসনা কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত; উহা উপাসককে কেবল কোন প্রকার স্বর্গভোগরূপ বিশেষ ফল প্রদান করে, কিন্তু উহাতে ভক্তির উদয় হয় না—উহা মুক্তিও দিতে পারে না। সুতরাং একটি কথা বিশেষরূপে মনে রাখা আবশ্যক। দার্শনিক দৃষ্টিতে পরব্রহ্ম হইতে জগৎকারণের উচ্চতম ধারণা আর হইতে পারে না; প্রতীকোপাসক কিন্তু অনেক স্থলে এই প্রতীককে ব্রহ্মের আসনে বসাইয়া উহাকে আপন অন্তরাত্মা বা অন্তর্যামিরূপে চিন্তা করেন, এরূপ স্থলে সেই উপাসক সম্পৃর্ণ বিপথে চালিত হন, কারণ প্রকৃত প্রস্তাবে কোন প্রতীকই উপাসকের আত্মা হইতে পারে না। কিন্তু যেখানে ব্রহ্মই উপাস্য, আর প্রতীক কেবল উহার প্রতিনিধিস্বরূপ অথবা উহার উদ্দীপক কারণমাত্র, অর্থাৎ যেখানে প্রতীকের সহায়তায় সর্বব্যাপী ব্রহ্মের উপাসনা করা হয়, প্রতীককে প্রতীকমাত্র না দেখিয়া জগৎকারণরূপে চিন্তা করা হয়, সেখানে এইরূপ উপাসনা বিশেষ উপকারী। শুধু তাই নয়, প্রবর্তকদিগের পক্ষে উহা একেবারে অনিবার্যরূপে প্রয়োজনীয়। সুতরাং যখন কোন দেবতাকে অথবা অন্য প্রাণীকে ঐ দেবতা বা প্রাণী-রূপেই উপাসনা করা হয়, তখন এরূপ উপাসনাকে একটি আনুষ্ঠানিক কর্মমাত্র বলা যাইতে পারে। আর উহা একটি ‘বিদ্যা’ বলিয়া উপাসক ঐ বিশেষ বিদ্যার ফল লাভ করিয়া থাকেন। কিন্তু যখন কোন দেবতা বা অন্য কেহ ব্রহ্মরূপে দৃষ্ট ও উপাসিত হন, তখন উহা সর্বনিয়ন্তা ঈশ্বরের উপাসনার সহিত তুল্য হইয়া পড়ে। ইহা হইতেই বুঝা যায়, অনেক স্থলে শ্রুতি, স্মৃতি—সর্বত্রই কোন দেবতা, মহাপুরুষ বা অন্য কোন অলৌকিক পুরুষের ব্যক্তিগত প্রকৃতি ভুলিয়া গিয়া তাঁহাদিগকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করা হয় কেন। ব্যাখ্যাস্বরূপে অদ্বৈতবাদী বলেন, ‘নামরূপ বাদ দিলে সকল বস্তুই কি ব্রহ্ম নয়?’ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী বলেন, ‘সেই প্রভুই কি সকলের অন্তরাত্মা নন?’ শঙ্কর তাঁহার ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে বলিয়াছেন, ‘আদিত্যাদির উপাসনার ফল ব্রহ্মই দেন, কারণ তিনিই সকলের অধ্যক্ষ। যেমন প্রতিমাদিতে বিষ্ণু-আদি দৃষ্টি আরোপ করিতে হয়, তেমনি প্রতীকেও ব্রহ্মদৃষ্টি আরোপ করিতে হয়, সুতরাং এখানে প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মেরই উপাসনা করা হইতেছে বুঝিতে হইবে।’৩৬