জীবনের সর্বতোমুখী চেতনা কোনো একক মানুষের চিন্তা, কর্ম কিংবা আচরণে ধরা দেয় না। এ-যুগেও পরিবেশ কিংবা জীবনসচেতন কোনো মহৎকথাশিল্পী, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, সমাজতত্ত্ববিদ কিংবা রাজনীতিকের রচনায় সমকালীন জীবনের ও ঘটনার সব খবর মেলে না। মনের প্রবণতা অনুসারে তুচ্ছ ঘটনাও কারো কাছে গুরুত্ব পায়, আবার গুরুতর বিষয়ও পায় অবহেলা। তা ছাড়া দৃষ্টি আর বোধেও থাকে ভঙ্গি ও মাত্রাভেদ। জগৎ ও জীবনকে সর্বজনীন দৃষ্টি ও বোধ দিয়ে কেউ প্রত্যক্ষ করতেও পারে না। বিদ্যা-বুদ্ধি, বোধি-প্ৰজ্ঞ, বিশ্বাস-সংস্কার, আদর্শ-নীতিজ্ঞান প্রভৃতি নানাকিছুর প্রভাবে মানুষের দৃষ্টি ও বোধ নিয়ন্ত্রিত। কেউ অনপেক্ষ বা নিরপেক্ষ নয়, সবারই রয়েছে রঙিন চশমা, আপেক্ষিক বোধ ও বিচারপদ্ধতি।
আমাদের আলোচিত পাঁচালি কাব্যগুলো মুখ্যত রাজপুত্র-রাজকন্যার কাহিনী। সেসূত্রে উজির-কোটাল-সওদাগরের কথাও কিছু রয়েছে। ক্বচিৎ মালিনী-পরিচারিকার কথাও মেলে। আর অশুভ প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে উপস্থিত রয়েছে দেও-দৈত্য-রাক্ষস, ক্বচিৎ সাপ-বাঘ-পাখি। কারণ, এ হচ্ছে সামন্তযুগের সাহিত্য। তখনো ব্যক্তিমানুষ সম্পর্কে কৌতুহল জাগে নি! মনোসমীক্ষণরীতি তখনো অজ্ঞাত। স্কুল চেতনায় আকাশচারিতাতেই চরম দার্শনিকতা ও কল্পনা-বিলাসিতা সীমিত। দেবলোক ছেড়ে সবেমাত্ৰ মর্ত্যে নেমেছে মানবকল্পনা ও কৌতুহল। বাহ্য জীকই কৌতুহল জাগার আর কৌতুহল নিবৃত্তির অবলম্বন। গোত্রীয় ঐক্য, আঞ্চলিক সংগতি, ধমীয় একাত্মতা এবং রাষ্ট্ৰীয় চৌহদির ভিত্তিতে সমাজ রচিত এবং জীবন নিয়ন্ত্রিত। প্ৰবল দুরাত্মাই শাসন-শোষণ ও পোষণ-পেষণের মালিক। তখন রাজা-শাসক-সামন্তরূপ মালিক-প্রভুর ঐশ্বৰ্য, সুখ, বিলাস, মান-যশ, প্রভাব, প্ৰতাপ, প্রতিপত্তিই শাসিত জনগণের সুখ-যশ-মান ও ঐশ্বর্যের প্রতীক ও প্রতিভূ। তাই রাজা ও রাজপুত্ৰই সাহিত্যে নায়ক। সে-সমাজে ছিল ছিটেফোঁটা কৃপাভোগী মন্ত্রিপুত্র ও সওদাগর, দুরাত্মা-দুৰ্বত্ত কোটাল আর দর্প ও দাপটপ্রবণ বিলাসী সামন্তমানস। এবং যশ-মানপ্রতাপলিন্দু ভোগ-প্রিয় ছিল সে-জীবন। তাই বাহুবল, মনোবল ও বিলাসবাঞ্ছাই সেজীবনের আদর্শ, সংগ্রামশীলতা ও বিপদের মুখে আত্মপ্রতিষ্ঠাই সোঁ-জীবনের ব্ৰত এবং ভোগই লক্ষ্য। এককথায় সংঘাতময় বিচিত্র দ্বান্দ্ৰিক জীবনের উল্লাসই সাধারণত সামন্তযুগের সাহিত্যে পরিব্যাপ্ত।
সে-কালে সাধারণের কাছে ভবনের বাইরের ভুবন ছিল অজ্ঞাত। স্বল্প চাহিদার অজ্ঞ মানুষের গ্রামীণজীবন ছিল স্বনির্ভরতার প্রতীক। কুয়োর মাছের মতোই সংকীর্ণ পরিসরে তাদের কায়িক জীবন হত আবর্তিত। নানা সূত্রে শোনা যেত মহাসমুদ্রের কল্লোল ও তার তটস্থ দিগন্তপারের পৃথিবীর কথাও। কল্পভ্রমণে মিটিয়ে নিত বিশাল পৃথিবী পরিভ্রমণের সােধ। তাই অলৌকিক অস্বাভাবিক-ভৌতিক-দৈবিক চেতনাই ছিল তাদের সম্বল। ঝঞা-সংকুল সমুদ্রই ছিল দূরযাত্রার একমাত্র পথ। ডাক কিংবা তারবেতারের ব্যবস্থাও ছিল না। তাই স্বপ্ন, ছবি ও পক্ষীর দৌত্যে জগত পৃথিবীর নাম-না–জানা প্রান্তের রাজকন্যার প্রতি প্ৰেম। তাই জাদুতে ও দৈবশক্তিতে আস্থা রাখতেই হয়েছে। দৈত্য-রাক্ষস যেমন হয়েছে অরি, তেমনি কখনো কখনো পশু-পাখি হয়েছে নায়কের সহায়। প্রকৃতির সঙ্গে মননের ও হৃদয়ের যোগ হয়েছে ঘনিষ্ঠ।
সে-যুগে কিছুই সহজে পরিবর্তিত হত না। যান্ত্রিক যানবাহনের অভাবে তখনো পৃথিবীর আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য ঘোচে নি। বিভিন্ন অঞ্চলের ও দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক সম্বন্ধ তখন সহজে গড়ে উঠত না। তাই নতুন ভাব-চিন্তা-কর্ম কিংবা বস্তুর আবিষ্কার ও উপযোগ উদ্ভাবন ছিল মন্থর। জ্ঞান-বিদ্যা-মননেরও এমন বিচিত্র ও বহুধা বিকাশ-বিস্তার হত না। তাই পাঁচশ বছরেও সমাজে আচারে চিন্তায় কিং ব্যবহারসামগ্রীর লক্ষণীয় পরিবর্তন সম্ভব ছিল না। শাস্ত্ৰ-শাসিত জীবনে-সমাজে স্বাধীন চিন্তার অবাধ সুযোগ ছিল না, সমাজানুগত্যও ছিল ব্যক্তির পক্ষে বাধ্যতামূলক। ফলে শাস্ত্রীয় ও সামাজিক শাসনের কঠোরতা সমাজ-চিন্তা ও আচারকে রেখেছিল স্থিতিশীল তথা গতিহীন ও অপরিবর্তিত। এজন্যে কালিক ব্যবধানে সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে পার্থক্য দেখা যেত সামান্য।
যাতায়াতের সহজ ব্যবস্থা ছিল না বলে একই দেশে অভিন্ন শাস্ত্রীয় সমাজের মধ্যেও অঞ্চল-ভেদে সামাজিক-সাংস্কারিক-আচারিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য থাকত। যন্ত্রযানের বদৌলতে এ-যুগে পৃথিবী অখণ্ড, সংহত ও ক্ষুদ্র হয়ে গেছে। পৃথিবীব্যাপী মানুষ পারস্পরিক অনুকৃতির মাধ্যমে অথবা উন্নতদের অনুকৃতির ফলে, ঘরোয়া জীবনযাত্রায় তৈজসে-আসবাবে, আহার্যে-আচারে, অস্ত্রে-বস্ত্রে, প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ও সামাজিক আদব-কায়দায় প্রায় অভিন্ন হয়ে উঠেছে। তা ছাড়া ভাব-চিন্তা-আদর্শে, বিদ্যা-বিজ্ঞানে, কৃৎকৌশলে ও যন্ত্র প্রয়োগের ক্ষেত্রে পৃথিবীর মানুষ আজ স্বাতন্ত্র্য হারিয়েছে।
সে-যুগেও অবশ্য স্বল্পমাত্রার বাণিজ্যিক, পরাক্রান্ত জাতির সাম্রাজ্যিক এবং শাস্ত্রীয় সম্পর্ক বিভিন্ন দূরাঞ্চলের মানুষের সঙ্গে গড়ে উঠত। সে-সূত্রে বিদেশী বিজাতি বিভাষী বিধমীর সাংস্কৃতিক, ভাষিক, প্রশাসনিক ও আচারিক প্রভাব স্বীকার করতেই হত। কিন্তু যন্ত্রবিজ্ঞানের বিকাশ ছিল না বলে সে-প্রভাব এ-কালের পর-প্রভাবের মতো তেমন ত্বরায় প্রকট হয়ে উঠত না-সর্বজনীন বা সর্বব্যাপীও হত না।