৩
এ কারণেই দেশজ মুসলমানের মধ্যে বৌদ্ধ-হিন্দু পিতৃপুরুষের আচার-সংস্কার, রীতি-রেওয়াজ, তত্ত্ব-চেতনা ও মনন-ধারা থেকে গিয়েছিল। নিরক্ষর অজ্ঞ মানুষ সুফি-দরবেশের ব্যক্তিত্ব ও কেরামত প্রভাবে ইসলামে দীক্ষিত হল বটে কিন্তু প্রতিবেশ ছিল প্রতিকূল। শাস্ত্রটি ছিল দূর দেশের এবং অবোধ্য ভাষায়। তার আচারিক কিংবা তাত্ত্বিক আবহছিল না। এদেশে। তাই ব্যবহারিক ও মানস-চৰ্যায় বৌদ্ধ-হিন্দুর আচার-সংস্কারই রইল প্ৰবল। দেশী মুসলমানের এই ধর্মাচরণকে বুঝবার সুবিধের জন্যে বিদ্বানেরা চিহ্নিত করেছেন ‘লৌকিক ইসলাম’ নামে। উল্লেখ্য যে বৌদ্ধ-হিন্দু-মুসলিম বাঙালি নির্বিশেষের মর্মমূলে রয়েছে সেই ঐতিহ্যিক কায়াসাধন তত্ত্ব। যোগ্যতান্ত্রিক বামাচারী কিংবা বামাবর্জিত সাধনা বাঙালির মজ্জাগত ধর্মসাধনা | রজঃ-বীৰ্য সংযত, ধারণ ও উর্ধায়ন করেই চলে সাধনা। কৃষ্ণের কালীয় নাগ দমনও ঐ কাল কামবিষ দমনেরই রূপক। চন্দ্রাণীর সর্পদংশনও ঐ কামবিষের প্রতীক।
এ-সূত্রে এ-ও উল্লেখ্য যে সংখ্যালঘু মানুষ শাসক, সামন্ত কিংবা প্ৰভু হলেও সামাজিক-বৈষয়িক জীবনে সংখ্যাগুরুর প্রভাব এড়াতে পারে না। সংখ্যালঘু যে আচারেসংস্কারে, রুচি-সংস্কৃতিতে কিংবা ভাষায় স্বাতন্ত্র্য ও স্ববৈশিষ্ট্য রক্ষা করতে পারে না, তার দৃষ্টান্ত রয়েছে ভারতের শাসক তুর্কি-মুঘলের (প্রথম যুগের ইংরেজদেরও) জীবনে। সংখ্যাগুরুদের প্রভাবে তারা তাদের ভাষা-খাদ্য, আচার-সংস্কার ও জীবন-ধারণপদ্ধতির প্রায় সবই হারিয়েছিল। অবশ্য প্রভুকে অনুকরণ করার শাসিতসুলভ হীনমন্যতা-প্রসূত আগ্রহের ফলে শাসকদেরও খাদ্যের, পোশাকের ও দরবারি ভাষার এবং বস্তুসংলগ্ন ও মানস-সভূত সংস্কৃতিও কিছুটা রয়ে গেল।
দৈশিক প্রতিবেশে দেশজ মুসলমান মাতৃভাষায় দৈশিক রীতি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের অনুসরণে সাহিত্য-চৰ্চা করেছেন; এজন্যে তাদের রচনায় দেশী আবহই বিশেষ করে বর্তমান। আগেই বলেছি, যে-ধর্মশাস্ত্রের তারা অনুসারী, তাতে পুরো আনুগত্য রক্ষা করার মতো সে-শাস্ত্ৰ জানা-বোঝা বা শোনার সুযোগ-সুবিধে তাদের ছিল না। তাই স্বশস্ত্রীয় অপূর্ণ জ্ঞানের শূন্যতা পূরণ করেছে তারা দেশী বৌদ্ধ-হিন্দু সাংখ্য-যোগ-তন্ত্র, দেহতত্ত্ব, রামায়ণ-মহাভারত, পুরাণকাহিনী ও তত্ত্ব-জিজ্ঞাসা দিয়ে। ফলে মুসলিম শাস্ত্ৰকথায়ও দেশী পুরাণ ও সংস্কারের প্রভাব পড়েছে। আর মুসলিম অধ্যাত্মতত্ত্বে ও মারফত-মরমিয়া সাধনায় যোগতন্ত্র ও বাউল প্রভাব প্রকট। তা ছাড়া বৌদ্ধ গুরুবাদ তথা পিরবাদ, সৃষ্টিতত্ত্ব এবং বৈদান্তিক অদ্বৈতবাদ বা সৰ্বেশ্বরবাদও নিদ্বিধায় গৃহীত হয়েছে। তাই বৌদ্ধ-হিন্দু বিষয়ভিত্তিক (নাথ-সাহিত্য, গোরক্ষাবিজয়, হরগৌরীসম্বাদ, রাধাকৃষ্ণ, যোগতত্ত্ব) সাহিত্য-রচনায় কিংবা অধ্যাত্মতত্ত্ববৰ্ণনায় মুসলিম তাত্ত্বিক-দার্শনিকঅধ্যাত্মবাদীর উৎসাহ লক্ষণীয়।
মুসলিম-রচিত বাঙলাসাহিত্যের প্রায় সবটাই হিন্দি-আওধি-ফারসি-আরবি গ্রন্থের কায়িক, ছায়িক বা ভাবিক অনুবাদ। অনুবাদকরা সর্বত্র ইচ্ছেমতো গ্ৰহণ, বর্জন ও সংযোজনের স্বাধীনতা রক্ষা করেছেন। প্ৰণয়োপাখ্যানগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে অমুসলিম কাহিনী হলেও মুসলিম-কবির নীতিবোধের বা সামাজিক রীতির পরিপন্থি ছিল না। দেবপূজাদির কথা ছাড়া অন্য ব্যাপারে রীতি-নীতি ও সংস্কারে হিন্দু-মুসলমানে পার্থক্য ছিল না হয়তো। বিদেশী-বিভাষা থেকে অনুবাদ হলেও নৈতিক সামাজিক আচার-আচরণেদৈশিক আবহ ও সংস্কার রক্ষিত হয়েছে। আবার হিন্দু নায়ক-নায়িকার কাহিনী বর্ণনায় কবি অজ্ঞাতে মুসলিম রীতি-নীতির প্রয়োগ করেছেন, কিংবা সুদূর অতীতের প্রথা প্রয়োগ করেছেন–যেমন লোরকরাজ কর্তৃক বামন-বউ চন্দ্ৰাণীহরণ ও স্ত্রীরূপে গ্রহণ।
এখনকার দিনে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজ-সুরুচি, দেশপ্ৰেম,মানবগ্ৰীতি, মানবতা, সুনাগরিকতা প্রভৃতির দোহাই দিয়ে মানুষের বিবেকবুদ্ধি, নীতিবোধ ও সদাচারবোধ জাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়, নিয়ন্ত্রিত হয়ে নৈতিক চরিত্র।
সে-যুগে মানুষের জীবন ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। তাই মানুষের নৈতিক চেতনার মুখ্য উৎসও ছিল ধর্মবিধি ও শাস্ত্রানুশাসন। ফলে নৈতিক জীবনবোধ জাগানোর লক্ষ্যে রচিত হত সাহিত্য। নীতিকথা-নিরপেক্ষ কাব্য-উপাখ্যান কিংবা শাস্ত্ৰ-নিরপেক্ষ সাহিত্যিক রচনা ছিল বিরল প্ৰয়াসে সীমিত। অবশ্য ডাক-খনার আপ্তবাক্য, চাণক্য-শ্লোক ও প্রবচনাদির মতো বিচ্ছিন্ন তত্ত্বকথা বা জ্ঞানগর্ভ বাণী ছিল গুরুত্বে ও প্রভাবে ধর্মশাস্ত্রেরই প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু এগুলোও ছিল ধর্মশাস্ত্রের মতো অদৃশ্য অপার্থিব বিশ্বাস-সংস্কারের প্রলেপে আবৃত।
পূৰ্বপুরুষের বৌদ্ধ-ঐতিহ্যের ধারক বাঙালি মুসলিমরা আল্লাহর পরিভাষা হিসেবে ধর্ম (সগীর ও দৌলত উজীরের কাব্যে), নাথ, নিরঞ্জন এবং হিন্দু-ঐতিহ্যের প্রভাবে করতার (কর্তার) ব্যবহার করেছেন। আরবের আল্লাহ ইরানে হয়েছেন “খুদা’ এবং ইসলামের মৌলিক তত্ত্বপ্রতীক শব্দগুলোও ইরানি রূপান্তর পেয়েছে। ফলে সালাৎ, সিয়াম, মলক, জন্নাৎ জাহান্নাম, নবি-রসুল যথাক্রমে নামাজ, রোজা, ফেরেস্তা, বেহেস্ত, দোজখ, পয়গম্বর হয়েছে। ফারসি দরবরি-ভাষা ছিল বলেই তার প্রভাবে ক্রমে ফারসি প্ৰতিশব্দগুলো জনপ্রিয় হয় মুসলিম-সমাজে। দেশজ মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলায়ও সংস্কারে-বিশ্বাসে, ঐতিহ্যে ও পুরাণে গড়ে উঠেছে দেশী শব্দের বাকপ্রতিমা। তাই মুসলিম-রচিত সাহিত্যের ভাষায়ভঙ্গিতে, উপমাদি-অলঙ্কারে, বাকপ্রতিমা নির্মাণে মুখ্যত দেশী উপাদান-উপকরণ, রামায়ণ মহাভারত পুরাণ প্রভৃতিই বক্তব্য প্রকাশের বাহন হয়েছে।