প্ৰাণী হিসেবে মানুষেরও কিছু সহজাত বুদ্ধি, নিরাপত্তা-প্ৰয়াস, জীবিকা-চেতনা ও জ্ঞাতিত্ববোধ ছিল অর্থাৎ প্রাণিসুলভ একটা জীবনোপায়বোধ ছিলই। কিন্তু তার আঙ্গিক সৌকর্যপ্রসূত অনন্যতা এবং অনন্য মননশক্তি তাকে একান্তই বৃত্তি-প্রবৃত্তি-নির্ভর প্রাণী রাখে নি। তার অনন্যতার কারণ ছয়টি–প্রত্যঙ্গের বিশিষ্টতা, মস্তিষ্কের বিশেষ বিকাশশক্তি, বিশেষ যৌথজীবন-প্রবণতা, বাকশক্তি, হাতিয়ার ব্যবহারের সামৰ্থ্য ও মননশক্তি। আসলে সবটাই তার আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যের উপজাত। ফলে শীঘ্রই সে নিশ্চয়ই অস্পষ্টঅবচেতন মনে আত্মশক্তির অনুভবে আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে প্রকৃতিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তার সমস্ত বিকাশ-বিস্তারের মূলে রয়েছে ঐ আত্মপ্রত্যয়প্রসূত দ্রোহ। তাই মানুষমােত্রই প্রকৃতিদ্রোহী। আঙ্গিক সুষ্ঠুতা ও সৌকর্য তাকে দিয়েছে হাতিয়ার ব্যবহারের প্রবর্তনা। কাজেই হাতিয়ারবিরহী মানুষ কল্পনাতীত। হাতিয়ারবিহীন মনুষ্য-জীবিকা তাই আমাদের ধারণায় অসম্ভব। অতএব মানুষ বলতে সহাতিয়ার মানুষই বোঝায়। ফলে মানুষের ইতিহাস হচ্ছে প্রকৃতি-জিগীষু, যুধ্যমান, জয়শীল, হাতিয়ারস্রষ্টা এবং জীবিকার উৎকর্ষ ও প্রসারকামী মানুষের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, বাধা-বন্ধ ও পতন-অভু্যদয়ে বন্ধুর পথ অতিক্রমণের বহু বিচিত্র দীর্ঘ ইতিকথা। কাজেই শ্রম, হাতিয়ার ও মনন প্রয়োগে প্রকৃতিকে বশ ও দাস করে জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রে উৎকর্ষ ও বিকাশ সাধন এবং আনুষঙ্গিকভাবে ভাব-চিন্তা-কর্ম-সংস্কৃতি ও সমাজের উন্নয়ন ও অগ্রগমন তথা জীবনপ্রবাহে সার্বিক পরিশ্রুতি আনয়নপ্রয়াসই মনুষ্যজীবনচর্যার ইতিবৃত্ত। আগেই বলেছি, নানা কারণে এ কারো পক্ষে হয়েছে সম্ভব, কারো কাছে রয়েছে আজও আয়ত্তাতীত। বিকাশের এক স্তরে মনুষ্য ইতিহাস ও সমস্যা সংহত হয়ে মুখ্যত জীবিকা-সম্পদ-প্রতীক বিনিময়মুদ্রার অধিকারে তারতমাপ্রসূত শ্রেণীসংগ্রামের রূপ নেয়। এবং সে-মুহূর্ত থেকেই জীবিকা অর্জন ও জীবনধারণ পদ্ধতি জটা-জটিল হয়ে ওঠে। অধিকাংশ মানুষের পক্ষে তখন জীবন-জীবিকা দুঃসহ, দুর্বহ, যন্ত্রণাময় হয়ে পড়ে। একালে দুনিয়াব্যাপী সেই যন্ত্রণামুক্তির উপায় উদ্ভাবনে, প্ৰয়াসে, সংগ্রামে, দ্বন্দ্বে-সংঘর্ষে-সংঘাতে মানুষ কখনো মত্ত, কখনো আসক্ত, কখনো-বা পর্যুদস্ত। জয়-পরাজয়ের আবর্তে কখনো আর্ত, কখনো আশ্বস্ত। প্রবহমান জীবনে যন্ত্রণা ও আনন্দ, সমস্যা ও সমাধান, বর্জন ও অর্জন, দ্বন্দ্ব ও মিলন, বিনাশ ও উন্মেষ চিরকাল এমনি দ্বান্দ্বিক সহাবস্থান করবে। চলমান জীবনস্রোতে নতুন দিনে নতুন মানুষের নতুন পথের নতুন বাঁকে নতুন সমস্যা ও সম্পদ, যন্ত্রণা ও আনন্দ থাকবেই। কেননা চলমানতার এসব নিত্য ও চিরন্তন সঙ্গী।
মানুষের ভাব-চিন্তা-কর্মে-আচরণে যা-কিছু অভিব্যক্তি পায়, তার কিছুটা প্ৰাণিসুলভ সহজাত, আর কিছুটা মননলব্ধ তথা অর্জিত। এ দুটোর সংমিশ্রণে অবয়ব পায় মানুষের চরিত্র, অভিব্যক্ত হয় জীবনাচরণ। অনুশীলন-পরিশীলনের স্তরভেদে কোনো বিশেষ স্থানে ও কালে ব্যষ্টি ও সমষ্টির আচার-আচরণে কখনো প্রাণিসুলভ স্কুল-অসংযত স্বভাব প্রবলভাবে প্রকাশ পায়, কখনো-বা অর্জিত আচরণ প্রাধান্য পায়। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই কখনো অবিমিশ্র বা অনপেক্ষ কোনো আচরণ সম্ভব নয়। তাই আজকের সভ্যতম সংস্কৃতিবান মানুষেও আদিম মানুষের আচার-আচরণের ছিটেফোঁটা মেলে—কখনো আদিরূপে, কখনো-বা রূপান্তরে।
বিভিন্ন স্থানে বিচিত্র ব্যবহারিক-বৈষয়িক প্রয়োজনে ও মানসিক কারণে নানা স্থানের নানা গোত্রীয় মানুষের সম্পর্কজাত নানা পারস্পরিক প্রভাবে মানুষের শাস্ত্র, সমাজ, সংস্কার, সংস্কৃতি ও চিন্তা-চেতনা বহুমুখী, বিচিত্রধর্ম ও দুর্লক্ষ্য জটিল হয়ে উঠেছে। কারা কাদের প্রভাবে কী পেয়েছে কিংবা কী হয়েছে, তা আজ নিঃসংশয়ে বলা-বোঝা অসম্ভব। তবু আমাদের জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজতে হয় এবং সন্ধানে, নিদর্শনে, বিশ্লেষণে, প্রমাণে ও অনুমানে যা মেলে, তা দিয়েই মনোময় উত্তর তৈরি করে আমাদের কৌতুহল মিটাই এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের কোনো কোনো মানবিক সমস্যার মূলানুসন্ধানে, কারণ-করণ নিরূপণে ও সমাধানচিন্তায় সে জ্ঞান ও সিদ্ধান্ত কাজে লাগাই।
জগৎ ও জীবনের উদ্ভব সম্বন্ধে প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা যেমন নানা তথ্য উদঘাটন ও তত্ত্ব উদ্ভাবন করে বিভিন্ন পদার্থের ও জীব-উদ্ভিদের উদ্ভব ও বিকাশের নানা স্তরবিন্যাস করেছেন, তেমনি নৃবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীরাও মানুষের ক্রমবিকাশ ও বিস্তারের নানা স্তর আবিষ্কার ও অনুমান করেছেন। সাধারণভাবে বন্য, বর্বর ও ভব্যকালে ও শ্রেণীতে মানুষকে বিভক্ত করে মনুষ্যজীবনপ্রবাহের ক্রমোন্নতি নিরূপণের চেষ্টা হলেও দীর্ঘকাল পরিসরের পরিপ্রেক্ষিতে কালিক স্তর ও হাতিয়ারের উপকরণ ও উপযোগ অনুসারে যুগবিভাগ করার স্বীকৃত রীতি-নীতিও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন হাতিয়ারের উপকরণ অনুসারে হাতিয়ারবিহীন ফল-মূল-পাতাজীবী আদিম মানুষের যুগ, খাদ্য সংগ্রহে কাঠঢ়িল-পাথরখণ্ড ব্যবহারকারী পুরোপোলীয় যুগ বা পুরোনো পাথর-যুগ, অস্ত্ররূপে ঘষামাজা পাথর প্রয়োগকারী নব্যপোলীয় বা নবপাথর যুগ, তামা আবিষ্কারের ও ব্যবহারের তাম্রযুগ, পিত্তল আবিষ্কারের ও ব্যবহারের পিত্তল বা ব্রোঞ্জ-যুগ, লৌহ আবিষ্কারের ও প্রয়োগের লৌহ-যুগ। এর মধ্যেও নানা বস্তুর আবিস্ক্রিয়া কৌশলের উদ্ভাবন এবং বস্তুর ও কৌশলের উপযোগ সৃষ্টিভেদে ও ক্রমবিকাশে নানা উপস্তুর তৈরি হয়েছে। হাতিয়ার তথা যন্ত্র মানুষের আঙ্গিক শক্তির বহুল বিস্তৃতিতে ও সুনিপুণ, সুষ্ঠ, সুপ্রয়োগে অপরিমেয় সহায়তা দিয়েছে। আধুনিক বৈদ্যুতিক-আণবিক যন্ত্র সেই যন্ত্র বা হাতিয়ার আবিষ্কার-উদ্ভাবনের প্রবণতা ও প্ৰয়াসেরই ক্রমপরিণত রূপ।