উপমহাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে অসামান্য পণ্ডিত, বিদ্রোহী, অসাম্প্রদায়িক, যুক্তিবাদী, দার্শনিক, বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব, প্রগতিশীল, মানবতাবাদী, মুক্তবুদ্ধির ও নির্মোহ চিন্তার ধারক ড. আহমদ শরীফকে ধর্মান্ধিরা শাস্ত্র ও প্রথা বিরোধিতার কারণে “মুরতাদ” আখ্যায়িত করেছিলেন। কথা ও কর্মে অবিচল, আটল, দৃঢ় মলোভাবের নাস্তিক সবরকমের প্রথাসংস্কার শৃঙ্খল ছিন্ন করে ১৯৯৫ সনে লিপিবদ্ধ করা “অসিয়তনামা”-র মাধ্যমে মরণোত্তর চক্ষু ও দেহদান করে গেছেন। অসিয়তনামায় উল্লেখ ছিল “চক্ষু শ্রেষ্ঠ প্রত্যঙ্গ, আর রক্ত হচ্ছে প্ৰাণ প্রতীক। কাজেই গোটা অঙ্গ কবরের কীটের খাদ্য হওয়ার চেয়ে মানুষের কাজে লাগাই তো বাঞ্চনীয়।”
পরিশেষে বলতে হয় যে, বর্তমান গ্রন্থটি ১৯৭৭ সনে প্রকাশিত হওয়ার পর প্রথম সংস্করণ বহু বছর পূর্বেই নিঃশেষ হয়ে যায়। আগ্রহী পাঠকদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ও সর্বপরি বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনা করে বর্তমান সংস্করণটি প্রকাশ করা হল। পূর্বের ন্যায় বর্তমান সংস্করণটিও নৃতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস ও সাহিত্যের উৎসুক পাঠকদের মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির স্বরূপ সন্ধানের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে আশা করছি।
বর্তমান সংস্করণটি প্রকাশ করার ব্যাপারে। জনাব মাহমুদ করিম-এর উৎসাহ, এডভোকেট যাহেদ করিম স্বপন-এর উৎসাহ ও সহযোগিতা এবং সময় প্ৰকাশন-এর জনাব ফরিদ আহমেদএর একান্ত আগ্রহের জন্য গ্রন্থটি পাঠকদের কাছে পৌছাতে পেরেছে। তাদের সবাইর কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
নেহাল করিম
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
১৮ অক্টোবর, ২০০০
০১. সমাজ-সংস্কৃতির বিকাশ-বিবর্তন ধারা
এই সৌরজগৎ ও পৃথিবী কত লক্ষ কোটি বছরের পুরোনো তার সঠিক অনুমান সহজ নয়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন। প্ৰায় আট কোটি বছর আগে থেকেই অঙ্গ এবং মস্তিষ্ক একধারায় বিবর্তন শুরু করে। আর অন্তত পাঁচ-ছয় লাখ বছর আগে থেকেই আজকের মানুষের আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যের সূচনা হয়। সেসব জটিল তত্ত্ব সাধারণের পক্ষে জানা-বোঝা সহজ নয়, তাই শুনেও বিশ্বাস-বিস্ময়ের দ্বন্দ্ব ঘোচে না। তবে কিছুটা প্রমাণে এবং অনেকটা অনুমানে আজকের বিদ্বানেরা স্বীকার করেন যে মোটামুটি গত দশ হাজার বছরের বুনো, বর্বর ও ভদ্র মানুষের বিচ্ছিন্ন, কঙ্কালসার ও আনুমানিক একটা আবছা! ইতিহাস খাড়া করা সম্ভব। যদিও আজকের মানুষের পূর্ণাঙ্গ পূর্বপুরুষের উদ্ভব ঘটেছে অন্তত পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ হাজার বছর আগে।
তা ছাড়া বিজ্ঞানীরা গত দশ লক্ষ বছরের প্রাকৃতিক বিবর্তনের তত্ত্বও জ্ঞানগত করেছেন বলে দাবি করেন। বরফ বা তুষার-যুগ হিমবাহ-যুগ ঐ দশ লাখ বছরে অন্তত চারবার এসেছে। ফলে জীব-উদ্ভিদজীবনেও ঘটেছে শ্রেণীগত জন্ম-মৃত্যু-উন্মেষ-বিনাশ। গত দশ হাজার বছরের মানুষের জীবন-জীবিকারীতির ধারণাও আমাদের স্পষ্ট কিংবা নিশ্চিত নয়। তবে গত ছয়-সাত হাজার বছরের ভাঙা-ছেড়া, টুটা-ফাটা জীবন-জীবিকাচিত্র নানা সূত্রে কিছু কিছু মিলেছে, এখনো মিলছে। তাতে বাস্তবের কাছাকাছি একটা সমাজচিত্র তথা রৈখিক নকশা তৈরি করা চলে। মানুষের জীবন, মনন ও জীবিকার আঞ্চলিক বিবর্তনধারা মোটামুটিভাবে জানিবার-বুঝবার জন্যেই এর গুরুত্ব অশেষ।
জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে মানুষের বিকাশ-বিস্তারধারায় তার ভাব-চিন্তা-কর্মের কতখানি তার প্রাণিসুলভ সহজাত বৃত্তি-প্রবৃত্তির প্রসূন, আর কতখানি তার মননলব্ধ তথা অর্জিত ও সৃষ্ট, তা পরখ করে দেখার জন্যেও স্থানিক ও কালিক ব্যবধানে গৌত্রিক স্বাতন্ত্র্য ও বিকাশধারা অনুধাবন করা আবশ্যিক।
মানুষের পুরাতত্ত্বজানতে হলে প্রকৃতিবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীর উদঘাটিত ও অনুমিত তত্ত্বেও আস্থা রেখে, ঐগুলো স্বীকার করে ও ভিত্তি করেই সন্ধানে, বিশ্লেষণে ও সমন্বয়ে এগুতে ও সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে হয়।
নৃবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের জীবনের সাংস্কৃতিক বিকাশ ও মনন-উৎকর্ষজীবিকাপদ্ধতির উপর নির্ভরশীল। জীবিকা-পদ্ধতি আবার প্রাকৃতিক প্রতিবেশের প্রসূন। আমরা জানি, দুনিয়ার সর্বত্র সে-প্রতিবেশ অভিন্ন নয়। উত্তর মেরুর বরফ-ঢাকা এলাকায় এস্কিমোরা যেমন আজও তুষার-যুগ অতিক্রম করতে পারে নি, তেমনি সৃষ্টিশীল কিংবা গ্ৰহণকামীও নয় বলে সভ্যদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আদিম বুনোমানুষও দুর্লভ নয়। আফ্রিকা এবং এশিয়া-য়ূরোপের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যারা ছোট-বড় দ্বীপে বাস করেছে, তারাও উদ্ভাবন-আবিষ্কার-প্ৰয়াসের অভাবে কিংবা খাদ্যাভাব ও জনবৃদ্ধিপ্রসূত প্রয়োজন প্রেরণার অনুপস্থিতির ফলে আদিমানবের তথা পুরোপোলীয় যুগের জীবন-জীবিকা স্তরেই রয়ে গেছে। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ও গোত্রের মানুষ প্রাকৃতিক প্রতিবেশ-নিয়ন্ত্রিত জীবিকাপদ্ধতি-প্রসূত প্রয়োজনানুরূপ সামাজিক রীতি-নীতি, আচার-আচরণবিধি এবং ঐহিক-পারিত্রিক চিন্তা-চেতনার জন্ম দিয়েছে। জীবিকা অর্জন সর্বদা ও সর্বত্র কখনো সহজ, সরল ও সুসাধ্য ছিল না। কেননা অজ্ঞআনাড়ি-অসহায় মানুষ তখন ছিল একান্তই প্রকৃতির আনুকূল্য-নির্ভর। ঝড়-বৃষ্টি-বন্যাশৈত্য-খরা-কম্পন ছাড়াও ছিল অপ্রতিরোধ্য শ্বাপদ-সরীসৃপ আর নিদানবিহীন লঘুগুরু নানা রোগ। গা-পা যেমন ছিল নিরাবরণ, মন-মেজাজও তেমনি ছিল আত্মপ্রত্যয়বিহীন। এমন মানুষ ভয়-বিস্ময়-কল্পনাপ্রবণ হয়, আর বিশ্বাস-ভরসা রাখে ও বরাভয় খোজে অদৃশ্য অরিমিত্র দেবশক্তিতে। তার চাওয়া-পাওয়ার অসঙ্গতির ও ব্যৰ্থতার এবং অপ্রত্যাশিত প্ৰাপ্তির কিংবা বিকলতার অভিজ্ঞতা থেকেই এই অদৃশ্য শক্তির অস্তিত্বের ও প্রভাবের ধারণা অর্জন করে সে। তখন থেকেই তার জীবনজীবিকা ইহ-পরলোকে প্রসারিত। স্বায়ত্ত নয় বলেই জীবন-জীবিকার নিরাপত্তার ও স্বাচ্ছন্দ্য-সাচ্ছল্যের কামনা তাকে দৈবাশ্রিত হতে বাধ্য করেছে।