আমাদের বর্তমান প্রকৃতি যেরূপ, তাহাতে আমরা সীমাবদ্ধ; ভগবানকে আমরা মনুষ্য-রূপে দেখিতে বাধ্য। মনে কর, মহিষদের ভগবানকে পূজা করিবার ইচ্ছা হইল—তাহাদের স্বভাব অনুযায়ী তাহারা ভগবানকে একটি বৃহৎ মহিষরূপে দেখিবে। মৎস্য যদি ভগবানের আরাধনা করিতে ইচ্ছা করে, তবে তাহাকে ভাবিতে হইবে, ভগবান্ একটি বৃহৎ মৎস্য। মানুষকেও ভাবিতে হইবে, ভগবান্ মানুষ; আর ঐ-সকল সীমাবদ্ধ বিভিন্ন ধারণা বিকৃত-কল্পনাসম্ভূত নয়। মানুষ, মহিষ, মৎস্য—এগুলি যেন ভিন্ন ভিন্ন পাত্রস্বরূপ, সবগুলি ভগবৎ-সমুদ্রে নিজ নিজ ধারণ-শক্তি ও আকৃতি অনুসারে পূর্ণ হইয়াছে। মানুষে ঐ জল মানুষের আকার ধারণ করিল, মহিষে মহিষের আকার ও মৎস্যে মৎস্যাকার ধারণ করিল। প্রত্যেক পাত্রে সেই এক ঈশ্বর-সমুদ্রের জল রহিয়াছে। নিজ মনের প্রকৃতি ও শক্তি অনুযায়ী যদি কেহ ঈশ্বর সম্বন্ধে কোন ধারণা করে, আমরা তাহাকে দোষ দিতে পারি না। সুতরাং ঈশ্বরকে মানুষরূপেই উপাসনা করা ছাড়া আমাদের আর অন্য কোন পথ নাই।
প্রকার লোক ভগবানকে মানুষরূপে উপাসনা করে না। প্রথম—নরপশুগণ, যাহাদের কোনরূপ ধর্মজ্ঞান নাই; দ্বিতীয়—পরমহংসগণ, যাঁহারা মনুষ্যসুলভ সমুদয় দুর্বলতা অতিক্রম করিয়া মানবপ্রকৃতির সীমা ছাড়াইয়া গিয়াছেন। সমুদয় প্রকৃতিই তাঁহাদের আত্মস্বরূপ হইয়া গিয়াছে। তাঁহারাই কেবল ভগবানকে তাঁহার স্বরূপে উপাসনা করিতে পারেন। অন্য সব বিষয়ে যেমন, এখানেও তেমনি—দুইটি চরম বিপরীত ভাব একরূপ দেখায়। অতিশয় অ-জ্ঞানী ও পরম জ্ঞানী—এ-দুয়ের কেহই উপাসনা করে না; নরপশুগণ অজ্ঞান বলিয়া উপাসনা করে না, জীবন্মুক্ত পুরুষগণ সর্বদা আত্মার মধ্যে পরমাত্মাকে অনুভব করিতেছেন বলিয়া তাঁহাদের আর স্বতন্ত্র উপাসনার প্রয়োজন হয় না। যে-ব্যক্তি এই দুই চূড়ান্তভাবের মধ্যবর্তী, অথচ বলে—আমি ভগবানকে মনুষ্যরূপে উপাসনা করিতে ইচ্ছা করি না, বিশেষ যত্নের সহিত সেই ব্যক্তির দেখাশুনা করা আবশ্যক। কঠোরতর ভাষা প্রয়োগ না করিয়াও বলিতে হয়, সে প্রলাপ বকিতেছে, সে ভুল করিয়াছে; তাহার ধর্ম বিকৃতমস্তিষ্ক ও বুদ্ধিহীন ব্যক্তিগণেরই উপযুক্ত।
ভগবান্ মানুষের দুর্বলতা বুঝেন, এবং মানুষের হিতের জন্যই মানুষরূপে অবতীর্ণ হন।২৯ ‘যখনই ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখনই আমি নিজেকে সৃজন করি। সাধুদের রক্ষা, পাপিগণের দুষ্কৃতিনাশ ও ধর্মসংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করি।’৩০ ‘জগতের ঈশ্বর আমি,—আমার প্রকৃত স্বরূপ না জানিয়া অজ্ঞ ব্যক্তিরা মনুষ্যরূপধারী আমাকে উপহাস করে।’৩১
অবতার সম্বন্ধে গীতায় ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ এই কথা ঘোষণা করিয়াছেন। ভগবান্ শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলিতেন, ‘যখন প্রবল বন্যা আসে, তখন সব ছোট ছোট নদী ও খানা কানায় কানায় ভরিয়া যায়; সেইরূপ যখন অবতার আসেন, তখন আধ্যাত্মিক তরঙ্গ জগৎকে ভাসাইয়া লইয়া যায়, সাধারণ মানুষও তখন হাওয়াতেই ধর্মভাব অনুভব করে।’
২৭ বিবেকচূড়ামণি, ৩৫
২৮ আচার্য মাং বিজানীয়াৎ….। শ্রীমদ্ভাগবত, ১১।১৭।২০
২৯ স্যাৎ পরমেশ্বরস্য অপি ইচ্ছাবশান্মায়াময়ং রূপং সাধকানুগ্রহার্থম্।
—শাঙ্করভাষ্য, বেদান্তসূত্র, ১।১।২০
৩০ যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।
পরিত্রাণায়া সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।। —গীতা, ৪।৭-৮
৩১ অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্। পরং ভাবমজানন্তো মম ভূত মহেশ্বরম্।। —গীতা, ৯।১১
০৭. মন্ত্র
আমরা কিন্তু এখানে মহাপুরুষ বা অবতারগণের কথা বলিতেছি না; এখন আমরা সিদ্ধ গুরুদিগের বিষয় আলোচনা করিব। তাঁহাদিগকে সচরাচর মন্ত্র দ্বারা শিষ্যগণের ভিতর আধ্যাত্মিক জ্ঞানের বীজ বপন করিতে হয়। এই মন্ত্রগুলি কি? ভারতীয় দর্শনের মতে সমুদয় জগৎ নামরূপাত্মক। এই ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ডরূপ মনুষ্যচিত্তে এমন একটি তরঙ্গ থাকিতে পারে না, যাহা নামরূপাত্মক নয়। যদি ইহা সত্য হয় যে, প্রকৃতি সর্বত্র এক নিয়মে গঠিত, তাহা হইলে এই নামরূপাত্মকতা বিরাট ব্রহ্মাণ্ডেরও নিয়ম বলিতে হইবে। ‘যেমন একটি মৃৎপিণ্ডকে জানিলে আর সমস্ত মৃত্তিকাকেই জানিতে পারা যায়,’৩২তেমনি এই ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড বা দেহপিণ্ডকে জানিতে পারিলে বিরাট ব্রহ্মাণ্ডকেও জানিতে পারা যায়। রূপ বস্তুর বাহিরের আবরণ বা খোসা, আর নাম বা ভাব যেন উহার অন্তর্নিহিত শস্য। ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড শরীরই রূপ, আর মন বা অন্তঃকরণই নাম, এবং বাক্শক্তিযুক্ত প্রাণিসমূহে এই নামের সহিত উহাদের বাচকশব্দগুলি নিত্যযুক্তভাবে বর্তমান। অন্যভাষায় বলিতে গেলে ব্যক্তি-মানুষের ভিতরেই ‘ব্যষ্টিমহৎ’ বা চিত্তে এই চিন্তাতরঙ্গগুলি উত্থিত হইয়া প্রথমে সূক্ষ্ম শব্দ বা ভাবরূপ—পরে তদপেক্ষা স্থূলতর আকার ধারণ করে।
বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ডেও ব্রহ্মা, হিরণ্যগর্ভ বা ‘সমষ্টিমহৎ’ প্রথমে নিজেকে নামে, পরে রূপাকারে অর্থাৎ পরিদৃশ্যমান জগদ্রূপে অভিব্যক্ত করেন। এই ব্যক্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎই ‘রূপ’; ইহার পশ্চাতে অনন্ত অব্যক্ত ‘স্ফোট’ রহিয়াছে। ‘স্ফোট’ বলিতে সমুদয় জগতের অভিব্যক্তির কারণ ‘শব্দব্রহ্ম’। সমুদয় নাম বা ভাবের উপাদান-স্বরূপ নিত্য স্ফোটেই সেই শক্তি, যাহা দ্বারা ভগবান্ এই জগৎ সৃষ্টি করেন; শুধু তাই নয়, ভগবান্ প্রথমে নিজেকে স্ফোটরূপে পরিণত করিয়া পরে অপেক্ষাকৃত স্থূল এই পরিদৃশ্যমান জগদ্রূপে বিকশিত করেন। এই স্ফোটের একটিমাত্র বাচক শব্দ আছে—‘ওঁ’। আর কোনরূপ বিশ্লেষণ-বলেই যখন আমরা ভাব হইতে শব্দকে পৃথক্ করিতে পারি না, তখন এই ওঙ্কার ও নিত্য-স্ফোট অবিভাজ্যরূপে বর্তমান। এজন্য শ্রুতি বলেন, সমুদয় নামরূপের উৎস—ওঙ্কার-রূপ এই পবিত্রতম শব্দ হইতে এই স্থূল জগৎ সৃষ্ট হইয়াছে। তবে যদি বলো—শব্দ ও ভাব নিত্যসম্বন্ধ বটে, কিন্তু একটি ভাবের বাচক বিবিধ শব্দ থাকিতে পারে, সুতরাং সমুদয় জগতের অভিব্যক্তির কারণস্বরূপ ভাবের বাচক যে এই একটি বিশেষ শব্দ ওঙ্কার, তাহা মনে করিবার কোন প্রয়োজন নাই। এই আপত্তির উত্তরে আমরা বলি, ওঙ্কারই এইরূপ সর্বভাব-প্রকাশক বাচক শব্দ, আর কোন শব্দ ইহার তুল্য নয়। স্ফোটই সমুদয় ভাবের উপাদান, ইহা কোন একটি বিশেষ ভাব নয়; অর্থাৎ বিভিন্ন ভাবগুলির মধ্যে পরস্পর যে বৈশিষ্ট্য আছে, তাহা যদি দূর করিয়া দেওয়া যায়, তাহা হইলে এই স্ফোটই অবশিষ্ট থাকিবে। প্রত্যেকটি বাচক শব্দ এক-একটি ভাব প্রকাশ করে, অতএব উহা স্ফোটের প্রতীক হইতে পারে না। কারণ স্ফোট সর্বভাবের সমষ্টি। আর কোন বাচক শব্দ দ্বারা অব্যক্ত স্ফোটকে প্রকাশ করিতে হইলে উহা তাহাকে এতদূর বিশিষ্ট করিয়া ফেলে যে, তাহাতে আর সমষ্টি-ভাব থাকে না, উহা একটি বিশেষ ভাবে পরিণত হয়। অতএব স্ফোটকে বুঝাইতে হইলে এমন একটি শব্দ খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে, যাহা দ্বারা স্ফোট খুব অল্প পরিমাণে বিশেষভাবাপন্ন হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে উহার বিশ্বব্যাপী প্রকৃতি প্রায় যথাযথভাবে প্রকাশ করে, তাহাই উহার সর্বাপেক্ষা শুদ্ধ প্রতীক বা বাচক।