ঝুমরি হেসেই জবাব দিয়েছে, দারুণ পরীক্ষা, জীবন-মরণ নির্ভর একেবারে।
হাসতে হাসতে চলে গেছে।
বেদনা-বিবর্ণ মুখে কৃষ্ণকুমার বলেছে ও আর ফিরবে না জেনেই প্রণাম করে গেছে আর ওই কথা বলে গেছে। তারপর কৃষ্ণকুমার ওর কলেজের দুজন পরিচিতা শিক্ষয়িত্রীকে ডেকে খবর নিয়েছে। পরীক্ষা-টরীক্ষা কিছুই ছিল না সেদিন। তাদের মুখ থেকেই শুনেছে, পাঁচ-সাতদিন আগে থেকেই মাঝে মাঝে ক্লাস পালানো শুরু করেছিল ঝুমরি। ওই শিক্ষয়িত্রীদের একজনের মেয়ে ঝুমরির সঙ্গে পড়ে। সে নাকি তার মাকে বলেছে, একটা মস্ত ঝকঝকে বিলিতি গাড়িতে একজনের পাশে বসে ঝুমরিকে এখানে-সেখানে যেতে দেখেছে। কলেজের অনেক মেয়েই দেখেছে।
আমার মুখে আর একটিও কথা সরেনি। কৃষ্ণকুমারকে আর কোনো সান্ত্বনার কথা বলতে পারিনি। নিজের বুকের তলায় যে কাটা-ছেঁড়া চলেছিল তাও প্রকাশ। করতে পারিনি। কৃষ্ণকুমারদের বাড়ি আসাই কমিয়ে দিয়েছিলাম এর পর। একটা মেয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেছে বলে নয়, কৃষ্ণকুমারের মুখখানা বড় বেশি অসহায় আর করুণ মনে হত। মেয়েটা যেন ওর জীবনের শেষ সলতেটা নিভিয়ে দিয়ে চলে গেছে।
বিতৃষ্ণা-ভরা একটা আক্রোশ নিয়েই সেই মেয়েকে আমি মন থেকে হেঁটে দিচ্ছিলাম। কিন্তু মাঝেসাঝে চেনা-পরিচিত মুখের মারফত দু-একটা খবর কানে আসত। সুলক্ষণা দয়ালকে কখনো লক্ষৌর ওমুক অভিজাত হোটেলে দেখা গেছে, কখনো বেনারসে কখনো বা আলমোড়ায়। আমার মনে হত, ওই রসের খবর যারা দিচ্ছে। তলায় তলায় তারা মুচকি-মুচকি হাসছেও। আমাকে বিধতে চায়। কিন্তু আমি আর বিদ্ধ হতে রাজি নই। কে সুলক্ষণা দয়াল তাই যেন চট করে মনে পড়ত না আমার।
কিন্তু ঘর ছাড়ার ঠিক এক বছর দু মাস বাদে এক বিজাতীয় আক্রোশে ওই সুলক্ষণা দয়ালকেই মনে মনে সব থেকে বেশি খুঁজেছিলাম আমি। কৃষ্ণকুমার মারা গেল। শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে ওর শূন্য দু চোখ একবার ঘরের মধ্যে চক্কর খেয়ে কাউকে যেন খুঁজেছিল। এর পরেই যদি সুলক্ষণা দয়ালের দেখা পেতাম কোথাও, আর এ-খবরটা যদি সকলের আগে হেসে হেসে তার কানে তুলে দিতে পারতাম!
বাইশ বছর বাদে জয়ন্ত রঙ্গর মুখে আবার সেই সুলক্ষণা-প্রসঙ্গ।
এবারে গোড়ায় হঠাৎ ঠাওর করতে না পারাটা ভনিতা কিছু নয়। বাইশ বছরে গঙ্গায় অনেক জল বয়ে গেছে, বুকের তলার অনেক নরম জায়গায় শুকনো চড়া পড়ে গেছে। কিন্তু মানুষের একটা বয়েস চিরকালই বোধহয় নিজের অগোচরে কোনো এক জায়গায় আটকে থাকে। বিস্মৃতির পর্দাটা সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই আগের দিনের মতোই নাড়াচাড়া খেলাম একপ্রস্থ। ভিতরটা উন্মুখ হয়ে উঠল।
হেসে একটা চোখ একটু ছোট করে জয়ন্ত বলল, কত হবে বলো তো তোমার। ঝুমরির বয়েস এখন? কম করে বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ না?…কিন্তু এখনো বেশ মাইরি! আগের থেকে সামান্য মোটা হয়েছে, গায়ের রং এখন ফর্সাই বলতে পারো, এক-পিঠ খোলা চুল, ইচ্ছে করলে এখনো সেই আগের মতো হাসতে পারে–তাকাতেও পারে।
শ্লেষের সুরে জিজ্ঞাসা করলাম, হরিদ্বারে কি করছে–জপ-তপ আর প্রায়শ্চিত্ত?
-তাই তো বলল। আমি খোঁজ নিতে দিব্যি হেসে জবাব দিলে, সব খুইয়ে আমার মতো মেয়েরা শেষে কাশী মথুরা বৃন্দাবন বা হরিদ্বার ছাড়া আর কোথায় এসে ঠেকবে?
কিন্তু খুব একটা প্রায়শ্চিত্ত করছে বলে জয়ন্তর মনে হয়নি। রসিকতার মেজাজটি এখনো নাকি দিব্যি আছে।
…জয়ন্ত রঙ্গর সঙ্গে সুলক্ষণা দয়ালের দেখা হয়েছিল বিকেলের হর-কী-পিয়ারী ঘাটে। সকালের দিকে সেখানে পুণ্যার্থীদের চিড়ে-চ্যাপ্টা ভিড়, বিকেলের দিকে হাওয়া বিলাসীদের। জয়ন্ত রঙ্গ চুপচাপ দাঁড়িয়ে গঙ্গার শোভা দেখছিল, ছেলে-ছোকরাদের শিকল-ধরে গঙ্গায় হুটোপুটি খাওয়া দেখছিল। কোত্থেকে একজন মহিলা পাশে এসে রাজ্যের বিস্ময় গলায় ঢেলে জিজ্ঞাসা করল, ও মার সাহেব না?
তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে রঙ্গ চিনেছে, কারণ চেহারায় শুধু বয়েসের প্রসন্ন ছোঁয়া লেগেছে একটু–কিছুই খোয়া যায়নি।
অনেক কাল বাদে অন্তরঙ্গ বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে যেমন হয় তেমনি আনন্দ সুলক্ষণার। জয়ন্তকে ঘাট থেকে একটা নিরিবিলি দিকে টেনে নিয়ে গেছে। গঙ্গার ধারে দুজনে পাশাপাশি বসেছে। নিজের প্রসঙ্গে প্রায় কোনো কথাই বলেনি বা বলতে চায়নি। জয়ন্ত কিছু জিজ্ঞাসা করলে মুখ টিপে হেসেছে, আর শেষ বয়সে তাদের মতো মেয়েদের যে এ-সব জায়গাতে আশ্রয়–সেই কথাই বলেছে। কিন্তু সেই বলার। মধ্যেও কোনো পরিতাপ ছিল না।
জয়ন্ত ঠাট্টা করেছে, শেষ বয়েস বলে তো একটুও মনে হচ্ছে না তোমাকে দেখে?
জবাবে হেসে ভ্রূকুটি করেছে সুলক্ষণা। বলেছে, এখনো তোমার চোখের দোষ। রোসো, নিজের এই চুলের বোঝা ছেটে ফেলব ভাবছি, তাহলে তোমাদের আর অসুবিধে। হবে না।
নিজের কথা কিছু না বললেও বিশেষ করে আমার কথা নাকি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করেছে সুলক্ষণা। কৃষ্ণকুমারের নামও মুখে আনেনি। এই থেকেই বোঝা গেছে সে-যে নেই সেটা ও জানে। জয়ন্ত বলল, তুমি লিখে নাম-টাম করেছ শুনে সুলক্ষণা যেমন অবাক তেমনি খুশি। তোমার বউয়ের কথা আর ছেলেপুলের কথা শুনতে চাইল–আমি আর কতটুকু জানি যে বলব।
আবার দেখা করার জন্য জয়ন্ত রঙ্গ তার হরিদ্বারের আস্তানার হদিস পেতে চেয়েছিল। ঘুরিয়ে সে-আবেদন নাকচ করেছে সুলক্ষণা। তরল জবাব দিয়েছে, ঠিকানা আর কোথায়, ঠিকানাই তো খুঁজে বেড়াচ্ছি। যদি থাকো তো এই হর-কী-পিয়ারীর ঘাটেই দেখা হবে আবার।