সাধারণভাবে সৈয়দ, শেখ, তুর্কি, মুঘল, পাঠান প্রভৃতি বিদেশাগত মুসলমানরা অভিজাতশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। শিক্ষিতদের মধ্যে কাজি, মোল্লা, শাস্ত্ৰবিৎ আলিম, সুফিসাধক, ফকির প্রভৃতি সমাজে মর্যাদাবান ও সম্মানিত ছিলেন। শিয়া-সুন্নি এই দুই মুখ্যভাগেও নানা উপসম্প্রদায় এখনকার মতোই ছিল। শিয়ারা আঠারো শতকে মুশির্দাবাদ-ঢাকা প্রভৃতি শাসনকেন্দ্রে প্রবল হয়। সুন্নিদের মধ্যে হানাফি, সাফি, আহমদি ও হাম্বলি-মাযহাব বা সম্প্রদায় ছিল। হানাফিরা ছিল সংখ্যাগুরু, অন্যদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। তেমনি সুফিদেরও ছিল বিভিন্ন গুরুপন্থি খান্দান–চিশতিয়া, সুহরাওয়াদীয়া, নক্সবন্দিয়া, কাদেরিয়া, মাদারিয়া প্রভৃতি। গুরুবাদে বা পিরবাদে শরিয়ৎপস্থিদের অবিচল আস্থা ছিল।
বৃত্তি ও বর্ণভেদে হিন্দুসমাজ
রায়গুণাকর ভারতচন্দ্ৰ বৰ্ণিত বিবরণ :
ব্ৰাহ্মণ মণ্ডলে দেখে বেদ অধ্যয়ন
ব্যাকরণ অভিধান স্মৃতি দরশন।
ঘরে ঘরে দেবালয় শঙ্খ ঘণ্টারব
শিবপূজা চণ্ডীপাঠ যজ্ঞ মহোৎসব।
বৈদ্য দেখে নাড়ী ধরি কহে ব্যাধি ভেদ
চিকিৎসা করএ পড়ে কাব্য আয়ুৰ্বেদ।
কায়স্থ বিবিধ জাতি দেখে রোজগারী
বেনে মণি গন্ধ সোনা কাঁসারী-শাঁখারী।
গোয়ালা তামুলী তিলি তাঁতি মালাকার
নাপিত বারুই কুরী কামার কুমার।
আগরী প্রভৃতি আর নাগরী যতেক
যুগী-চাষী, ধোপা-চাষী কৈবর্ত অনেক।
সেকরা ছুতার সূরী ধোপা জেলে গুড়ী
চাঁড়াল বাগদী হাড়ী ডোম মুচি শুঁড়ী।
কুরমী কোরঙ্গা পোদ কপালী তেয়র
কেলি কলু ব্যাধ বেদে মালী বাজিকর।
বাইজী পটুয়া কান কসবী যতেক
ভাবক ভক্তিরা ভাঁড় নর্তক অনেক।
এমনি ছত্ৰিশ জাতের এ বৃত্তি-বেসাতের লোক নিয়ে ছিল হিন্দুসমাজ।
প্রাচীনকালে হিন্দুদের মধ্যে সেলাই-করা কাপড়-জামা পরার রেওয়াজ ছিল না বলেই ‘কাটিয়া কাপড় জোড়ে’ রূপে দরজির পরিচয় দেয়া হয়েছে। এমনি লবণনির্মাতা মুলুঙ্গী, পান উৎপাদক বারুই, পালকিবাহক কাহার, সূত্রধর, কুমার, ঘরামি, কলু, বাজিকর, গায়েন, নট, বেদে উত্যাদি।
মন্থর হলেও মুসলিমসমাজ বিদ্যা ও ধন-মান যোগে বিবর্তন বা পরিবর্তনশীল ছিল। এ-সূত্রে স্মর্তব্য-‘গত বছর জোলা ছিলাম, এবার শেখ হয়েছি, ফসল ভালো হলে আগামী বছর সৈয়দ হব।’
অথবা :
আগে ছিল উল্লা-তুল্লা পরে হৈল মামুদ
পিছনের নাম আগে নিয়া এখন হৈল মোহাম্মদ
অতএব সমাজে বৈষম্য ছিল ধনী-নির্ধনে, আশরাফে-আতরাফে। এবং সম্পদ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, পদ, বৃত্তি ও বংশভেদে কেউ ঘৃণ্য ও অবজ্ঞেয়, কেউ-বা শ্ৰদ্ধেয়-সম্মানিত ছিল। তবু মুসলিম-সমাজে হিন্দুর মতো জন্মসূত্রে জাতে-বর্ণে ঘৃণ্য-সম্মানিত হত না। মুখ্যত ধনই ছিল মানের মাপকাঠি। কাঞ্চনে অর্জিত কৌলীন্য কেউ ঠেকাতে বা অস্বীকার করতে পারত না।
ক. ধন হোন্তে অকুলীন হযন্ত কুলীন
বিনি ধনে হয় যথ কুলীন মলিন।
ধন হেন্তে যথ কাৰ্য পারে করিবারে।
[সৈয়দ সুলতান : নবী বংশ]
খ. অকুলীন কুলীন হৈব কুলীন হৈব হীন
অকুলীন ঘোড়ায় চড়িব কুলীনে ধরিব জীন।
[চট্টগ্রামের প্রাচীন ছড়া]
গ. নির্ধনী হইলে লোক জ্ঞাতি না আদরে
ফলহীন বৃক্ষে যেন পক্ষী নাহি পড়ে।
ধন্যবন্ত মূর্খক পূজএ সর্বলোক
ধন হোন্তে মান্যজন যদ্যপি বর্বর।
[সত্যকলিবিবাদ সম্বাদ]
একালের মতো কৃতী ও কীর্তিমান পুরুষ ছিল সেই—
‘যে দোলা ঘোড়া চলে,
আর
দশ বিশ জন যার আগেপাছে নড়ে।’
মুসলিম-সমাজেও কোনো কোনো বৃত্তি-বেসাত ঘৃণ্য ছিল। সামাজিক-বৈবাহিক সম্পৰ্কও অবাধ ছিল না কখনো :
ক. নারী বলে আহ্মি হই ধীবরের জাতি
আহ্মাতু অধিক হীন নাহি কোন জাতি।
খ. জাতিকুল না জানিয়া বিহা দিলে তোরে
শুনি জ্ঞাতিগণ সবে গঞ্জিবেক মোরে।
[নবী বংশ]
সে-যুগেও আভিজাত্যের উৎস ছিল তিনটে-ধন, বিদ্যা ও পদ। সমকালে তো বটেই ধন-বিদ্যা-পদধারীর বিচ্যুত বংশধরগণ অতীত-স্মৃতির পুঁজি নিয়েও কয়েক পুরুষ ধরে এমনকি চিরকাল সেই আভিজাত্য-গৌরব-গৰ্ব সামাজিক-বৈবাহিক জীবনে সুফলপ্ৰসূ রাখত। এরাই এবং মোল্লা-পুরুত-কায়স্থ-গোমস্তা-মুৎসুদি ও ছোট বেনেরাই ছিল মধ্যযুগের সেই শাহ-সামন্তশাসিত সমাজে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক। সামন্ত প্রশাসকদের পরেই নিরক্ষার সমাজে ছিল এদের দাপট। এরাই ছিল গ্ৰাম্যসমাজে প্রধান। তবে রাজতন্ত্রের যুগে রাজনীতি দরবার-বহির্ভূত ছিল না বলেই এদের কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা ছিল না। কিন্তু সমাজ-সংস্কৃতির এরাই ছিল ধারক ও বাহক। সে-যুগে সমাজ-সংস্কৃতি ছিল স্থাণু ও স্থায়ী আচার ও অনুষ্ঠানে নিয়ন্ত্রিত। কেননা, নতুন ভাব-চিন্তা-চেতনা কিংবা আচার অশিক্ষা-আচ্ছন্ন দুৰ্গম গ্রামীণসমাজে সহজে পৌঁছত না।
দারিদ্র্য, অনাহার, দুৰ্ভিক্ষ ও দুর্জনের দৌরাত্ম্য কোনো যুগেই নতুন কিংবা অনুপস্থিত ছিল না। সাধারণ মানুষের ভাত-কাপড়ের কোনো বিলাস কিংবা প্ৰাচুৰ্য ছিল না কোনো কালেই। ‘দুধভাত’ই তার পার্বণিক পরমান্ন।
তরুণাং সৰ্যাপী শাকং নিবেদনং পিচ্ছিলানি চ দধীনি
অল্প ব্যয়েন সুন্দরি গ্রাম্য জনো মিষ্ট মুশ্নাতি।
(বৃত্তরত্নাকর : কেদার ভট্ট)
–কচি সরিষার শাক দিয়ে নয়া চালের ভাত আর পাতলা দই–সুন্দরি, অল্প ব্যয়ে এমনি ভালো খাদ্য গ্রাম্য লোকে খায়।
নির্জিত লোক বেঁচে থাকাতেই তুষ্ট থাকত। ‘শেখ শুভোদয়া’য় বিজয় সেনের জবানিতে পাই “আমার স্ত্রীপুত্ৰ আছে, ঘরে ভাঙা খোরা আছে, কলসীতে খুদ আছে। তা-হলে আমি হতভাগা কিসে।।” (সুকুমার সেন : প্রাচীন বাংলা ও বাঙালী, পৃ. ১৭) আবার তখনো এমন দরিদ্র ছিল যার জীর্ণতম কুটির মেরামতের মতো আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না, আজও যেমন রয়েছে অসংখ্য নীড়হারা নিগৃহ পরিবার। মুকুন্দরাম বর্ণিত ফুল্পরারও এমনি দুর্দশা স্মর্তব্য :