৭
বিবাহে পাণ-প্রথা চালু ছিল; হিন্দুসমাজে বরপণ এবং মুসলমানসমাজে ছিল কন্যাপণ। বাল্যবিবাহ জনপ্রিয় ছিল। ধনীরা সাধারণত বহুপত্নীক এবং গরিবেরা একপত্নীক থাকত। নজর, শিকলি, যৌতুকদানও সামাজিক রেওয়াজের আবশ্যিক অঙ্গ ছিল। পণ ও নির্ধারিত অলঙ্কার প্রভৃতির দেনাপাওনার ব্যাপারে অভাবে কিংবা স্বভাবদোষে পারস্পরিক প্রতারণার ঘটনা বিরল নয়, সুলভাই ছিল। তাই বিয়ের আসরে ঝগড়া-বিবাদ-মারামারি, বিয়েভাঙা প্রভৃতি প্রায়ই ঘটত। বিয়ের প্রস্তাব-পয়গাম পাঠানো থেকে বিয়ের পরের কয়দিনও উভয়পক্ষের মধ্যে ভোজ-উৎসব চলত নানা অজুহাতে–যেমন ঘর-বাড়ি দেখা, বরকনে দেখা, পাকাকথা, দিন-তারিখ ঠিক করা, বিয়ের ভোজ, কনে-ভোজ, বর-ভোজ প্রভৃতি। বিবাহোৎসবে বা খৎনা, কান-ফোড়ন, আকিকা, অন্নপ্রাশন, নাম-রাখা, গায়ে হলুদ ও হাতে-মেহদি প্রভৃতিতে বাদ্য-বাজি, নাচ-গান, আবির-ফাগ, সোহাগ, কেশরঅগুরু-চুয়া, আন্তর, রঙ মাখা-ছোড়া, কাদা-ছোড়া, মেয়েলি নাচগান, পুতুল নাচ, জাদুকরের খেলা প্রভৃতির ব্যবস্থা আর্থিক সাচ্ছল্যানুসারে থাকতই।
ঘরজামাই বরের বা শ্বশুরঘরে বউয়ের তেমন কোনো মর্যাদা ছিল না। বিশেষ করে মেয়েদের বাপের বাড়ি ছিল, শ্বশুরবাড়ি ছিল, কিন্তু নিজের বাড়ি বা সংসার থাকত না। বধূর উপর পীড়ন-আশঙ্কায় বিবাহিতা মেয়ের মা-বাপ-ভাই-বোন সবসময় বর-পরিবারের সঙ্গে তোয়াজের ভাষায় ব্যবহার করত অর্থাৎ বরপক্ষের মন যুগিয়ে চলতে হত তাদের। কন্যার পিতা হিসেবে এ-ক্ষেত্রে রাজা ও ভিখারির মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। ‘পিতৃগৃহে কন্যা জন্ম অন্যের কারণে।’—এটি শিশু বালিকারাও জানত-বুঝত, পুতুল-খেলায় তা ছিল সুপ্রকট। পুরুষ-প্রধান সমাজে নারী ছিল নরপোষ্য, তাই অসহায় ও স্বাধীনসত্তাবিহীন। কন্যারূপে পিতার, জায়ারূপে স্বামীর, মাতারূপে সন্তানের আশ্রয়ে ও অভিভাবকত্বে জীবন কাটে তার। এ-কারণেই হয়তো অপরিচিত মনিববাড়ির বালক-ভূত্যের মতো পরকে আপন করার, অনান্তীয় নিয়ে ঘর করার, এবং নতুন জায়গায় ঘর বাঁধার মতো মনের জোর, স্বভাবের ঐশ্বর্য ও মানসপ্রস্তুতি থাকে তার বালিকা-বয়স থেকেই। স্বয়ম্বরের কাল তখন অপগত বটে, কিন্তু জামাতা (গদা-মালিকা দ্রষ্টব্য) নির্বাচন কালে তার শাস্ত্ৰজ্ঞান, বুদ্ধি, যোগ্যতা, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য-চেতনা প্রভৃতির পরীক্ষা হত। অশিক্ষিতের মধ্যে হত হেঁয়ালিধাঁধা দিয়ে। বর-ঠকানো নানা হেঁয়ালি তখন খুব চালু ছিল। বিয়ের সময় দিন-ক্ষণ-তিথি-লগ্ন মানা হত। বিবাহানুষ্ঠানের জন্যে সুসজ্জিত মঞ্চ তৈরি হত, কলাগাছ পোতা হত, আমের ডাল জলপূৰ্ণামঙ্গলঘট তথা কলসির মুখে বসানো হত। উপরে থাকত চাঁদোয়াএই আচ্ছাদনের অপর নাম আলাম বা ছত্র। মেঝে আলপনা আঁকা হত। ঐ মঞ্চের নাম ছিল মারোয়া। এর মধ্যেই বর-কনের চরিচোখের মিলন হত। দুইপক্ষের সখিবন্ধু-আত্মীয়রা তখন হর্ষধ্বনি ও শুভ কামনার সঙ্গে ঠাট্টা-মশকরা ও নানা রঙ্গরস করত। এর নাম জুলুয়া বা জোলুয়া (জলুস?)—‘জলুয়া দিলেন্ত দীয়া (দীপ), করি হুড়াহুড়ি’। বর-কনের মধ্যে তখন পাশাদি ক্রীড়া চলত। বর-কনে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে প্রতিপক্ষরুপে ফুলের স্তবক দিয়ে ছোড়া-লোফা খেলাও খেলত। পদাবলীর সেই ফুলের গেরুয়া (স্তবক) সঘনে লোফএ’ ক্রীড়াও এ-রকমেরই। এ খেলার নাম ছিল গেরুয়া খেলা। এ যেন বিবাহোত্তর Courtship। শরম-সঙ্কোচ ভাঙার জন্যেই হয়তো এ ব্যবস্থা। [কবি আইনুদ্দীনের গেরুয়া খেলা দ্রষ্টব্য]। বর-কনের অন্য বাড়িতে অভ্যর্থনার ব্যবস্থা থাকত। এর নাম ‘গস্ত্ ফিরানো।’ নিরক্ষর গরিব মুসলিম ধুতি পরেই বর সাজত। অন্যদের তখনো বর-পোশাক ছিল ইজার-পাগড়ি, তাঞ্জাম-চৌদোল ও শিবিকা বা পালকিই ছিল বর-কনের বাহন।
সাধারণের বিয়েতে মেয়েমহলে বাঁদীশ্রেণীর ভাড়া-করা নারী কিংবা গৃহস্থঘরের বৌ-ঝিরা নাচ-গান করত। ধনীগৃহে উৎসবকালে নাচিয়ে-গাইয়ে-বাজিয়ে বেশ্য আনা হত। বেশ্যারা সমাজে খুব ঘৃণ্য ছিল না। বাইজি’ সম্বোধন ও পরিচিতির মধ্যেই রয়েছে সামাজিক স্বীকৃতির আভাস। তা ছাড়া ধনীলোকের নজরীরূপে দাসীসম্ভোগ ও উপপত্নী রাখা নিন্দার কিংবা অগৌরবের ছিল না।
বিবাহাদি অনুষ্ঠানে নানা রীতি-রেওয়াজ ও আচার-সংস্কার রয়েছে। কালো অস্ট্রিকরা হলুদ মেখে স্নান করে গাত্রবর্ণের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করে। আলপনা-আঁকা কুলা বা ডালায় ধান, দূর্বা, দীপ, হলুদ ও জলপূৰ্ণ ঘটের মুখে আম্রপত্র রাখে, ঘরের দ্বারে কলাগাছ পুঁতে, বিয়ের পূর্বদিনে বর-কনের বাড়িতে দই-মাছ পাঠায়, বর-যাত্রার সময় বরের কোলে একটা শিশু বসায়। এসব হচ্ছে আদিম জাদু-সংস্কার। ধান খাদ্যসম্পদ ও সন্তানবৃদ্ধির প্রতীক, দূর্ব জীবনীশক্তির, কলাগাছ ও আম্রপত্র দীর্ঘ আয়ু ও প্রাণশক্তির, হলুদ সৌন্দর্যের, মাছ প্রজননশক্তির, বরের কোলে শিশু সৃষ্টিশীলতার, ও দীপ আশার প্রতীক। পৃথিবীর আদিম ও বুনোসমাজে এগুলো নানাভাবে ও বিভিন্ন আকারে রয়েছে। জরু-যে জমির মতোই বীরভোগ্য, অর্থাৎ বাহুবল ও পৌরুষ দিয়ে আয়ত্ত করতে হয় এবং আদিযুগে-যে নারীকে হরণ করেই বরণ করার প্রথা চালু ছিল, তার রেশ রয়ে গেছে। দরজায় বর আটকানো প্রথায়। পূর্বে কনেপক্ষ সত্যি বাধা দিত; এখন ছদ্ম বাধা সৃষ্টি করে আর্থিক ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দেয়; এখন তা ঠাট্টা-সম্পর্কিতজনদের আমোদ-ফুর্তির উপলক্ষমাত্র। পাঁচ পুকুরের পানি মিশিয়ে পাঁচ হাতে স্নান করানো, পাঁচ হাতে মেহদি লাগানো, শুভকর্ম বন্ধ্যা ও বিধবা-ভীতি প্রভৃতি আমাদের বিস্মৃত আদিম পূর্বপুরুষ থেকে পাওয়া ঐতিহ্য, আচার ও উত্তরাধিকার। সংস্কার-যে মৰ্মমূলে কীভাবে চেপে বসে, তার প্রমাণ বেহুলা-লখিন্দরের বাসররাতের দুর্ভাগ্যভীত বাঙালি হিন্দুরা বিয়ের প্রথম রাত ‘কালরাত্ৰি’ হিসেবেই মানে।