স্ফীতকায় অপমান
অক্ষামের বক্ষ হতে রক্ত শুষি করিতেছে পান
লক্ষ মুখ দিয়া, বেদনারে করিতেছে পরিহাস
স্বার্থোদ্ধত অবিচার।…
ওই যে দাড়ায়ে নত শিরে
মূক সবে, স্নান মুখে লেখা শুধু শত শতাব্দীর
বেদনার করুণ কাহিনী, স্কন্ধে যত চাপে ভার
বহি চ’লে মন্দ গতি যতক্ষণ থাকে প্ৰাণ তার–
তারপরে সন্তানেরে দিয়ে যায় বংশ বংশ ধরি
নাহি ভৎসে অদৃষ্টরে; নাহি নিন্দে দেবতারে স্মরি
মানবেরে নাহি দেয় দোষ, নাহি জানে অভিমান
শুধু দুটি অন্ন খুঁটি কোনো মতে কষ্ট-ক্লিষ্ট প্রাণ
রেখে দেয় বাঁচাইয়া।
সাহিত্যও শিল্প–জীবন-শিল্প। জগৎ-পরিবেশে জীবিকা-সম্পূক্ত এবং মনন ও অনুভবপুষ্ট জীবনের উদ্ভাস, প্রতিচ্ছবি কিংবা অনুকৃতিই সাহিত্য। অতএব সাহিত্য হচ্ছে জগৎ ও জীবিকা-সম্পৃক্ত জীবনানুকৃতি। জীবনে যা ঘটে, যা চাওয়ার ও পাওয়ার, যা সম্ভব ও সম্ভাব্য, যা প্ৰাপ্য ও প্রত্যাশার, যা অনভিপ্রেত ও পরিহারযোগ্য, তার সবটাই পাই সাহিত্যে। তাই সুখ-দুঃখ-আনন্দ-যন্ত্রণা, সম্পদ-সমস্যা, স্নেহ-প্ৰীতি-প্ৰেম, ঈর্ষাঅসূয়া-রিরংসা, লোভ-ক্ষোভ-তেজ-তিতিক্ষা, সাফল্য-ব্যর্থতা, রাগ-বিরাগ প্রভৃতি ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া প্রভাবিত জীবনের চিত্রাঙ্কনই সাহিত্যকর্ম। জীবিকা-সম্পৃক্ত জীবনাচরণই তথা ভাব-চিন্তা-কর্মে ও আচরণে জীবনের সার্বক্ষণিক অভিব্যক্তিই সংস্কৃতি। অন্য কথায়, মনুষ্যজীবনের অর্জিত স্বভাবের সার্বিক অভিব্যক্তিই সংস্কৃতি। তবু সূক্ষ্ম, পরিস্রুত ও সুন্দর-শোভন অভিব্যক্তিকেই আমরা বিশেষভাবে সংস্কৃতি বলি। কাজেই সংস্কৃতি ভাবচিন্তা-কর্মে ও আচরণে প্রকটিত জীবনেরই লাবণ্য। এই তাৎপর্যে সাহিত্যও সংস্কৃতিরই প্রসূন। সাহিত্যেও সংস্কৃতিরই প্রকাশ। প্ৰাণধর্মের তাগিদেই জীবন সর্বক্ষণ প্রকাশ ও বিকাশপ্ৰবণ-নানা ভাবি-চিন্তা-কর্মে-আচরণে জীবনের বাস্তব ও মানস অভিব্যক্তি ঘটছে। অর্থাৎ তার সৃষ্ট ভাব-জগৎ, তার আচারিক ব্যবহারিক জীবনাচরণপদ্ধতি এবং তার নির্মিত ও ব্যবহৃত বস্তু-জগৎ তার সংস্কৃতির নিদর্শন। অতএব জীবনধারণের ও উপভোগের প্রয়াসপ্রসূত মানবক্রিয়ামাত্রই সংস্কৃতি। তাই সামাজিক জীবনের আচার-ব্যবহার, রীতিরেওয়াজ, প্ৰথা-প্রতিষ্ঠান, নীতি-আদৰ্শ, উৎসব-পার্বণ থেকে ব্যবহারিক জীবনের ঘরঘাট-হাট-বাট, তৈজস-আসবাব, অশন-বসন-আসন কিংবা মানবজীবনের দারু-চারুকারুশিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত, স্থাপত্য-ভাস্কৰ্য, ইতিহাস-দৰ্শন-গণিত-বিজ্ঞান সবটাই কোনো বিশেষ দেশ-কালের ও গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের সামাজিক, সার্বিক ও সামগ্রিক সংস্কৃতি এবং যুগপৎ সাংস্কৃতিক নিদৰ্শন-যাকে বলা চলে বিশিষ্ট দ্বৈতাদ্বৈত। সবটাই চলমান জীবনে তার অনুভব, মনন ও ব্যবহারিক প্রয়োজনবোধের প্রসূন।
যাহোক, আমাদের সংস্কৃতির কোথাও মর্মে, কোথাও-বা অবয়বে আদিম সংস্কৃতি, লোক-সংস্কৃতি ও অনুকৃত সংস্কৃতির ছাপ দুৰ্লক্ষ্য নয়। ভাব-চিন্তাকৃতির যে-অংশ হিতকর ও গৌরবের তা-ই যেমন ঐতিহ্য বলে খ্যাত, তেমনি জীবনচর্যার যে-অংশ সুন্দরশোভন ও কল্যাণকর তা-ই সংস্কৃতি, বাদবাকি কৃতি বা আচারমাত্র। এ তীেলে যাঁরা মাপেন তাদের কাছে জীবনচর্যার কিংবা জীবনযাত্রার সবটাই সংস্কৃতি নয়। তাঁদের সংজ্ঞায় নগরবিহীন সভ্যতাও নেই। আমাদের ধারণায় সংস্কৃতির উৎকর্ষে সভ্যতার উদ্ভব। সংস্কৃতির বস্তুগত ও মানসসম্মুত অবদানপুষ্ট জীবনপদ্ধতির সার্বিক ও সামগ্রিক উত্তরাধিকারই সভ্যতা।
২
মধ্যযুগের মুসলিমরচিত বাঙলাসাহিত্যে বিধৃত সমাজ-সংস্কৃতির বিভিন্ন নিদর্শন আমরা এ-গ্রন্থে সংগ্রহ ও সংকলন করেছি। বিষয়ানুসারে গুচ্ছবদ্ধ করলে স্থান, কাল ও কবি গুরুত্ব হারাত, তাই সে চেষ্টা করি নি।
কোনো দেশ-কালের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ-সংস্কৃতির পূর্ণাঙ্গ পরিচয় দান অতি বড় জ্ঞানী-মনীষী গবেষকের পক্ষেও হয়তো সম্ভব নয়। দেশে-কালে, বিশ্বাসে-সংস্কারে, আচারে-আচরণে সামাজিক মানুষ বিচিত্ৰভাবে আত্মপ্রকাশ করে। কারণ সমাজ-সদস্য হলেও মানুষের ব্যক্তিক ভাব-চিন্তা-রুচি-আচরণের ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্য কিছুটা থাকেই এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষকে অনুকরণ করার প্রবণতা অন্য মানুষের সাধারণ স্বভাব। এতে অতি মন্থর গতিতে এবং অলক্ষ্যে সামাজিক আচার-আচরণ, প্ৰথা-পদ্ধতি ও প্রতিষ্ঠান বদলায়।
বহুমুখী মানস-শিকড় দিয়ে মানুষ আহরণ করে জীবনরস। তার মন-মননের পরতে পরতে রয়েছে হাজারো বছরের সঞ্চিত নানা সম্পদ। কখন কোন বিশ্বাস, সংস্কার, আদর্শ বা অভিপ্ৰায়ের প্রেরণায় মানুষের কোন ভাব, চিন্তা অভিব্যক্তি পাচ্ছে, তা সহসা বুঝে ওঠা দুঃসাধ্য। তা ছাড়া সমকালের সব পরিবেশ, ঘটনা ও আচার সব মানুষের মনে ছায়াপাত করে না। মানস-গড়ন, রুচি, প্রবণতা, প্রয়োজন-বুদ্ধি প্রভৃতি থেকেই জাগে কৌতুহল ও জিজ্ঞাসা-তাই কেউ ক্রীড়া-জগতে, কেউ বাণিজ্য-জগতে, কেউ রাজনীতির ক্ষেত্রে মানস-বিচরণ করে; কেউ কৃষি-উৎপাদনে, কেউ শিল্প-উৎপাদনে হ্রাস-বৃদ্ধি-বৈচিত্ৰ্য নিয়ে মাথা ঘামায়। কেউ সাহিত্যে, কেউ সঙ্গীতে, কেউ চিত্রকলায়, কেউ নৃত্যকলায়, কেউ সংস্কৃতিতে, কেউ নৃতত্ত্বে, কেউ সমাজতত্ত্বে, কেউ ধনবিদ্যায়, কেউ-বা বিজ্ঞানে, কেউ-বা দর্শনে, কেউ ইতিহাসে, কেউ গণিতে, কেউ জ্যোতির্বিদ্যায়, কেউ জীব-উদ্ভিদবিজ্ঞানে আগ্রহী। এজন্যেই কোনো ভ্রমণবৃত্তান্তে, কোনো জীবনীগ্রন্থে, কোনো ইতিহাসগ্রন্থে কোনো দেশের বিশেষ স্থানের ও কালের জীবনযাত্রার, কর্ম ও নর্ম প্রবাহের, ধন-ধর্ম-আচার-আচরণ-সংস্কৃতির একটা সার্বিক বর্ণনা মেলে না। কেউ ধর্মের কথা, কেউ বাজারাদরের কথা, কেউ খাদ্যবস্তু ও রান্নার কথা, কেউ খেলাধুলার কথা, কেউ তরুলতা-ফুল-ফল-মূলের কথা, কেউ পশু-পাখির বর্ণনা, কেউ উৎসব-পার্বণের কথা, কেউ শিল্প-স্থাপত্য-ভাস্কর্যের বর্ণনা রেখে গেছেন বা রাখেন বটে, কিন্তু দেশকালগত সামষ্টিক তথা সামাজিক জীবনধারার পূর্ণাঙ্গ চিত্র দান কোনো একক জ্ঞানী-মনীষীপর্যটক, ঔপন্যাসিক, কাব্যকর বা ইতিবৃত্তকারের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। আলবেরুনী-আবুল ফজলরা তাই চেষ্টা সত্ত্বেও ব্যর্থ হয়েছেন।