৮
সাড়ে চার কিংবা পাঁচ বছর বয়সে মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার জন্যে। “হাতেখড়ি’ অনুষ্ঠান হত। এতে উৎসবের আয়োজন হত। ভোজপায়েস-শিন্নি-গুড়-বাতাসা-মিষ্টি এবং পান ও তেল (তেলোয়াই) যোগে উপস্থিত জনেরা অভার্থিত ও আপ্যায়িত হত। ব্যাকরণ, অলঙ্কার, ন্যায়, কাব্য, নাটক, সঙ্গীত, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও শান্ত্রিশিক্ষার সঙ্গে রতিশাস্ত্ৰও কখনো কখনো কোথাও শিক্ষা দেয়া হত। বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’ কিংবা ‘নায়িকা লক্ষণ’ প্রভৃতি সে-যুগে তেমন লজ্জাজনক গুহ্যবিদ্যা ছিল না। তাই কাব্যে-উপাখ্যানে রতি-রমণের ও নারীরূপের বিস্তৃত বর্ণনা থাকত। সামন্ত-ঘরে চিত্রাঙ্কন ও সূচী শিল্পেরও চর্চা ছিল। তবে সাধারণের শিক্ষা সূচিতে শাস্ত্ৰ, ব্যাকরণ, সাধারণ গণিত (জল, জমি ও বস্তুর মাপ ও হিসাব সংক্রান্ত আর্যাদিই ছিল প্রধান), কাব্য, অলঙ্কার ও পত্র-দলিল-দস্তাবেজ রচনা প্রভৃতিই থাকত। সামাজিক উৎসবে-পার্বণে, নাচ-গান-বাদ্য-প্ৰমোদের জন্যে ছিল নীচজাতীয় গাইয়ে-বাজিয়েনাচিয়ে-নাটুকে বৃত্তিজীবী। উচ্চবিত্তের অভিজাত সামন্ত ও রাজ-পরিবারের লোকেরা কলা-চৰ্চা করত নিজেদের বা অন্তরঙ্গাজনের চিত্তবিনোদনের জন্যে। নারীশিক্ষাও একেবারে বিরল ছিল না।
শিক্ষা বলতে সে-যুগে ধর্মশিক্ষাই মুখ্য লক্ষ্য ছিল বলে ব্ৰাহ্মণ-অত্ৰাহ্মণ ও হিন্দুমুসলমানের বিদ্যালয় পৃথক ছিল। সাধারণত পণ্ডিতের ঘরে টোল ও আলিমের ঘরে বা মসজিদে মক্তব্য থাকত। পাড়ার ছেলেমেয়েরা তাদের কাছে পড়ত। কিছু দক্ষিণা বা নজরানা দিত, তা-ও সবসময় কড়িতে নয়-ফসল তোলার মৌসুমে ধানাদি শস্য কিংবা ফলমূল তরকারির আকারে ও বার্ষিক বরাদে। সাধারণ শিক্ষার জন্যে কোথাও কোথাও পাঠশালা ছিল। উচ্চশিক্ষার জন্যে ক্বচিৎ কোথাও সরকারি বা সামন্ত-সাহায্যে পরিচালিত টোল-মাদরাসা থাকত। সে-যুগে সব শ্রেণীর লোকের মধ্যে লেখাপড়ার চর্চা ছিল না। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সে অধিকারও ছিল না। নিম্নবর্ণেরও নিম্নবিত্তের দীক্ষিত মুসলিম সমাজেও ঐতিহ্যাভাবে বিদ্যার্জনে আগ্রহ ছিল না। কাজেই ব্যক্তিগত বিদ্যালয়ই বেশি ছিল এবং পড়ুয়ার সংখ্যা ছিল নগণ্য। গুরু-ওস্তাদের শাস্ত্রীয় সংস্কারপ্রসূত মর্যাদা ও সম্মান ছিল। শাপে সর্বনাশ হওয়ার আশঙ্কা ছিল বলে পড়ুয়ারা তো বটেই অন্যেরাও গুরু-ওস্তাদকে শ্রদ্ধা ও সমীহ করত, তা ছাড়া বিদ্বান ও জ্ঞানী বলেও তাঁরা সম্মানিত ছিলেন। হিন্দুপণ্ডিত পৌরোহিত্য, পাতিদান, কোষ্ঠী তৈরি, ভাগ্যগণনা ও শ্ৰাদ্ধাদি শাস্ত্রীয় সামাজিক ও পার্বণিক অনুষ্ঠানে স্ব স্ব কর্তব্য পালন করে অর্থে পার্জন করতেন।
মৌলবি-মুনশি-ওস্তাদ-মোল্লা-খোন্দকারেরাও গায়ের শাস্ত্রীয় উৎসবে-পার্বণে, বিবাহে-মৃতসৎকারে শাস্ত্রীয় দায়িত্ব পালন করতেন। মুরগি জবেহ, ফাতেহা পাঠ, জানাজায় ইমামতি, মসজিদে মুয়াজ্জিন ও ইমামের কাজ প্রভৃতি ছিল তাঁদেরই। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষাথীরা শিক্ষকের নিঠুর শারীরিক পীড়নের শিকার ছিল :
শিখিতে না পারে তবু শিখাইতে না ছাড়ে
মারিয়া বেতের বাড়িএ ঠেঙ্গা করে।
কতু কভু বান্ধ্যা রাখে বুকে বসে রয়
উচিত করএ শাস্তি যেদিন যে হয়।
(দয়াময়ের সারদামঙ্গল)
এখানেই শেষ নয়, নাডুগোপাল করা (হাত-পা জড়ো করে রাখা), ধান বা কাঁটা দিয়ে কপাল চিরে রক্ত ঝরানো, সূর্যের দিকে মুখ করে বসানো, বিছুটি পিঁপড়ে প্রভৃতি গায়ে লাগিয়ে দেয়া ছিল স্বাভাবিক শাস্তির অঙ্গ। কলম ছিল কঞ্চি কিংবা হাঁসের, শকুনের বা ময়ূরের পালকের। বালকেরা কলাপাতায়; অন্যেরা লিখত তুলেটি কাগজে, তালপাতায়। কালি তৈরি হত বিভিন্ন পদ্ধতিতে। ছাত্ৰশিক্ষকেরা বসতেন চাটাই, মাদুর, পাটি, কুশাসন ও ফরাশ প্রভৃতির উপর। ছাপাখানা ছিল না বলে সব গ্রন্থ ছিল হাতে-লেখা পাণ্ডুলিপি। পেশাদার লিপিকার থাকত।
৯
গান-বাজনা সমাজে লোকপ্ৰিয় ছিল। শরিয়তপস্থিরাও যেন তখন তেমন রক্ষণশীল ছিল না। তাই সর্বপ্রকার উৎসবে-পার্বণে নাচ-গানের আসর বসত দেখা যায়। চট্টগ্রামের হিন্দু ও মুসলিম রচিত রাগ-তালের বহু গ্ৰন্থ ষোলো শতক থেকেই মিলছে। বিশেষত সঙ্গীত (হালকা-দারা-সামা) কলন্দরিরা, চিশতিয়া ও কান্দিরিয়া সুফিদের সাধন-ভজনের অঙ্গ। প্ৰায় সব মুসলিম-কবিই গান রচনা করেছেন, কেউ-কেউ রাগ-তালের গ্রন্থও ৷ কবি আলাউল তো প্রথম জীবনে সঙ্গীতশিক্ষকই ছিলেন। গাইয়ে-বাজিয়ে তো ছিলেনই, তিনি সঙ্গীত রচনা ছাড়া ‘রাগতালনামা’ও রচনা করেছিলেন। বলা বাহুল্য, সবার সব সঙ্গীতই রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়-রূপকে রচিত। ব্যতিক্রম ক্বচিৎ দৃষ্ট হয়।
১০
ঘরে-সংসারে একরকমের নেশা চালু ছিল। উননের কাছে জলভরা ঘড়ায় প্রতিদিন এক মুষ্টি ভাত রেখে কয়েক দিন পর ভাতপচা পানি ছেকে নিয়ে পান করত তারা, এর নাম আমানি বা ঘড়া কাজি। এতে সামান্য নেশা ধরত। ভেতো মদের আরাকানি নাম ‘সিফত’। তা ছাড়া ধেনো, তালো, খেজুরে মদ, গাজা, চরস, চণ্ডও বহুলপ্রচলিত ছিল। মুখশুদ্ধির জন্যে পান-সুপারি তো ছিলই। কিন্তু পরে যখন প্রায় নির্দোষ ব্যসন ‘তামাকু” চালু হল, তখন তামাক সেবনের নিন্দায় উচ্চকণ্ঠ হয়েছে সমাজহিতৈষীরা। ‘তামাকু’ সেবন গোড়াতে ছিল শাহ-সামন্ত অভিজাতদের দর্প ও দাপট প্রকাশের প্রতীক। তাই মনিব ও মান্যজনের সম্মুখে তামাকু সেবন ছিল বেয়াদবি, ঔদ্ধত্য, অসৌজন্য ও অসংস্কৃতির লক্ষণ ও প্রকাশ। পরে এ অভ্যাস যখন গণমানবে সংক্রমিত হল, তখনো তামাকু সেবন রইল। অবজ্ঞেয় ও নিন্দনীয়। এর কারণ বোধহয় তামাকু সেবনলিন্সু ব্যক্তিরা অধৈর্য হয়ে হাঁকা কেড়ে নিয়ে ধূমপান করতে চায়। তাই আমরা আঠারো শতকের কবি শেখ সাদী ও আফজল আলিকে তামাকুসেবীর নিন্দায় মুখর দেখি। রামপ্রসাদ, শান্তিদাস ও সিতকর্মকার যথাক্রমে ‘তামাকুমাহাত্ম্য’, ‘তামাকুপুরাণ’, ও ‘ইকাপুরাণ’ রচনা করে তামাকখোরকে বিদ্রুপ করেছেন এবং দ্বিজ রামানন্দ সঙ্গীতে গাজা-তামাকুর মহিমা প্রচারে হয়েছেন মুখর। ফকির-দরবেশরাও তামাকখোর হয়ে উঠেছিলেন। ‘চৌদিশত দরবেশ চলে আলবোলা হাতে’ (দ্বিজ ষষ্ঠীবর)।