১৬
অদৃষ্টবাদী কুসংস্কারপ্রবণ সমাজে নজুম-গণক দৈবজ্ঞ-দরবেশের কদর ছিল। দান-সদকায় ‘বলা’-বালাই এড়ানোর সহজ পন্থা ছিল সবারই প্রিয়। ফাতেহাখানি-কুলখানি-জেয়াফতমেজবানি যোগে ভোজ দিলে মৃতব্যক্তির পাপমোচন হয়-এ আদিম মানবিক ধারণা শাস্ত্রীয় প্রশ্রয়ে আজও প্রবল এবং মৃতের আত্মার সদগতির জন্যে বুনো-বর্বর-ভাব্য নির্বিশেষে মানুষ চিরকালই দান-পান-ভোজন অনুষ্ঠান আবশ্যিক বলে জানে ও মানে।
নিরক্ষর দরিদ্ররা তো বটেই, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যেও ফুল ও বাগানের আদর-কদর ছিল বলে মনে হয় না। কেননা আজকের দিনেও গাঁয়ে ফুল বা ফুলের বাগান দুৰ্লক্ষ্য। তবু সাহিত্যে ফুলের নাম করতে হয় বলেই প্রথা সিদ্ধ উপায়ে কবিগণ কিছু ফুলের নাম করতেন; মাধবী, মালতী, চম্পা, নাগেশ্বর, জাতী, যুখী, লবঙ্গ, কেতকী, বক, ভূমিকেশর, টগর, ভূরাজ, গোলাপ ইত্যাদি।
আমাদের দেশে দরিদ্র গৃহস্থঘরে তৈজস–হাঁড়া-সরা-পাতিল-বাসন-কর্দা-কর্তি (পানপত্র) সবটাই ছিল কুমারের তৈরি মাটির। নারকেলের মালা ও ঝিনুক ব্যবহৃত হত চামচরূপে। কিন্তু সাহিত্যগ্রন্থে এসব মেলে না। কারণ সাহিত্যে সবকিছু কৃত্রিম এবং আদর্শায়িত রূপে চিত্রিত হওয়াই ছিল নিয়ম। তা ছাড়া সে-যুগে সাহিত্যের বিষয় ছিল দেবতা ও রাজা-বাদশার কাহিনী। কাজেই গরিবঘরের তৈজস-আসবাবের কথা সেখানে মেলে না। হর-পাৰ্বতী, ফুল্লরা, হরিহোড়ের মতো কোনো কোনো দরিদ্রের কিছু খবর মেলে বটে, কিন্তু তা পূর্ণচিত্র দেয় না। Manrique ও অন্যান্য পর্যটকের বিবরণ থেকে দরিদ্রের ভাঙা ঘরে সম্পদের মধ্যে ছেঁড়া কাঁথা-মাদুর-চাটাই ও মাটির হাঁড়া-সরা-ঘড়ার এবং জীর্ণ-ছিন্ন বস্ত্রের কথামাত্র ক্বচিৎ মেলে।
বিভিন্ন ব্যঞ্জন রান্না ছাড়াও বাঙালির পিঠা সাধারণত গুড়, চালের গুড়ো, তেল, ঘি, দুধ যোগেই তৈরি হত। তাল, কলা, নারিকেল, খেজুর-রস প্রভৃতিও কোনো কোনোটাতে মিশ্রিত হত। এ ছাড়া চালভাজা, খই, দই, চিড়া, মুড়ি-মোয়া-বাতাসা, মিছরি প্রভৃতি সুপ্রাচীন। দুধের রূপান্তরে দই, মাখন, ঘোল, ঘি, সন্দেশ, পায়েস, রসগোল্লা প্রভৃতি মিষ্টান্ন তৈরিতে এদের কৃতিত্ত্ব গৌরবের।
বাদ্যযন্ত্রের নামেও দেখি প্রাচীনতা ও গতানুগতিকতা। ঢাক-ঢোল, ধামা, পিনাক, সারিন্দা, পাখোয়াজ, দোহরিমোহরি, চঙ্গ বাঁশি, ভরী, মৃদঙ্গ, ঝাঁঝরা, করতাল, কর্নাল, ভেউর, রবার, বেণু, সিঙ্গা, কাড়া, কবিলাস, ডম্বর, মন্দিরা, তাম্বুরা, জঙ্গলী, শঙ্খ, দুমদূমি, নাকাড়া, দমা, মঞ্জীর, সানাই, বীণা, দোনা, তবল, ভূষঙ্গ, কাস, ভাঙ্গরি ইত্যাদি।
তেমনি যুদ্ধাস্ত্রগুলোও সেই রামায়ণ-মহাভারত যুগের। নতুন অস্ত্রের তথা কবির সমকালীন অন্ত্রের নাম মেলে না। শল্য, শূল, গদা, মুষল, মুদগর, ন্যারোচ, নালিকা, অসি, খঞ্জর, বিভিন্ন ধনুৰ্বাণ–অগ্নি, সিংহ, সৰ্প, চন্দ্র, অর্ধচন্দ্র, গজ, বরুণ, মেঘবাণ ইত্যাদি। এগুলো মন্ত্রপূত হলে অমোঘ হয়। যুদ্ধবাহন–অশ্ব, গজ, রথ । যুদ্ধে বাদ্যও প্রয়োজন।
১৭
অস্ট্রিক-মঙ্গোলীয় বাঙালির কোম-সমাজের রীতি-নীতির কিছু কিছু রূপান্তরে আজও বিদ্যমান। সাংখ্য-যোগ-তন্ত্র-দেহতত্ত্বাদি তাদের মানস বিকাশের সাক্ষ্য। জড়বাদসুলভ বিশ্বাস-সংস্কার ও প্রাকৃত শক্তির পূজাও তাদের মধ্যে চালু ছিল। নারী-বৃক্ষ-পশু ও পাখি দেবতা, দেহচর্যা, জন্মান্তরে আস্থা, ঘট ও পাথর প্রতীকে দেবপূজা তাদের মধ্যে চালু ছিল। বৰ্ণাশ্রম ছিল না, বৃত্তিভাগ ছিল। নিরক্ষর সমাজে বৃত্তিগত সংস্কৃতি ছিল, সমাজে নৈতিক-চেতনা তেমন দৃঢ়ভিত্তিক ছিল না। নিষাদ-কিরাত সমাজে কৈবর্ত-শুঁড়ি-চণ্ডালহাড়ি-ডোম-তাঁতি-কামার-কুমার-নাপিত-চাষি-ওঝা-চিকিৎসক প্রভৃতি বৃত্তিই ছিল প্রধান।
মৌৰ্য আমলে জৈন-বৌদ্ধ মতের সঙ্গে উত্তর-ভারতীয় শাস্ত্ৰ-সমাজ-শাসন-ভাষা-সভ্যতাসংস্কৃতি গ্ৰহণ করতে থাকে। এদেশীয়রা। সে-সময়েও জৈন-বৌদ্ধ সমাজে বর্ণবিন্যাস ছিল না। ব্ৰাহ্মণ্য গুপ্ত ও শশাঙ্কের আমলে বর্ণবিন্যাস শুরু হয় এবং সেন আমলে বৌদ্ধ বিলুপ্তির ফলে তা পূর্ণতা পায়। বৃহদ্ধর্ম পুরাণোক্ত অস্পৃশ্যতদুষ্ট ছত্ৰিশ জাতি এভাবেই বিন্যস্ত হয়। উত্তর-ভারত থেকে সাগ্রিক যজ্ঞিক ব্ৰাহ্মণ আনয়ন গুপ্ত আমলেই শুরু হয়, তবু সেনেরা নতুন একদল ব্ৰাহ্মণ আনয়ন করে এখানে গীতা-স্মৃতির প্রভাব প্ৰবল করার চেষ্টা করেন। বিভিন্ন ধরনের পূজাপাৰ্বণ ও শাস্ত্ৰসম্পৃক্ত আনন্দ-উৎসব চালু হয়। জাতকর্ম, ষষ্ঠী, অনুপ্রাশন, চুড়াকরণ, শালাকর্ম, অশৌচ, শ্ৰাদ্ধ তিথি নক্ষত্রে উপবাসাদি ব্ৰত পালন; ধর্ম-সম্পৃক্ত শাবরোৎসব, কামমহোৎসব, হোলি, নৃত্য-গীত-কথকতার অনুষ্ঠান; বিবাহাদি সামাজিক উৎসব প্রভৃতি ছিল। জুয়া, মদ, বেশ্যা–এ তিনে লোকের আসক্তি ছিল, এবং পার্বণিক উৎসবে সামাজিকভাবেই উপভোগ করা হত এসব।
হিউ এনৎ সাঙের সময়ে সমতটের লোক ছিল শ্রমসহিষ্ণু, তাম্রলিপ্তিবাসীরা ছিল দৃঢ় ও সাহসী, চঞ্চল ও ব্যস্তবাগীশ এবং কর্ণসুবর্ণবাসীরা ছিল সৎ ও অমায়িক। ক্ষেমেন্দ্র তাঁর দশোপদেশ” কাব্যে বাঙালি ছাত্রদের ক্ষীণকায়, উগ্র ও মারামারিপ্রবণ বলে উল্লেখ করেছেন। বিজ্ঞানেশ্বর ও পরবর্তীকালের অনেক পর্যটক বাঙালিকে কুদুলে বলে জানতেন। বাৎস্যায়ন ও বৃহস্পতির মতে রাজপুরীতে ও উচ্চবিত্তের অভিজাতদের ঘরে নারীরা ব্যভিচার ও দুনীতিপরায়ণা ছিল। নারীর শাড়ি ও পুরুষের খাটো ধুতি পরার রেওয়াজ ছিল। সাধারণ লাকে কায়িক শ্রমকালে পরত। গামছা-কর্পট। নারী বা পুরুষের উর্ধ্বােঙ্গ কৃচিৎ ওড়নাচাদরাবৃত থাকত। চৌলি-কঁচুলির আটপৌরে ব্যবহার নিম্নবর্ণ ও নিম্নবিত্তের মেয়েদের মধ্যে ছিল না। অলঙ্কারে নারী-পুরুষে প্ৰভেদ ছিল সামান্য। বিত্তভেদে অলঙ্কার হত তালপাতার, শঙ্খের, পিতলের, কাচের, রুপার, সোনার ও মণিমুক্তার। অঙ্গুরী, কুণ্ডল, হার, কেয়ূর, বলয়, মেখলা, মল প্রভৃতি বহুলব্যবহৃত অলঙ্কার। বাঙালি নারী-পুরুষের কোনো শিরোভূষণ ছিল না। ব্ৰাহ্মণেরা ও ভিক্ষুরা কাঠের খড়ম পারত, পদস্থ সৈনিকরা চামড়ার জুতা ব্যবহার করত, ছাতা ছিল পাতার ও কাপড়ের, বিজনী ছিল তালপাতার, বীশের ও বেতের। সিন্দূর, কুমকুম, চন্দন, আলতা প্রভৃতি ছিল প্রসাধনদ্রব্য। বীণা, বাঁশি (বিভিন্ন ধরনের), মৃদঙ্গ, ঢাকা, ঢোল, করতাল, ডম্বুরু, কাণ্ড (কাড়া), কাহল প্রভৃতি ছিল মুখ্য বাদ্যযন্ত্র। মন্দিরে দেবদাসীরা ও বেশ্যারা এবং হাড়ি-ডোমেরা গাইয়ে-বাজিয়েনাচিয়ে ছিল। ভেলা-নীেকা-গরু-টানা শকট ছিল যানবাহন। এ ছাড়া বড়লোকের বাহন ছিল ঘোড়া, গাধা ও হাতি। ধান, ইক্ষু, কলাই, নারিকেল, সুপারি, আম, কঁঠাল, কলা, লেবু, পান প্রভৃতিই প্রধান ফল ও ফসল ছিল। এদেশেও ক্ষৌম (শণের সূতার তৈরি), দুকুল ও সূতী কাপড় তৈরি হত। রঙ ও নকশার ব্যবহারও ছিল। সাধারণের গাৰ্হস্থ্যজীবনে প্রয়োজনীয় দারু-কারু ও চারুশিল্প এবং মূর্তিশিল্পের শিল্পী ছিল অবশ্যই দেশী লোক। খাজা, মোয়া (মোদক), নাডু, খাড়, পিঠা, ফেনি (বাতাস), কদমা, দুধশাকব (পায়েস), ক্ষীরসা, দই, শিখারিনী (ঘি দই গুড় আদা দিয়ে তৈরি—সুকুমার সেন) প্রভৃতি ছিল মিষ্টান্ন। জাড়ি, ভান্তী, হাঁড়ি, তেলাবনী (তেলোন) প্রভৃতি ছিল মৃৎপাত্র। অবশ্য শাস্ত্ৰ, শিক্ষা, বিত্ত ও বৃত্তিভেদে খাদ্য, আসবাব-তৈজস-পোশাক-পরিচ্ছদ, ঘরদের প্রভৃতি সব ব্যাপারেই পার্থক্য ও বৈচিত্র্য ছিল। আমরা কেবল সাধারণ-রূপের কথাই বললাম।