এই যন্ত্র-চর্চা কেবল অগ্নি-অন্ন, আসবাব-তৈজস, অস্ত্ৰ-শস্ত্ৰ, বস্ত্ৰ-বৰ্ম, কাস্তে-কোদাল, জাল-জাহাজ নির্মাণে অবসিত হয় নি, চন্দ্ৰ-সূৰ্য-গ্ৰহ-নক্ষত্র ও জল-বায়ুর গতিবিধি ও মেজাজ-মর্জি জানা-বোঝার প্রবর্তনাও দিয়েছে। এভাবে মানুষ আকাশ ও মাটির এবং এদের মধ্যেকার সমস্ত গুপ্ত ও ব্যক্ত পদার্থকেই কেজো সম্পদে পরিণত করার সাধনায় হয়েছে নিরত।
মানুষের ক্রমবিকাশ ত্বরান্বিত করেছে। যেসব আবিক্রিয়া ও উদ্ভাবন সেসবের মধ্যে মুখ্য হচ্ছে ভাষা, আগুন, টাকা, লিপি, লোহা, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও সম্পদ-প্রতীক বিনিময়-মুদ্রা। মানুষের জীবনপদ্ধতি আর প্রাকৃত রইল না, হল কৃত্রিম ও স্বসৃষ্ট।
কালপ্রবাহে ময়াটি-ক্ল্যান, ফ্রাটি-ট্রাইব, সম্প্রদায়-সমাজ, দেশ-রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে জীবন-জীবিকার প্রত্যক্ষ প্রয়োজনে। সহজে কিংবা সরলভাবে নির্বিঘ্নে কিছুই হয় নি। কোনো কোনো বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে আজও মানুষ ক্ল্যান স্তরেই রয়ে গেছে।
মননের ক্ষেত্রেও অনেক মানুষ আজও সর্বপ্রাণবাদের, জাদু-বিশ্বাসের, টোটেমটেবু তত্ত্বের, প্ৰেত-সংস্কারের ও প্যাগান-বোধের নিগড়ে নিবদ্ধ। এভাবে পাথর-মাটিদূর্ব, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ, কূর্ম-কুমির-মকর-হাঙর-মৎস্য ফুল-ফল-তরুলতা থেকে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র এবং অদৃশ্য অনেক কল্পিত শক্তি মানুষের ভয়-ভরসার কারণরূপে পূজ্য ও আরাধ্য হয়েছে। পরে প্রমূর্ত প্রতিমা হয়ে কেবল মনে হয়, ঘরে-সংসারেও ঠাই পেয়েছে। এ বিচিত্র বিবর্তন-বিকাশ হতে সময় লেগেছে হাজার হাজার বছর। মননশক্তির বিকাশে, যুক্তি-বুদ্ধির ও রুচির উন্মেষে টোটেম পেয়েছে স্রষ্টার ও দেবতার মর্যাদা, সংস্কার উন্নীত হয়েছে শাস্ত্রে, বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ধ্রুব সত্যে। টোটেম-টেবু তত্ত্বের উদ্ভব হয়তো খাদ্য ও নিরাপত্তার অনুকূল ও প্রতিকূল চেতনাপ্রসূত।
প্রচলিত ধর্মের মধ্যে বৈদিক বা ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম নানা কারণে বিশিষ্ট। দুনিয়াল আর আর ধর্ম হচ্ছে ব্যক্তি-প্রবর্তিত ধৰ্ম, আর ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম হচ্ছে বিবর্তিত ধর্ম। সুদীর্ঘকালের পরিসরে লোকহিতকামী বহু জ্ঞানী মনীষীর কালিক অনুভব,-প্রয়োজন-চেতনা, শ্রেয়োবোধ ও মননপ্রসূত তথ্য, তত্ত্ব, নীতি, আদর্শ ও লক্ষ্য-নির্দিষ্ট আচার-আচরণ বুদ্ধি থেকে ক্ৰমবিকাশের ধারায় এর স্বাভাবিক।-উদ্ভব ও প্রসার। তাই এতে মনুষ্য-চেতনার ও আচারের আদিম রূপ যেমন মেলে, মনুষ্য-মননের সূক্ষ্মতম বিকাশ ও উচ্চতম বোধও তেমনি এতে দুর্লভ নয়। টোটেম যুগের কূর্ম-বরাহ-অশ্ব-অশ্বতর, যক্ষ, কুকুর, রক্ষঃ, পেচক, গরুড়, হনুমান, সাপ, মকর, গজ, গরু, মহিষ, বিন্দ্ৰ, অশ্বথ, তুলসী, শিলা প্রভৃতি দেবকল্প কিংবা দৈত্যকল্প জীব-উদ্ভিদ ও পদার্থ যেমন বধ্য কিংবা পূজ্য রয়েছে, রয়েছে। টোটেম কিংবা টেবু হয়ে, তেমনি ঔপনিষদিক তত্ত্বচিন্তা এবং নিরীশ্বর দার্শনিক চেতনাও সমভাবে আদর-কদর পেয়েছে। হিন্দুশাস্ত্ৰে, সংহিতায়-পুরাণে যেসব ইতিবৃত্ত বিধৃত রয়েছে, সেগুলো দিয়েই ভারতীয় মানুষের বুনো-বর্বর-ভাব্যস্তরে ক্রমোন্নয়নধারার ইতিকথা রচনা করা সম্ভব।
খাদ্য-সংগ্রাহক যাযাবর মানুষ, খাদ্যশিকারি যাযাবর মানুষ, পশুপালক যাযাবর মানুষ, কৃষিজীবী অর্ধ-যাযাবর মানুষ, কৃষি-শিল্পজীবী স্থায়ী বস্তির মানুষ, পণ্যবিনিময় স্তরের মানুষ, মুদ্রাবিনিময় স্তরের নাগরিক মানুষও-যে সর্বত্র সমান কুশলী, মননশীল কিংবা উন্নত সামাজিক ও সংস্কৃতিবান মানুষ ছিল, তা নয়–যেমন আজকের পৃথিবীর বুনো কিংবা শহুরে মানুষ আজও সমস্তরের নয়। প্রাকৃতিক প্রতিবেশে দেশ কাল ও মানুষভেদে তারতম্য থেকেই যায়। তবু মানুষের জীবনপ্রয়াস-যে অন্য প্রাণীর মতোই খাদ্যভিত্তিক তা মিথ্যা হয়ে যায় না। খাদ্যের আহরণে, সংরক্ষণে ও সুলভতায় নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাদান প্ৰয়াসেই মানুষের ভাব-চিন্তা-কর্ম নিয়োজিত। এই প্ৰয়াসের মুখ্য ও গৌণ কারণ এবং ফলস্বরূপ এসেছে মানুষের আর আর আনুষঙ্গিক আবিক্রিয়া ও উদ্ভাবন যা ব্যবহারিক, বৈষয়িক কিংবা মানসিক স্বাচ্ছন্দ্য দান করে। অতএব খাদ্য উৎপাদনলক্ষ্যে শ্রম ও হাতিয়ার প্রয়োগই মানুষের সার্বিক উন্নতি ও বিকাশের মূল। খাদ্যসংগ্ৰাহক ও শিকারি মানুষ খাদ্য সংরক্ষণ করতে জানত না বলে উদার ছিল, উদরপূর্তির পর উদৃত্ত খাদ্য অপরকে দিতে দ্বিধা করত না। কিন্তু পশুপালক ও কৃষিজীবী মানুষ সঙ্গত কারণেই সম্পদ-সচেতন ও স্বার্থপর হয়ে ওঠে। তখন থেকেই বৈষম্যবীজ ও শ্রেণীচেতনার অনিৰ্দেশ্য ও নিরুদ্দিষ্ট উন্মেষ।
যেমন মানুষের আঙ্গিক-সাংস্কৃতিক পরিচয় ও শ্রেণীনিরূপণ করেন, সমাজবিজ্ঞানীরা তেমনি মুখ্যত জীবনচর্যার মাপে মানুষের বিকাশধারা বুঝতে চান। নৃবিজ্ঞানীরা গুরুত্ব দেন চোখ-চুল-নাকে, মাথা-চোয়াল-কপালের গড়নে, আর আদিম জীবনাচরণ ও মননধারার নমুনায়। সমাজবিজ্ঞানীরা সমাজবদ্ধ মানুষের সামাজিক সম্পর্ক, আচার-আচরণ, রীতি-নীতি, আদর্শ-উদ্দেশ্য, উৎপাদন-বন্টন, মন-মনন, প্ৰথা-পদ্ধতিপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতির গঠন-বৈচিত্র্যের ও বৈশিষ্ট্যের বিশ্লেষণপ্রবণ। তবু নৃতত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব প্রায় অভিন্ন। কেননা একটা ছেড়ে অন্যটা আচল। বলতে গেলে, এগুলো মানব-পরিচিতির একাধারে তিনটে দিক ও স্তরমাত্র এবং সব কয়টির উদেশ্য হচ্ছে সামষ্টিক জীবনধারায় অভিব্যক্ত জীবনচর্যায় স্বরূপ নিরূপণ।