১১
সে-যুগে নারীর অলঙ্কারবাহুল্য ছিল। মেয়েরা মাথায় সিঁথিপাট, টিকলি, কণ্ঠে হাঁসুলি, মালা, টাকার ছড়া; এক, তিন ও সাত লহরি হার, তাবিজ; হাতে কঙ্কণ, বালা, তাড়, চুড়ি, খাড়ু, পৈচি, অঙ্গদ, অনন্ত; আঙুলে অঙ্গুরীয়; নাকে কোর, চাঁদ বোলাক, বালি, ডালবোলাক, লোলক, নাকমাছি, নাকছবি, বেশর; কানে কানফুল, বোলতা, কুমড়োফুল, ঝুমকা কুণ্ডল, নোলক, ঝিঙ্গাফুল, কুণ্ডল, কানবালা, বালি; পায়ে পাজব, পাসুলি, নূপুর, ঘুঙুর, মকর, খাডু, মলতোড়র, বাকপাত, বঙ্করাজ, মল, উনচটি, উঝটি; কোমরে চন্দ্রহার, ঝুমঝুমি, নীবিবন্ধ, কিঙ্কিণী; হাতের পাতায় আঙুল-সংলগ্ন রতনচুড়; গ্ৰীবায় গ্ৰীবাপত্ৰ; বাহুতে তাড়, কেয়ূর, জসিম, বাজুবন্ধ, বাজু প্রভৃতি বহু ও বিচিত্র গড়নের অলঙ্কার ছিল। আর্থিক অবস্থা ও সামাজিক অবস্থানভেদে এগুলো তালপাতা, ঝিনুক, শিঙ থেকে তামাপিতল-সিসা-রুপা-সোনা-মুক্তা, হীরা-মণি-কাচপাথর প্রভৃতি যে-কোনো উপাদানে তৈরি হত। শেখশুভোদয়ায় তালপত্রে নির্মিত কর্ণােভরণের কথা আছে। কাচুলি নানা বৈচিত্র্যে আকর্ষণীয় ও জরি-রত্নখচিত ছিল। অবশ্য কাচুলি অভিজাত ও ধনীঘরের নারীই কেবল ব্যবহার করত। নানা ছাদের বেণী ও কবরী হত। কানাড়ি (কর্নটদেশীয়) ছাদে বাধা কবরীর কদর ছিল বেশি। কবরীতে বেণীতে নানা রঙের ফিতা ছাড়াও ফুল জড়ানো ছিল সৰ্বজনীন রীতি। বেণীর প্রান্তে ফুল বাধা থেকেই হয়তো গ্রন্থের সর্গ বা গ্ৰন্থ সমাপ্তিজ্ঞাপক ‘পুষ্পিকা’ নামের উৎপত্তি।
পূরুষেরও বাহুতে কবচ ও বাজু, বাহুতে, গলায় ও কটিতে তাবিজ; কানে কুণ্ডল, হাতে বলয় ও গলায় একছড়ি হার বা কালো সূতার তাগা’ থাকত। ধাৰ্মিক মুসলমানেরা খিলালের প্রয়োজনে লোহার বা পিতলের খিলাল-শলাকা গলায় বুলিয়ে রাখত।
নারীর প্রলেপ প্রসাধনদ্রব্যের মধ্যে ছিল সিন্দূর, চন্দন, মেহদি, কুমকুম, কম্ভরী, কাফুর, কেশর, অগুরু, কাজল, অঞ্জন, সূৰ্মা, তেল, আতর ও ঠোঁটে তাম্বলরাগ। পুরুষেরাও এসব প্রসাধনদ্রব্য উৎসব-পার্বণকালে অঙ্গে ধারণ করত। চুল-দাড়ি রাঙানো মুসলিম ধাৰ্মিকসমাজে বহুলপ্রচলিত ছিল।
শাহ সামন্ত-অভিজাত এবং উচ্চ ও মধ্যবিত্ত ঘরে নারী পর্দা ছিল, তবে শাসনপ্রশাসনে জড়িত বা নিয়োজিত নারীর পর্দা-নীতি শিথিল ছিল। নিম্নবর্ণের ও নিম্নবিত্তের ঘরে পর্দা কখনো প্রথারূপে চালু ছিল না। পর্দা প্রথা ছিল না। বাউল-বৌদ্ধ-বৈষ্ণবদেরও। দরিদ্রঘরের নারীদের ঘরে-বাইরে, ক্ষেতে-খামারে, হাটে যেতে হত। ভিখারিনি তো ছিলই। আর দাসী-বান্দী-ক্রীতদাসীর পর্দা রাখার তো নিয়মই ছিল না। তা ছাড়া তান্ত্রিক-কাপালিক-সহজিয়া-বাউল প্রভৃতি কায়াসাধকরা বামাচারী। মণ্ডল, ভৈরবীচক্র, নৈশমিলনচক্র, গৌপীচক্র রসের ভিয়ান, রজঃ শুক্ৰ পান প্রভৃতি আনুষ্ঠানিক ও যৌথ রতি-রমণ হচ্ছে সাধনার অঙ্গ। কাজেই এদের মধ্যেও পর্দাপ্রথা ছিল না।
১২
গরিবেরা কাজের সময়ে কৌপীন, গামছা ও অন্য সময়ে খাটো শাদা ধুতি বা তহবন। পরত। মাথায় টুপি (কাপড়ের, তালপাতার বা বেতের) ও পাগড়ি পরত। জুতা পরা হয়তো বিয়ের মতো পার্বণিকই ছিল। হিন্দুরাও কৌপীন, গামছা, খাটো ধুতি ও গায়ে উত্তরীয় পারত, কেউ-কেউ মাথায় পাগড়িও বাধত। পাগড়ি বাঁধার পদ্ধতিতে হিন্দুমুসলমানে ভেদ ছিল। চট্টগ্রাম ছাড়া অন্যত্র নারীমাত্রই শাড়ি পরত। চট্টগ্রামে আরাকানি শাসন প্রভাবে ঘামচা” ও “উড়নী” দুই খণ্ড কাপড় পরীত মেয়েরা। রাজপুরুষ ও সামন্তঅভিজাত উচ্চবিত্তের শিক্ষিতারা পরীত ইজার, কামিজ, কাবাই, চাপাকান, আসকান, আলখাল্লা, চৌকা, সিনাবন্দ (waist coat) কোমরবন্দ ও পাগড়ি, শামলা কিংবা টুপি। গলাবন্দ, দোয়াল, অঙ্গুরীয়ও তারা পরত। শাসকশ্রেণীর অনুসরণে হিন্দু রাজপুরুষ, ধনী এবং অভিজাতরাও পরত। এসব পোশাক (কাল ধল রাঙা টুপি সবার মাথে/পাসরি পটকা দিয়া বান্ধে কোমরবন্ধ। –রূপরাম চক্রবর্তী, ধর্মমঙ্গল)।
আর্থিক অবস্থা ও সামাজিক অবস্থানকিংবা সরকারি চাকরিভেদে এসব পোশাক সুতোর, রেশমের, জরির কিংবা সোনা-রুপা-মুক্তা-মণিখচিতও হত। ধনীঘরের বউ-ঝিরা কীচুলি (Biodice) এবং অন্তর্বাস বা ছায়া (petti coat) পরত। গরিব ও মধ্যবিত্তের পোশাক ছিল মোটা তীতে নির্মিত। ঘরে ঘরে চরকায় সূতা তৈরি হত। তাঁতি শুধু বানিয়ে দিত।
চটক, মটক, গরাদ, ধুতি ছাড়াও শাড়ির মতো মোটা-পেড়ে নানা ধুতি ছিল। মেয়েদের ছিল ময়ুর পেখম, আগুন পাট, কালপাট, আসমান তারা, হীরামন, নীলাম্বরী, যাত্রাসিদ্ধি, খুঁঞা, নেত, মঞ্জাফুল, অগ্নিফুল, মেঘডুমুর, মেঘলাল, গঙ্গাজলি প্রভৃতি নানা নামের শাড়ি। মসলিন, পাটাম্বর তথা রেশমের (সিস্কের) কারুখচিত বহুমূল্য শাড়ি ছাড়াও উচ্চমূল্যের বেলন পাটের (সিস্কের) নোতের শাড়িও আনুষ্ঠানিক ও পার্বািণক প্রয়োজন মিটাত।
১৩
বৃত্তিভেদে নিম্নবিত্তের নিরক্ষর দেশজ মুসলিমসমাজ
কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম প্রদত্ত বিবরণ :
রোজা নামাজ না করিয়া কেহ হৈল গোলা
তাসন করিয়া নাম ধরাইল জোলা।
বলদে বাহিয়া নাম বলয়ে মুকেরি
পিঠা বেচিয়া নাম ধরাইল পিঠারী।
মৎস্য বেচিয়া নাম ধরাইল কাবারী
নিরন্তর মিথ্যা করে নাহি রাখে দাড়ি।
সানা বান্ধিয়া নাম ধরে সানাকার
জীবন উপায় তার পাইয়া তাতিঘর।
পট পড়িয়া কেহ ফিরএ নগরে
তীর্যকর হয়্যা কেহ নির্মএ শরে।
কাগজ কুটিয়া নাম ধরাইল কাগতি
কলন্দর (ফকির) হয়্যা কেহ ফিরে দিবারাতি।
বসন রাঙাইয়া কেহ ধরে রঙ্গরেজ
লোহিত বসন শিরে ধরে মহাতেজ।
সুন্নত করিয়া নাম বোলাইল হাজাম…
গোমাংস বেচিয়া নাম বোলায় কসাই…
কাটিয়া কাপড় জোড়ে দরজির ঘটা…