৪
প্ৰেম সম্পর্কে ইসলামে তেমন কোনো স্পষ্ট শাস্ত্রীয় নির্দেশ নেই। মুসলিম-কবি প্রণয়কাহিনী রচনা করতে গিয়ে রূপজ প্রেম তথা দৰ্শন-শ্রবণজাত পূর্বরাগ-অনুরাগ দিয়ে বর্ণনা শুরু করেছেন; মিলনের পথে দুস্তর বাধাই স্মরণ-চিন্তন মাধ্যমে প্ৰেমাকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য, বিরহবোধ গভীর ও মিলনপ্ৰয়াস তীব্র করে তুলেছে। অবশেষে নায়কনায়িকার যখন গোপন মিলন হচ্ছে তখন সঙ্গম বা রমণ ছাড়া চুম্বন আলিঙ্গনাদি বৈধ বলে বিবেচিত হয়েছে (আবদুল নবির আমীর হামজা’ কাব্য)। কাজেই পরপুরুষ কর্তৃক দেহ-স্পর্শ মাত্ৰই নারীর সতীত্ব নষ্ট হওয়ার মতো রামায়ণী সংকীর্ণতাকে এঁরা প্রশ্ৰয় দেননি। কেবলমৈথুনেই, অর্থাৎরতিরমণেই সতীত্ব নষ্ট হয়–এ-ই ছিল তাঁদের বিশ্বাস। অ-মুসলিম নায়ক-নায়িকার ক্ষেত্রে সত্য-সাক্ষী করে মালাবদল করলেই গান্ধৰ্ব বিয়ে হয়ে যায়। অবশ্য সতীত্ব দেহে কিংবা মনে তা আজও তত্ত্বের ক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবে নিণীত হয় নি। নারীর সতীত্ব-যে পুরুষভোগ্য বস্তুর ধারণা থেকে অর্থাৎ ব্যক্তি-পুরুষের একাধিপত্যের বা একক-পুরুষ নিষ্ঠারই সামাজিক স্বীকৃতিমাত্র-তার বেশি কিছু নয়, বড়জোর সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব আরোপ করার জন্য পিতৃত্ব নির্দিষ্ট রাখার প্রয়োজনপ্রসূত, সমাজ-শৃঙ্খলা রক্ষার গরজে এ-সত্য কখনো স্বীকৃতি পায় না। যদিও প্লেটো থেকে কার্ল মার্কস অবধি অনেকেই বিয়ের তথা সতীত্বের গুরুত্ব স্বীকার করেন নি। পুরাণে মহাভারতেও সতীত্বের এমন বিশেষ গুরুত্ব ছিল না। কোনো কোনো বুনো সমাজে অন্তত পার্বণিক উৎসবে মা-মেয়ে প্রভৃতি কিছু রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয় ব্যতীত যে-কোনো নারীর সঙ্গে সঙ্গম করা শান্ত্র ও সমাজসম্মত রীতি। একে “গণ-সঙ্গম’ পাৰ্বণও বলা চলে। পুরাণে মহাভারতে ছান্দােগ্য উপনিষদে উদ্যালক, বিরোচন প্রভৃতির উক্তিতে ও কাহিনীতে বোঝা যায় পর্যন্ত্রী সম্ভোগ একসময় সামাজিক সদাচার বহির্ভূত ছিল না।
৫
দুনিয়ার সব আদিম মনুষ্যসমাজে জীবন-জীবিকার ও নিরাপত্তার অবলম্বন ছিল জাদুবিশ্বাস। জাদু ঐন্দ্রজালিক শক্তির জনক। মন্ত্রেই তার আবাহন। আনুষঙ্গিক কিছু মুদ্রাভিঙ্গি ও উপচারও থাকে। এই আদিম বিশ্বাস-সংস্কার আজও উন্নত সভ্যতা ও উচু সংস্কৃতির স্রষ্টা ও ধারক-বাহকদের মধ্যেও অবিরল রয়ে গেছে। ভূত-প্ৰেত-দেও-দানু-জিন-পরি প্রভৃতি মন্দশক্তির প্রতীক আজও শঙ্কা-ত্রাসের কারণ হয়ে সাধারণ মানুষের মনোলোকে বেঁচেবর্তে রয়েছে।
বৌদ্ধ প্ৰাবল্যের যুগে অলৌকিক শক্তিধর সিদ্ধপুরুষ ও নারী ডাক-ডাকিনী, যোগীযোগিনীর প্রভাবে এ বিশ্বাস, সংস্কার ও আচার গভীর ও ব্যাপক হয়। বৈদিক মন্ত্র কিংবা যজ্ঞও ঐ জাদুনির্ভর-ঐন্দ্রজালিক শক্তির উদ্বোধনুই লক্ষ্য। এসব জাদুমন্ত্র-প্রসূত তুকতাক, দারু-টোনা, মন্ত্ৰ-উচাটন, বাণ-ফোঁড়, ঝাড়-ফুক প্রভৃতি মঙ্গোল-গোত্রীয়দের প্রভাবে বহু ও বিচিত্র হয়ে ওঠে। ডাকিনী-যোগিনীর সঙ্গে কামরূপ-কামাখ্যার সম্পর্ক ও ঐতিহ্য এভাবেই গড়ে উঠেছে এবং লোকস্মৃতিতে তা আজও অম্লান। তন্ত্র ও তান্ত্রিক আচারও তিব্বতি-চীনা মঙ্গোলীয়দের দান। তুক-তাক-মন্ত্রের জগৎ একটি দুৰ্ভেদ্য রহস্যলোক। মানুষকে মারা-বাঁচানো ছাড়াও মানুষের জন্ম-মৃত্যু নিয়ন্ত্রণ থেকে মানুষের ভাব-চিন্তা-কর্ম-ব্যাধি, রূপান্তর-দেহান্তর, স্বৰ্গ-মর্ত্য-পাতালের পরিসরে দৃশ্যে বা অদৃশ্যে বিচরণ অবধি সার্বিক জীবন-নিয়ন্ত্রণের শক্তি রাখে ঐ যোগসিদ্ধি বা কায়াসিদ্ধি। গোরক্ষাবিজয়ে ময়নামতীর গানে গোপীচাঁদের গানে এই চৌরাশি আঙ্গুল পরিমিত দেহ-সাধনায় সিদ্ধ ‘চৌরাশিসিদ্ধারা’য় তথা কায়াসাধক বৌদ্ধ নাথসহজিয়াদের কেরামতির কথাই বিবৃত হয়েছে।
আধুনিক প্রতীচ্য চিকিৎসাশাস্ত্র ও ঔষধ এদেশে চালু হবার আগে সেই আদিম বা বুনো মানুষের মতো এদেশী মানুষও রোগমাত্রকেই দৈব-নিগ্রহের কিংবা অরিঅপদেবতার কুনজর বলেই বিশ্বাস করত। বিশেষ করে যেসব রোগের নিদান ছিল না, সেগুলো সম্পর্কেবদ্ধমূল ছিল এ ধারণা। দেশী কলেরা-বসন্ত-প্লেগ প্রভৃতি মহামারীর তো বটেই, আয়ুৰ্বেদে তথা দেশী চিকিৎসাশাস্ত্রে কিংবা ইউনানি তিব্বিয়ায় সব রোগের চিকিৎসা-নিদান ছিল না, আজকালের মতো আশু উপশমদানের ব্যবস্থাও ছিল স্বপ্ন। দ্রব্যগুণ-নির্ভর টোটকা চিকিৎসাই ছিল বাস্তব ব্যবস্থা। কাজেই কলেরা-বসন্ত-শিশুরোগ প্রভৃতির জন্যে ওলা-শীতলা-ষষ্ঠী প্রভৃতি অপদেবতা তো ছিলই, অন্য অনেক দুরন্ত দুশ্চিকিৎস্য অনির্ণিত অনির্দেশ্য রোগমুক্তির জন্যে ঐসব মন্ত্রতন্ত্র, ঝাড়-ফুঁক, পানিপড়া, তাবিজ-কবজ, পূজা-শিন্নি, মানত-ধর্না, বলি-সদকা, কাঙাল-মিসকিন-ভোজন প্রভৃতিই ছিল ভরসা।
তাই তুক-তাক, দারু-টোনা, তন্ত্র-মন্ত্র, উচাটন-বশীকরণ, ঝাড়-ফুঁক। তাবিজ-কবজে মানুষের আস্থা ছিল প্রবল, ভরসা ছিল অপরিমেয়। সত্যকলিবিবাদ সম্বাদে কিংবা ময়নামতীর গানে দেখি মন্ত্রবলে মানুষ ইচ্ছেমতো কীট, মাছি, পশু, পাখি, সাপ, ব্যাঙ সবকিছুতে রূপান্তরিত হতে পারত, অপর মানুষের রূপ গ্ৰহণ করে আত্মগোপন কিংবা ছিলনা করতেও ছিল না কোনো বাধা। এমনকি মন্ত্রবলে দর্পণে নারী সৃষ্টি করা, মৃতে ও জড়বস্তুতে প্ৰাণ-সঞ্চার করা, অন্য মানুষের উপর অদৃশ্যে ভর করা প্রভৃতি সহজ ছিল। ‘পরঘাট সঞ্চারিতে আহ্মি মন্ত্র জানি’ (সত্যকলিবিবাদ)। তবে এসব ছিল যোগ্যতান্ত্রিক কায়সাধন সাপেক্ষ-ভুতসিদ্ধি, খেচর সিদ্ধি, কায়াসিদ্ধি প্রভৃতি ছিল কঠোর সাধনালভ্য।