আমি চেয়েই আছি। জয়ন্ত রঙ্গ খুব বাড়িয়ে বলেনি। সামান্য মোটার দিক ঘেঁষলেও শ্ৰী যেন আগের থেকেও বেড়েছে।..এক পিঠ খোলা চুল। তেলের সঙ্গে যোগ কম বলেই হয়তো লালচে দেখাচ্ছে একটু। গায়ের রংও আগের থেকে ফর্সাই মনে হয়। পরনে চওড়া হলদে ছাপা পাড়ের পাতলা সাদা শাড়ি। গায়ে মুগো রঙের ব্লাউস। হাতে কিছু কাঁচের চুড়ি।
…সেই সুলক্ষণা দয়াল এখন তাহলে এই। আসতে আসতে একবারও আমার দিক থেকে চোখ ফেরায়নি সে। আমিও না। ঠোঁটের ফাঁকে সামান্য হাসি চোখেও। আগের মতো তীক্ষ্ণ নয় আদৌ। উল্টে কৌতুকমাখা।
সামনে এলো। দেখল আর একবার। হাসল আবার একটু। দড়ি বাঁধা গেটটা খুলে দিয়ে ডাকল, এসো।
বাইশ বছর নয়, যেন কিছুদিন আগেই আমাকে দেখেছে সে। আজ আবার দেখল। এখন ভিতরে ডাকছে।
স্থান কাল ভুলে আমি ওর দিকেই চেয়ে আছি। ওকেই দেখছি। সবার আগে আমার মগজে যে চিন্তাটা ঘা দিয়েছে, নিজের অগোচরে এরই মধ্যে হয়তো তার জবাবও খুঁজছি। বিগত বাইশটা বছরের মধ্যে এই মেয়ের কতগুলো বছর পুরুষের অশুচি বাসনার সহচরী হয়ে কেটেছে জানি না। এখনো যেমনটি দেখছি, পুরুষের চোখে না পড়ার মতো নয়– ডাক পড়ে কিনা জানি না। কিন্তু কোনো ব্যভিচারিণী মেয়ের চোখে মুখে হাসিতে এই প্রসন্নতা লেগে থাকে কি করে?
–কি হল, এসো? ওই মেয়েগুলো ভাবছে কি?
ভিতরে এলাম। তারপর পাশে পাশে টালি ঘরগুলোর দিকে এগোলাম। সুলক্ষণা হালকা হেসে বলল, তোমার সঙ্গে শীগগিরই একদিন দেখা হয়ে যাবে আমি ঠিক জানতাম।
–কি করে
–বাঃ তোমার সঙ্গে জয়ন্তর দেখা হয়নি?
মাথা নাড়লাম।–হয়েছে। কলকাতায়।
–সে তোমাকে আমার কথা বলেনি?
-বলেছে। বলেছে, হর-কী-পিয়ারীর ঘাটে হঠাৎ সুলক্ষণার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কে সুলক্ষণা আমি হঠাৎ বুঝতেই পারিনি।
ঘাড় ফিরিয়ে ভূ-ভঙ্গি করে তাকালো মুখের দিকে।-বা-ব্বাঃ, তাহলে তুমি মস্ত একজনই হয়েছ বটে। তারপর কি করে বুঝলে?
–ও যখন বলল, ঝুমরির সঙ্গে দেখা হয়েছে।
ইচ্ছে করেই আমাদের চলার গতি শিথিল। আবার সেই হাসিমাখা ভূ-ভঙ্গি।–ওই মেয়েদের সামনে তুমি আবার আমাকে ঝরি-টুমরি ডেকে বোসো না যেন! ওদের কাছে আমি সুলক্ষণাদিদি।
আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম শুধু একবার। ও আবার ঘাড় ফিরিয়ে ফিক করে হেসে নিল একটু।–কি দেখলে? সুলক্ষণা ডাকার মতো কিছু চোখে পড়ছে না বুঝি?
মনে মনে বললাম, সবটাই সুলক্ষণা দেখছি–আর সেই জন্যেই অবাক লাগছে। মুখে বললাম, আমার সঙ্গে শীগগিরই দেখা হবে ভাবলে কি করে, জয়ন্তর মুখে তোমার কথা শুনে কলকাতা থেকে ছুটে আসব ধরে নিয়েছিলে?
মাথা নেড়ে সুলক্ষণা জবাব দিল, অত ভাগ্যি ভাবিনি, তবে এদিকে এলে একবার খোঁজটোজ করবে আশা ছিল।
বললাম, তাই বা করব ভাবলে কি করে, জয়ন্তকে তো নিজের বাড়ির হদিস দাওনি। হর-কী-পিয়ারীর ঘাটে আবার দেখা হবে বলেও আর সেদিক মাড়াওনি। দেখা হতে পারে ভেবে আমিও ওই ঘাটে দুদিন দুবেলা করে হাজিরা দিয়েছি। কাল ফিরব, আজ হঠাৎ দেখা হয়ে গেল।
ঘাড় ফিরিয়ে দু চোখ বড় বড় করে তাকালো সুলক্ষণা। সেই চোখে হাসি উপচে পড়ছে। মুখে বিড়ম্বনার ছোঁয়া।–কি কাণ্ড! আমারই পোড়া কপাল, ইস, দু-দুটো দিন এ-ভাবে পণ্ড হয়ে গেল!…জয়ন্তর কাছে শুনে সত্যিই কি কলকাতা থেকে চলে এসেছ নাকি?
–না, দিল্লী থেকে, দিল্লীতে কাজে এসেছিলাম। একটু শ্লেষের লোভ সামলানো গেল না, বললাম, তা হঠাৎ জয়ন্তকে ওভাবে কাটতে দিলে কেন-লজ্জায় ভয়ে?
হাসতে লাগল। ওই মেয়েদের কাছে পৌঁছনোর আগে একটু সময় নেবার জন্যেই হয়তো সামনের বাগান ঘুরে চলেছে। যেখানে ফুল বেশি ফুটে আছে, সেখানে দাঁড়াচ্ছেও দুই-এক মিনিট করে। হাসিমুখে সাদা-সাপটা জবাবও দিল। বলল, কাটান দিলাম, কারণ জয়ন্ত এখনো সেই আগের জয়ন্তই আছে মনে হল, আর আমি কেমন। মেয়ে জানে বলেই কথার ফাঁকে ফাঁকে আমার মুখ থেকে পা পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখে নিতেও ছাড়েনি–আর, বাড়ির সন্ধান পেলে ওর হয়তো দুই-এক রাত আমার কাছে কাটিয়ে যেতেও আপত্তি হত না।
শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঘৃণায় ভিতরটা রি-রি করে উঠল আমার। এই কথাগুলো এমন অনায়াস কৌতুকে বলতে পারল বলেই রাগ। দাঁড়িয়ে গেলাম। বললাম, দেখা তো হল, আজ চলি তাহলে?
দাঁড়িয়ে গিয়ে থমকে তাকালো আমার দিকে। তারপর তেমনি পলকা রসিকতার সুরেই পাল্টা জবাব দিল, যাবে যাও–অত ভয় দেখাচ্ছ কি? তারপরেই হেসে বলল, তোমাকে জয়ন্ত ভাবছি না, এসো–
এর পরেও আঘাত দেবার ইচ্ছেটাই প্রবল আমার। বললাম, জয়ন্ত হলে বা জয়ন্ত ভাবলেই বা তোমার এমন কি সাংঘাতিক ক্ষতি আর আপত্তি?
আবারও দাঁড়িয়ে গেল। কয়েক পলকের জন্য সমস্ত মুখ লাল একটু। আমার মনে হল কালো চোখের তারায় সেই আগের মতো আবার এক ঝলক বিদ্যুতও ঝলসে উঠতে পারে। না, তা উঠল না, একটু দেখেই নিল শুধু। তারপর মুখ টিপে হেসে। বলল, এই বাইশ বছর বাদেও তোমার ভয়ানক রাগ দেখছি আমার ওপর। কেন গো?
এবারে নিজেরই কানের কাছটা গরম ঠেকছে। সুলক্ষণা বলল, চলে এসো, ওই মেয়েগুলো কি ভাবছে ঠিক নেই
তার সঙ্গ ধরে আবারও শ্লেষ মাখানো জবাব দিলাম, তোমার পুরনো কোনো প্রীতির পাত্র ভাবছে হয়তো।
হেসে ফেলল। মাথা দুলিয়ে জবাব দিল, তাহলে তো ঠিকই ভাবছে।