আরো তিনদিন হরিদ্বারে ছিল জয়ন্ত রঙ্গ। তিনদিনই ঘাটে এসে ঘণ্টা-দুঘণ্টা করে অপেক্ষা করেছে। সুলক্ষণা দয়াল আর আসেনি। আর দেখা হয়নি।
জয়ন্ত রঙ্গ চলে যাবার পর এক মাস কেটে গেছে। স্বাভাবিক ভাবেই সুলক্ষণা দয়ালের কথা আবার ভুলেছি। এক মাস বাদে হঠাৎ দিল্লীতে একটু কাজ পড়ে গেল আমার। আর দুদিনের মধ্যে সে-কাজও শেষ হয়ে গেল। আমার ফিরতি টিকিটের তারিখে পৌঁছুতে মাঝে পাঁচটা দিন বাকি এখনো। এই পাঁচ-পাঁচটা দিন কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। দিল্লী আমার কাছে প্রায় কলকাতার মতোই পুরনো।
রাতের নিরিবিলিতে হঠাৎ সুলক্ষণা দয়ালের কথা মনে পড়ে গেল। আবার দেখা হওয়াটা ভবিতব্য ছিল বলেই হয়তো মনে পড়ল। ছেলেবেলার মতো এখন আর তে রকম ভাবপ্রবণ তাড়না কিছু থাকার কথা নয়–ছিলও না। তাছাড়া মনের যে আসন থেকে সেই মেয়ে সরে গিয়ে প্রবৃত্তির পাতালে ডুব দিয়েছে–তারপর সে হরিদ্বারেই থাকুক বা মথুরা বৃন্দাবন করে বেড়াক–সেই আসনে আর সে কোনোদিন ফিরে আসবে না জানি। তবু তাকে আর একটি বার দেখার জন্য ভিতরটা কেমন উন্মুখ হয়ে উঠল।
দিল্লী থেকে সকালে হরিদ্বারের লাক্সারি বাস ছাড়ে। ভিড়ের সময় নয়, বাসের টিকিট পেলাম। বাস নুটায় ছাড়ে, আড়াইটে তিনটের মধ্যে হরিদ্বারে পৌঁছয়।
বাসে বসেও অনেক বার মনে হয়েছে নেমে যাই। ফিরে যাই। বাইশ বছর আগের সব স্মৃতি বুকের তলায় আজও যে তেমনি তাজা আছে কে জানত? কেন যাচ্ছি, কি জন্যে দেখতে যাচ্ছি? একদিন যেমন চেয়েছিলাম তেমনি করে কৃষ্ণকুমারের মৃত্যুর ছবিটা মর্মান্তিক করে তোলার অকরুণ লোভে? না, সেই মেজাজ এখন আর নেই। আবার মন বলছে রওনা হয়েছি যখন যাওয়াই যাক না! সুলক্ষণার সঙ্গে দেখা যে হবেই তার কি মানে! জয়ন্ত রঙ্গর সঙ্গে আর তো দেখা হয়নি। সে যে ইচ্ছে। করেই ওকে নিজের বাড়ির হদিস দেয়নি বা আর এসে দেখাও করেনি, তাতেও আমার মনের তলায় বিস্ময়ের আঁচড় পড়েছে। প্রায়শ্চিত্তের তাগিদেই সে-যে হরিদ্বারে এসেছিল এই বা, কে জোর দিয়ে বলতে পারে? প্রদীপের নিচেটাই তো অন্ধকার। পুণ্যস্থানে এ-যাবৎ পাপের মিছিলও আমি কম দেখিনি। দেখা হলে হবে, নয়তো দিন দুই একটু বেড়িয়ে আবার ফেরা যাবে।
কিন্তু এও জানি, এ-সবই আমার নিজেকে ভোলানোর চিন্তা। নিজের বিবেক একটু পরিষ্কার রাখার তাড়না। নইলে ভিতরে ভিতরে ওকে দেখার একটু ইচ্ছে যে ছিলই সেটা মিথ্যে নয়।
হরিদ্বার আমার মোটামুটি চেনা জায়গা। চেনা বলতে বেড়াবার জায়গাগুলো আর স্নানের ঘাট-টাটগুলো চিনি। কিন্তু বাড়ির হদিস বা ঠিকানা জানা না থাকলেও সেখান থেকে এক রমণীকে খুঁজে বার করতে পারব এমন ভরসা ছিলই না। একটা হোটেলে আস্তানা নিয়েছিলাম। তারপর সকালে বিকেলে ঘণ্টা দেড় ঘণ্টা হর-কী-পিয়ারীর ঘাটে হাজিরা দিচ্ছিলাম। প্রথম বিকেলটা কাটল, পরের দুটো দিনের সকাল বিকেলও কাটল। হর-কা-পিয়ারীর ঘাটে দুবেলা আমার দুটো চোখ অভদ্রের মতো মেয়েদের দিকে ধাওয়া করেছে। দেখা মিলল না। আর মিলবেও না ধরেই নিয়েছিলাম। কালকের দিনটা দেখে আবার দিল্লী ফেরার সঙ্কল্প। আমার বাইরেটা মোটামুটি নির্লিপ্ত। সুলক্ষণার দেখা না পেয়ে খুব হতাশ হয়েছি, নিজের কাছে সেটা স্বীকার করতেও সংকোচ। জায়গাটা ভালো। দেখা হলে আরো ভালো হত। হল না যখন কি আর করা যাবে। দু-বেলা ওই হর-কী-পিয়ারীর ঘাটও একটা দেখার জায়গা, বেড়ানোর জায়গা। দুপুরের রোদ চড়া না থাকলে এখানে তিন-চার মাইল হেঁটে বেড়ানোর মধ্যেও আনন্দ আছে।
দেখা হল। পরদিন নয়, এই বিকেলেই। ঘণ্টাখানেক ঘাটে পায়চারি করার পর নেমে সোজা একদিকে পা চালিয়ে দিয়েছিলাম। সেটা কোন দিক আমি জানি না। রাস্তটা নির্জন। ফাঁকায় ফাঁকায় এক-একটা ডেরা। হঠাৎ এক জায়গায় এসে পা দুটো মাটির সঙ্গে যেন আটকে গেল।
যে জায়গার কথা বলছি, ঘাট থেকে কম করে মাইল তিনেক দূরে। এখানে। সন্ধ্যা নামে দেরিতে। সবে তখন বিকেলের আলোয় টান ধরেছে। চারদিকে বাঁশের বেড়া দেওয়া ছোট একটা আঙিনা। তার এক প্রান্তে একটা টালির দালান। তার সামনের প্রাঙ্গণে ঘাসের ওপর বসে আছে পাঁচ-ছটি রমণী। নিজেদের মধ্যে গল্প করছে, কেউ কেউ হাসছে। ঠিক তাদের পিছনেই দাওয়ার ওপর যে বসে, তাকেই আমি খুঁজছি, তার জন্যেই দিল্লী থেকে এখানে আসা।
বেড়ার বাইরে কোনো পুরুষ যদি দাঁড়িয়ে গিয়ে গুটিকতক মেয়েকে দেখতে থাকে, সেটা চোখে পড়তে সময় লাগে না বোধহয়। ঘাসের ওপর যারা বসেছিল, তাদের বয়েস অনুমান বাইশ-চব্বিশ থেকে চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশের মধ্যে। আর এখান থেকে অন্তত সকলকেই বেশ সুশ্রী মনে হল আমার। তারাই প্রথম দেখেছে আমাকে। কারণ আমি যাকে দেখছি তার হাতে একখানা বই কি বাঁধানো খাতা বোঝা যাচ্ছিল না। তার দৃষ্টি সেদিকেই।
মেয়েগুলো নিজেদের মধ্যে হয়তো বলাবলি করল কিছু। আগেও হাসছিল। আমাকে দেখার পরের হাসিটা ভিন্ন বিষয়গত কিনা জানি না। দুই-একটি বয়স্কার বেশ বিরক্ত মুখও দেখলাম। তাদেরই একজন মুখ ফিরিয়ে পিছনের দাওয়ায় বসা রমণীটিকে বলল হয়তো কিছু। কারণ বই বা খাতা থেকে তার দৃষ্টিটা এই বাঁশের ফটকের দিকে ঘুরল।
ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, মনে হল স্থির নিশ্চল কয়েক মুহূর্ত। তারপর উঠল। তারপর বেশ ধীরেসুস্থে এদিকে এগিয়ে আসতে লাগল।