চলৎ কাষ্ঠং গলৎ কুড্যুমুত্তানতৃণ সঞ্চয়ম
গঞ্জ পদাথি মণ্ডুকাকীর্ণং জীর্ণং গৃহং মম।
-কাঠ খসে পড়ছে, দেয়াল গলে পড়ছে, চালের তৃণ জড়ো হয়ে গেছে। আমার জীর্ণ ঘর কেঁচো-সন্ধানী বেড়ে আকীর্ণ।
বস্ত্রেরও অভাব ছিল। শীতের রাতে বস্ত্ৰহীনার করুণ দুর্দশার চিত্রও রয়েছে :
ধূমৈরশ্রম নিপাতয় দহ শিখয়া দহন মলিনয়াঙ্গারৈঃ
জাগরায়িষ্যতি দুর্গত গৃহিনী তাং তদপি শিশিরনিশি।
[৩০৪নং আৰ্যসপ্তশতী : কবি গোবর্ধন আচাৰ্য]
–ধোঁয়ায় চোখে পানি ঝরে, দহনে দেহ উক্তপ্ত (দগ্ধ) হয়, অঙ্গারে দেহবর্ণ মলিন হয়, তবু দুৰ্গতি গৃহিণী সারা শীতরাত্র (হে অগ্নি) তোমাকে জ্বালিয়ে রাখে।
গায়ে তখনো শাসন-শোষণ-পীড়ন-পেষণ ছিল। প্রবলের প্রতাপ, দুর্জনের দৌরাত্ম্য, দুর্বলকে সেকালেও পিষ্ট ও ক্লিষ্ট করত:
প্রতি দিবস ক্ষীণ দশস্তবৈষ বসনাঞ্চলোহত্যিকর কৃষ্টঃ
নিজনায়কমতি কৃপণং কথয়তি কুগ্ৰাম ইব বিরলঃ
[৩৭১ সং আৰ্যসপ্তশতী]
–বারবার হস্ত-ধৃত হয়ে দিনে দিনে ক্ষীণ দশা প্ৰাপ্ত তোমার সুতোবিরল বস্ত্রাঞ্চল,–অতি করভারে পীড়িত জনবিরল কুগ্রামের মতো (এই সত্যই) নির্দেশ করে যে তোমার নিজপতি অতিকৃপণ।
বোঝা যাচ্ছে শোষণের করভারে পীড়িত গ্রামবাসী গাঁ ছেড়ে পালিয়ে যেত। ভিক্ষাবৃত্তিও ছিল (৪৯২), অরাজকতা ছিল (২৭), অত্যাচার-অবিচার-নিষ্ঠুরতাও ছিল (৩১৫ আর্যসপ্তশতী)।
কবি-পণ্ডিতদের কাম্য জীবন :
১. গোষ্ঠীবন্ধঃ সরস কবিভিৰ্বাচি বৈদৰ্ভরীতির্বাসো
গঙ্গা পরিসর ভুবি স্নিগ্ধাভোগ্য বিভূতি।
সৎসুমেহঃ সদসি কবিতাচার্যকং ভুভুজাং মে
ভক্তির্লক্ষ্মী পতিচারণয়োরস্তু জন্মান্তরেহপি।
(ধোয়ী)
বঙ্গানুবাদ :
সহৃদয় কবিদের সঙ্গে সৌহার্দ্য, বৈদর্ভী রীতিতে কাব্য রচনা, গঙ্গাতীরভূমিতে বাস, ধনৈশ্বৰ্য আত্মীয়-স্বজনের ভোগে লাগা, সজনের সহিত মৈত্রী, রাজসভায় আচাৰ্য কবির সম্মান এবং লক্ষ্মীপতির চরণ কমলে ভক্তি যেন আমার জন্মান্তরেও হয়।
(সুকুমার সেন প্ৰ. বা. বা, পৃ. ২৭)
২. আদর্শমানুষের সংজ্ঞা এরূপ :
মাতোবাসীৎ পরস্ত্রীভবতি পরাধনে ন স্পৃহা যস্য পুংসো
মিথ্যাবাদী ন ষঃ স্যান্ন পিবতি মদিরাং প্রাণিনো যো ন হন্যাৎ।
মর্যাদাভঙ্গভীরুঃ সকরুণ হৃদয়স্ত্যক্ত সর্বাভিমানো
ধর্মাত্মা তে স এষ প্রভবতি ভগবন পাদ পূজাং বিধূধাতুম
(রামচন্দ্ৰ কবিভারতী : ভক্তিশতক)
-সুকুমার সেন: প্ৰা. বা. বা. পৃ. ৪১
-পরস্ত্রী যার কাছে মাতৃসম, যে পুরুষ পরিধানে নিস্পৃহ, যে মিথ্যাবাদী, মদ্যপায়ী, প্ৰাণহন্তা নয়; যে মানীর মান ভঙ্গে ভীত, যে করুণাহিদয়, যে নিরাভিমান–সে মহাত্মাই ভগবানের পূজার অধিকার পায়।
১৪
আদব-লোহাজ-তবিয়তেই সংস্কৃতির মুখ্য প্রকাশ। কবি আলাউলের তোহফায় মুসলিম আচরণ” বিধির উল্লেখ আছে। অন্যত্র তেমন কিছু মেলে না। পিতামাতা, পির ও গুরুজনদের কদমবুসি করা, মান্য ও গুরুজনদের চোখে চোখ রেখে কথা না বলা, গুরুজনদের সুমুখ থেকে উঠে আসতে পিছু হঠে আসা, লাঠি হাতে বা জুতো পায়ে গুরুজনদের সামনে না যাওয়া, তাদের সামনে তামাক না খাওয়া, উচ্চাসনে বা সুমুখ সারিতে না বসা, বাম হাত দেয়া-নেয়া না করা, গুরুজন কিংবা মান্যজনকে কিছু দিতে বা তার থেকে কিছু নিতে হলে জোড়হাতে নতশিরে দেয়া-নেয়া করা, তাদের সঙ্গে উচ্চকণ্ঠে বা রূঢ় কষ্ঠে কথা না বলা, পথে তাদের আগে না চলা, মজলিশে বা ঘরে মান্যজনের নেতৃত্বে একসঙ্গে খাওয়া শুরু ও শেষ করা, মান্যজনের দেহের স্পর্শ বঁচিয়ে চলা, বৈঠকে বা সারিতে বা মজলিশে দুজনের মধ্যদিয়ে চলতে হলে দুই বাহু প্রসারিত করে দেহ বাকিয়ে (রুকুহুর মতো) চলা, বয়োজ্যেষ্ঠদের নাম ধরে না ডাকা, বয়স্ক কনিষ্ঠদেরও সন্তানের নাম করে ‘অমুকের বাপ বা মা’ বলে ডাকা, বাসনে অল্প অল্প করে খাদ্যবস্তু নিয়ে ছোট ছোট গ্রাসে খাওয়া এবং ঠোঁট বন্ধ করে চিবানো, পা দেখিয়ে বা ছড়িয়ে না বসা, মান্য ও বয়োজ্যেষ্ঠকে সালাম দিয়ে সম্ভাষণ করা প্রভৃতি ছিল সার্বক্ষণিক সাধারণ আদব-কায়দার অঙ্গ। গায়ে অধিকাংশ লোক ছিল দরিদ্র ও অশিক্ষিত, তাই এসব অমান্য করবার মতো উদ্ধত দ্রোহী ছিল বিরল।
১৫
নবজাতককে, খৎনায় কিংবা কানফোড়নে ছেলেমেয়েকে, বিবাহে নব দম্পতিকে ও নতুন কুটুম্বকে নজর, শিকলি ও উপহার দেওয়াও ছিল রেওয়াজ। নাপিত-ধোপামোল্লা-মুয়াজ্জিন-ওস্তাদ-ভৃত্যু-গােলাম-বাদী প্রভৃত্ত্বিও এসব অনুষ্ঠান উপলক্ষে বকশিশ পেত। সমাজে নাপিতের ভূমিকা ছিল বহু ও বিচিত্র। এরা প্রতিঘরের পরিজনই যেন ছিল। উৎসবে-অনুষ্ঠানে তারা ছিল অপরিহার্য। ধনী ও অভিজাতদের দু-দশ ঘর গোলাম-বাঁদী থাকত।
সাধারণের ঘরবাড়ি হত মাটির ও বাঁশের। গরিবের দোচালা, সাধারণের চৌচালা এবং উচ্চমাধ্যবিত্তের আটচালা ঘরও থাকত। গরিবের ঘর-কুটির, মধ্যবিত্তের বাড়ি-ভবন, ধনীর অট্টালিকা, রাজার প্রাসাদ-মহল। বাড়ি হত সাধারণত চক-মিলানো। চট্টগ্রামের মুসলমানেরা ঘরের প্রবেশকক্ষকে ‘হাতিনা’, মধ্যকক্ষকে ‘পিঁড়া’ ও পেছনের শেষ কক্ষকে ‘আওলা’ বলে। পিঁড়া’র উল্লেখ বৃন্দাবন দাসের চৈতন্য ভাগবতেও মেলে।
গাঁয়ের মানুষের একবা একাধিক (ঈর্ষা-অসূয়াজাত দলাদলির কারণে অথবা আশরাফ-আতরাফ ভেদে) ‘মাহালত’ বা সমাজ থাকত। একজন প্ৰধান সমাজপতি, সর্দার বা মাতব্বরের নেতৃত্বে প্রতি গোষ্ঠী-নেতার সহযোগে সামাজিক, পাবণিক, আনুষ্ঠানিক কাজ এবং মৃতের সৎকারাদি, জেয়াফত-বিবাহাদি ও দ্বন্দ্ব-বিবাদাদির সালিশ-ইনসাফা-মীমাংসা হত।