মন্ত্রবলে স্বৰ্গ-মর্ত-পাতালের সর্বত্র থাকত অবাধগতি। যুদ্ধে অস্ত্ৰ জোড়ার সময়েও মন্ত্রপূত অন্ত্রের লক্ষ্য হতো অমোঘ। ‘নানামন্ত্রে আমন্ত্রিয়া এড়ে অস্ত্ৰবাণ’ (সত্যকলি)। রামায়ণ-মহাভারতেও আমরা অগ্নি-বায়ু-সৰ্প-চন্দ্র প্রভৃতি বহু বিচিত্ৰ বাণের ব্যবহার দেখি। ভূত-প্ৰেত-জিন-পরি-দেও-দানুর প্রভাবেও লোকের বিশ্বাস ছিল অবিচল। ভূতপ্ৰেত-দেও-দানব-জিন-পরি ছাড়াবার তাড়াবার ব্যবস্থাও ছিল বিচিত্র ও বিবিধ, তাতে অমানবিক নির্যাতনমূলক অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হত। তাবিজ-কবজ, মন্ত্র-স্বস্ত্যয়ন, দোয়াকোরআনখানি, পূজা-শিন্নিদান-সদকা, বলি-কুরবানি অনুষ্ঠানেও ধূপ-ধূনো-লোবান, সোনা-রুপা-লোহা প্রভৃতির ধোয়াজলে ও লোহা ধারণে ছিল অপদেবতার হামলাভীত মানুষের নির্ভর ও ভরসা। এমনি হাজারো ঘরোয়া, নৈতিক ও সামাজিক কুসংস্কার নিয়ন্ত্রণ করত মানুষের ভাব-কর্ম-আচরণ। এগুলো-যে নিরাপত্তাকামী আদি মানবগোষ্ঠীর ভয়-বিস্ময়-কল্পনাপ্রসূত জাদু-বিশ্বাস ও আচারের ক্রমোৎকর্ষপ্রাপ্ত সংস্কার ও রূপ তা বলার অপেক্ষা রাখে নিনা। এমনি রূপান্তরে আদিম বিশ্বাস-সংস্কার ও আচার দুনিয়ার সভ্যতম সমাজেও জগদ্দল হয়ে আজও টিকে আছে।
নানা শুভ ও গুরুত্বপূর্ণ কর্মে ছাড়াও গৃহ-নির্মাণে ও গৃহ-প্রবেশে, স্নানে, বিশেষ করে পার্বণিক স্নানে, নববস্ত্ৰ পরিধানে কিংবা পরিহারকালে মাস-দিন-ক্ষণ-গ্ৰহ-নক্ষত্ররাশিনির্ভর শুভাশুভ জানতে ও মানতে হত; এখনো হয়। অনেক রোগই ভূত-প্ৰেতদেও-দানু-জিন-পরির কুদৃষ্টির ফল, তাই রোগ এড়ানোর জন্যেও কথায়, কাজে, চলায়-ফেরায় কালাকাল মানতে হয়। মুহম্মদ খানের ‘সত্যকলিবিবাদ সম্বাদে’, আলাউলের ‘তোহাফা’য়, মুজাম্মিলের ‘নীতিশাস্ত্রবার্তা’য় এবং আরো অনেক গ্রন্থে প্রাসঙ্গিকভাবে গ্রহ-নক্ষত্ৰ-রাশির প্রভাব কিংবা অপদেবতার অপদূষ্টি কুনজরের লক্ষণ, নিদান এবং তা এড়ানোর উপায় প্রভৃতি বর্ণিত হয়েছে।
যেমন শ্রাবণ-ভদ্ৰে নতুন ঘর করলে সে-ঘর সর্বদা রোগ-শোক-আপদে আকীর্ণ থাকে। স্পষ্টত বর্ষাকালে নির্মিত ঘর স্যাতসেঁতে হবে এবং তজজাত রোগও অবশ্যম্ভাবী, তেমনি আশ্বিনেও ঝঞা-বন্যার আশঙ্কার সঙ্গে গৃহ-উপকরণও দুর্লভ-দুর্মুল্য হবে।
সোম, বুধ ও বৃহস্পতিবারে স্নান করলে ধন বাড়ে। শুক্রবারে স্নানও উত্তম। মঙ্গলবারে স্নান করলে আয়ুকমে এবং দুশ্চিন্তা বাড়ে। গাছতলায় দিগম্বর মানে নেংটাি হলে রোববারে রোগে ধরে এবং মানুষের কুদৃষ্টি পড়লে কিংবা ভূতে ভর করলে হাঁস বা ছাগল দান করে আরোগ্য লাভ করা যায়। বুধবারে যে-রোগের শুরু তা থেকে আরোগ্যের উপায় হচ্ছে কালো মুরগি দান। ভূতদৃষ্টিজাত রোগের নিরাময়ের জন্যে ছাগ-বৃষ দান করতে হয়। অশ্বের কপালের লোম পুড়ে ধ্রুয়া দিলে ও ময়ূরের পুচ্ছ নিয়ে তালপাতা বা ছাতার মতো ধরলে দেও-এ ভর-করা মানুষ নিষ্কৃতি পায়। হিঙ্গুল, কম্ভরী, শস্যধূম, জতুর গুড়ো, কালো-মটি, গাভীর হাড়, মাছের পিত্ত, হরিদ্রা, চিলের মাংস, প্যাচার নখ, কালো বিড়াল ও কালো মুরগির বিষ্ঠা, গন্ধক প্রভৃতিও বিভিন্ন চিকিৎসার উপকরণ। শুক্রবারে নববস্ত্ৰ পরিধান এবং রোববারেই নববস্ত্ৰ ছেড়া বিধেয়।
বিবাহ ও অন্য পুণ্যকর্ম শুক্রবারে, শনিবারে মৃগয়া, রোববারে গৃহ-নির্মাণ, বাণিজ্যোদেশে শনিবারে বিদেশ যাত্ৰাই শুভ আর যুদ্ধ মঙ্গলবারে শুরু করাই ভালো।
৬
আগেই বলেছি, সাংখ্য, যোগ ও তন্ত্রই তৈরি করেছে বাঙালির অধ্যাত্ম-সাধনার ভিত্তি। এ-ক্ষেত্রে বৌদ্ধ, হিন্দু কিংবা মুসলিমে ভেদ মতগত নয়, আচার-পদ্ধতিগত। সবাই দেহসাধনায় আস্থা রাখে। দেহতত্ত্ব সবারই অবশ্য জ্ঞেয়। নির্বাণকামী বিকৃত বৌদ্ধদের দেহবাদ, ঈশ্বরবাদী হিন্দু-মুসলিমে দেহাত্মবাদে রূপান্তর পেয়েছে। বৈরাগ্য-সন্ন্যাসের ঐতিহ্য আরো পুরানো, নাস্তিক আজীবিক, জৈন শ্রাবক, বৌদ্ধ ভিক্ষু, বজ্রযানী-সহজযানী-তান্ত্রিক-কাপালিক-বীরাচারী-বীভৎসাচারী-চীনাচারী নানা তান্ত্রিক ব্ৰহ্মচারী, যোগী-সন্ন্যাসী বৈষ্ণবসহজিয়া-বাউল-বৈরাগী আকীর্ণ প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাঙলায় যোগীর আদর-কদর ছিল অসামান্য। বৈরাগ্যে, সেবায়, সততায়, সুচিকিৎসায়–অলৌকিক শক্তিধর সাধনসিদ্ধ নিগৃহ যোগী ছিল লোকচক্ষে আদর্শ মানুষ। বাঙলাসাহিত্যের গোড়া থেকে রবীন্দ্রনাথের রূপকসাঙ্কেতিক নাটক অবধি আমরা এজন্যেই বিশ্বাস, ভরসা ও নির্ভর করবার মতো আদর্শ-চরিত্র মানুষ হিসেবে পাই কেবল যোগী-সন্ন্যাসীকেই। ঘর-সংসার করেও বৈষয়িক মানুষ-যে আদর্শনিষ্ঠ, সেবাপরায়ণ, সত্যসন্ধ ও ত্যাগপ্রবণ হতে পারে, তা যেন আমাদের দেশের মানুষের কাছে সুপ্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি অজ্ঞাত। তাই আমাদের সাহিত্যিক ঐতিহ্যে (বঙ্কিম-সাহিত্য অবধি) পরহিতব্ৰতী উপচিকীযুঁ, ঈৰ্ষা-অসূয়ামুক্ত, সেবা-সততা-ত্যাগতিতিক্ষীসুন্দর মানুষমাত্ৰই যোগী-সন্ন্যাসী-ব্ৰহ্মচারী। তাই সাধু আমাদের চেতনায় বেনে নয়, সন্ন্যাসী। সংসারী বিষয়ী মানুষের সততায় ও মনুষ্যত্বে এদেশের মানুষ চিরকাল এমন আস্থাহীন যে এদেশে রাজনীতির নেতা হতেও বৈরাগ্যের ভান ও ভেক দরকার।
গায়ে ছাই, কানে কড়ি, গলে মালা, হাতে নড়ি ও খাপর, কাঁধে কাঁথা ও কুলিএমন যোগীর সাক্ষাৎ মধ্যযুগের মুসলিম-রচিত সাহিত্যের সর্বত্র মেলে। বাঙালি তথা ভারতীয় মুসলিমের মারফত-সাধনায়ও যোগ ও যোগ-পন্থাই হয়েছে অবলম্বন। শাহ শরফুদ্দীন বুআলি কলন্দর, গউস গোয়ালিয়র থেকে সৈয়দ সুলতান, ফয়জুল্লাহ, হাজী মুহম্মদ, শেখ চান্দ, আবদুল হাকিম, আলি রাজা প্রমুখ সবাই যোগভিত্তিক সুফি সাধনাতেই আস্থা রেখেছেন। এ সাধনাতত্ত্বের প্রাপ্ত উৎস হচ্ছে ভোজবৰ্মণ রচিত ‘অমৃত-কুণ্ড’। ‘বাঙলার সুফী সাহিত্য’ গ্রন্থে এসব বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে। ইসলামের ‘নবীবংশ’-প্রণেতা পির মীর সৈয়দ সুলতান বলেছেন, ‘হযরত মুহম্মদ ও উমর যোগপন্থ শিখাইলা, শিখাইলা জ্ঞান।’ কিংবা ‘ফিরিস্তা সকলে তন্ত্রমন্ত্র শিখাইলা।’ এই-ই হচ্ছে নবি ও খলিফা প্রচারিত ইসলাম! মারফত ও মরমিয়া সাধনার ক্ষেত্রে সুফিবাদের আবরণে মুসলমানরা সাংখ্যাতন্ত্র ও যোগতত্ত্ব বরণ করলেও কিন্তু তারা সচেতনভাবে পৌত্তলিকতাবিরোধী ও বিদ্বেষী। যদিও হজব্ৰত উদযাপনকালে কাবাগৃহ প্রদক্ষিণ (তায়াব) করা, পাথর চুম্বন করা, অদৃশ্য শয়তানের প্রতি পাথর ছোড়া, হযরত হাজরার স্মৃতির সম্মানে ছুটোছুটির অভিনয় করা প্রভৃতি মুসলিমদের অবশ্য কর্তব্য এবং গুরুজনে কদমবুসি, পির-পূজা, দরগাহ জেয়ারত ও কবর সালাম করা, খিজির কিংবা সত্যপীরে শিন্নিদান, ওলা-শীতলা-ষষ্ঠী-বনবিধি ও হিংস্র জন্তু-আধুষিত জলে-ডাঙায় হাঙর-কুমির-সাপ-বাঘ-হাতি প্রভৃতিকে অরি-দেবতা জ্ঞানে মান-মানতে বশ করা প্রভৃতি তাদের অনেকেরই জীবনাচরণের অঙ্গ, তবু এসব তাদের চোখে পৌত্তলিকতা নয়। এসব সংস্কার-বিশ্বাস-আচরণ মিলে বাঙালি মুসলমানের আচরণীয় মুসলমান ধর্ম বা লৌকিক ইসলামের উদ্ভব।