এ সূত্রে একটা কথা উল্লেখ্য যে, আর্যরা ‘ঋক’বেদের কতকাংশ সঙ্গে করে বিজেতা হিসেবে ইরান থেকে ভারতে প্ৰবেশ করে। ইরানে জাতিদ্বন্দ্বে এরা ছিল দেশত্যাগী। আর্যরা ছিল প্রাকৃতিশক্তির হোতা ও পশুপালক এবং সে-কারণে অর্ধ-যাযাবর। ইষ্টফল বাঞ্ছা করে তারা ইন্দ্র, বরুণ, সূর্য প্রভৃতি প্রাকৃতশক্তির উদ্দেশে যাতবেদের (অগ্নির) মাধ্যমে যজ্ঞ হোম করত। এ স্তরে পশুপালনই ছিল তাদের মুখ্য জীবিকা। তখনো তাদের মধ্যে দেবপূজা চালু ছিল না। গোধনই তাদের প্রধান ধন। ক্রমে সংখ্যাগুরু দেশী লোকের প্রভাবে তাদের মধ্যে দেশী জন্মান্তরবাদ, কর্মবাদ, ধ্যান, মন্দির-উপাসনা, মূর্তিপূজা, বৃক্ষ-পশু-পাখি ও নারীদেবতা পূজা চালু হল, সে-সঙ্গে এল নানা ব্ৰত-পূজাপার্বণ এবং লৌকিক ও স্থানিক বিশ্বাস সংস্কার। এভাবেই বৈদিক জীবন-চেতনা ও জগৎ-ভাবনা ক্ৰমে দৈশিক দেহতত্ত্বে ও পরলোকতত্ত্বে প্রভাবিত হয় এবং দৈশিক সাধনাতত্ত্বও গ্রহণ করে তারা। ফলে দেশী সাংখ্য, যোগ ও তন্ত্র ব্ৰাহ্মণ্য মতের, শাস্ত্রের ও সাধনার অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে ওঠে, এমনকি ব্ৰাহ্মণ্য তথা আর্যতত্ত্বচিন্তার চরমবিকাশপ্রতীক উপনিষদও পুর্ব-ভারতের অনার্য-মননে ঋদ্ধ বলে কারো কারো ধারণা। আর্যবর্তী ব্ৰহ্মাবর্ত তথা উত্তরাপথ-বহির্ভূত বাংলায় আর্যধর্ম-সংস্কৃতি প্রবেশ করে অনেক পরে এবং তা জৈন-বৌদ্ধ প্ৰাবল্যের ফলে গণ-মানবে কখনো স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি। তাই বাঙলাদেশে ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম সেন আমলেও পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। এ কারণে বাঙলায় আমরা গীতা-স্মৃতি-সংহিতার পাশে দেশজ লৌকিক দেবতার প্রাধান্যও দেখতে পাই। দুই বিরুদ্ধ মত ও সংস্কৃতির পুরাণ মাধ্যমে আপসের ফলে গড়ে উঠেছে বাংলার ব্ৰাহ্মণ্যবাদী পঞ্চোপাসক হিন্দুসমাজ। এতে আর্যভাগ নগণ্য, অনার্য লক্ষণ প্রধান ও প্রবল। মুসলিম-সমাজেও ছিল স্থানিক ও লৌকিক বিশ্বাস-আচারের প্রবল প্রভাব। উনিশ শতকের ওহাবি-ফরায়েজি আন্দোলনের ফলে লৌকিক ইসলাম আজ বাহ্যত প্ৰায় অবলুপ্ত।
১৮
মধ্যযুগের সাহিত্যে যথার্থ কিংবা পূর্ণাঙ্গ সমকালীন সমাজচিত্র মেলে না। মুখ্যত বৰ্ণিত বিষয় ও বক্তব্যের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক না হলে কিছু বর্ণনা করা সম্ভব হয় না। তা ছাড়া সেযুগের সাহিত্যের বিষয় ছিল প্রাচীনকালের তথা অতীতের দেব-দৈত্য-নর কিংবা রাজাবাদশাহ-সামন্ত-সর্দার। আজকালকার গল্প-উপন্যাস-নাটক-প্রবন্ধের মতো সমকালের ও স্বস্থানের জগৎ-জীবন-জীবিকা, সমাজ-সংস্কৃতি, সমস্যা-সম্পদ কিংবা আনন্দ-যন্ত্রণা সে-যুগের লিখিয়েদের রচনার বিষয় ছিল না; তাই সমাজ ও সংস্কৃতির চিত্র সেখানে দুর্লভ। ক্বচিৎকবির অনবধানতায়-অজ্ঞতায়-কল্পনার দৈন্যে সমকালীন প্রতিবেশ ক্ষণিকের জন্যে উকি মেরেছে মাত্র। তাই আমাদের লোকায়ত জীবনে, লোকাচারে, লোক-সংস্কারে, বিশ্বাসে, প্ৰথা-পদ্ধতি-অনুষ্ঠানে যে আদিম লোক-বিশ্বাস-সংস্কার, আচার-রীতি-রেওয়াজ অবিকৃত কিংবা রূপান্তরে আজও রয়ে গেছে, সে-তথ্য আমরা লিখিত সাহিত্যে পাইনে, পাই লোক-সাহিত্যে, লোক-আচারে ও গ্রামীণ উৎসবে-পার্বণ-অনুষ্ঠানে নানা আচার ও রীতিপদ্ধতির মধ্যে। আল্পনায়, লোকনৃত্যে, পার্বণিক লোক-সঙ্গীতে-যেমন গাজনে, গম্ভীরায় লোকবাদ্যে; যেমন-একতারায়-দোতরায়-শিঙ্গায়-বাঁশিতে, ভেঁপুতে, মন্দিরায়খঞ্জনীতে ও ঢাকে-ঢোলে, আঁতুড়ঘরের আচারে, ষষ্ঠীপূজায়, সাধভক্ষণে, গায়েহলুদে, পানিভারণে কিংবা কলাগাছ-ঘট-আত্মসার, ধানে-দূর্বায়-হলুদে-দীপে-ধূপে-ধূনায়-তোলোয়াইতে (অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার মাথা তেলসিক্ত করা-অভ্যর্থনা আপ্যায়ন ও বরণ করার জন্যে), মারোয়া সাজানোর আচারে, দুধ-মাছ-তত্ত্বে, তুক-তাক-জাদু-উচাটনে, বসুমতীপূজায়, কুমারীর বীজ বপনে, পানি মাঙনে ও নানা কৃষি ও বুননসংক্রান্ত ব্ৰতে, শক্তিপ্রতীক কাল্পনিক পিরপূজায়, বুনো হিংস্র জীবপূজায়, মহামারীর দেবতাপূজায় এবং প্রতিবেশানুকূল খেলাধূলায় আদি অস্ট্রিক-মঙ্গোলের অবিকশিত বুনোসমাজের ধ্যান-ধারণা ও আচার-সংস্কারের রেশ রয়ে গেছে-সেগুলোর কিছু কিছু আজও আমাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলের আরণ্য-মানবে ভিন্নাকারে দেখা যায় এবং অন্য দেশের বিভিন্ন আদিম বুনোমানুষের সংস্কারে সেগুলোর জড় মেলে। বিভিন্ন মাটিফে’ বিন্যাস বিশ্লেষণ হলে আচারে ও তাৎপর্যে সাদৃশ্য যাচাই করা সহজ হবে।