কৃষ্ণকুমারের বিবেচনার ওপর আমার অটুট আস্থা। সঙ্গে সঙ্গে সেই সম্ভাবনা আমিও বাতিল করেছি। আর তিন দিনের মধ্যে খবরও এসেছে ঝুমরি সেখানে নেই। সেখানে যায়নি। কিন্তু কৃষ্ণকুমারের বাবার কথার মধ্যেও সত্যের ছিটে-ফেঁটা আছে। বলে ভাবিনি। নিজের এত বড় সর্বনাশ ঝুমরি স্বেচ্ছায় ঘটাতে পারে না। বড় রকমের অঘটনই ঘটে গেছে কিছু। চরম কোনো বিপদে পড়ে ঝুমরি হয়তো নিঃশব্দে আর্তনাদ করছে, হাহাকার করছে। ঝুমরির চোখে যে-আগুন জ্বলে, নরক-যন্ত্রণার মধ্যে পড়ে দিবা-রাত্র এখন হয়তো সেই আগুন জ্বলছে। কৃষ্ণকুমারের বাবার কথা শুনে উল্টে ভদ্রলোককে নির্মম নিষ্ঠুর মনে হয়েছে আমার। চেনা-জানা মুখগুলো আঁতিপাতি করে খুঁজেছি তারপর। কে হতে পারে? ঝুমরির এত বড় সর্বনাশ কে করতে পারে?
জয়ন্ত রঙ্গ খুব একটা জোরালো লোক নয়। কিন্তু বাপের টাকার জোর আছে। ঝুমরিকে ঘিরে ওর বাসনার আঁচও পেতাম। বাসনা বেপরোয়া হয়ে উঠলে মানুষ অমানুষ হতে কতক্ষণ। তাছাড়া এ-পর্যন্ত তার দেখা নেই কেন? এ-পর্যন্ত বলতে পরদিন এই সকাল পর্যন্ত। সব দিনের মতোই ঝুমরি খেয়েদেয়ে কলেজ গেছল। সেই কলেজ থেকে আর ফেরেনি। একটা রাত কেটে গেছে। পরদিন সকাল নটায় কৃষ্ণকুমারের কাছে এসে দেখি, নির্বাক বিবর্ণ মুখ। বাড়ির হাওয়া থমথমে। কিছু বোঝার আগেই কৃষ্ণকুমার বিড়বিড় করে বলেছে, ঝুমরি আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, কাল কলেজ থেকে আর বাড়ি ফেরেনি।
খবরটা এমন আকস্মিক যে আমার বুঝতেই সময় লেগেছিল। ফ্যাল ফ্যাল করে ওর দিকেই চেয়েছিলাম আমি। কৃষ্ণকুমার আবার বলল, কলেজে খোঁজ করা হয়েছিল, ঝুমরি কাল কলেজে মোটে যায়ইনি।
আমি হতভম্ব। বুকের তলায় ঠক-ঠক কাপুনি ধরেছিল। ঠিক সেই সময় বাইরে থেকে ঘরে ফিরেছে কৃষ্ণকুমারের বাবা। গনগনে ধারালো মুখ। ছেলের মুখের ওপর একটা বিরক্তির ঝাপটা মেরে ভিতরে চলে গেছে। তারপর ভিতর থেকে ওই তর্জন গর্জন শোনা গেছে।
ঝুমরি বাপের বাড়ি যায়নি, যেতে পারে না, কৃষ্ণকুমারের মুখে কথা শোনার পর আর বেশিক্ষণ ওর কাছে বসে থাকতে পারিনি। জয়ন্ত রঙ্গর চপল মুখ বার বার চোখের সামনে এগিয়ে আসছিল। সাইকেল নিয়ে সোজা তার বাড়ি ছুটেছি। ধমনীর রক্ত তখন টগবগ করে ফুটছে। আমার সবুজ পৃথিবী নিমেষে বর্ণশূন্য হয়ে গেছে। সেই রিক্ত আগুন-ঝরা পৃথিবীর এখন ভেঙে ফেটে চৌচির হবার প্রতীক্ষা শুধু।
কিন্তু দিন-কয়েক যেতেই বোঝা গেছে জয়ন্ত রঙ্গ নয়। ওর সেই সাহস নেই, সেই মেরুদণ্ড নেই। তারপরে আরো মনে হয়েছে, জয়ন্তর মতো ছেলেকে ঝুমরি। অনায়াসে নিজেই ঢিট করতে পারে। ওর ওপর দখল নিতে পারে এমন মরদ এই ছেলে নয়।
জয়ন্ত রঙ্গকে বাতিল করার পরে চকিতে আর একটা সন্দেহ মনে এসেছে আমার। আর তক্ষুনি সেই সম্ভাবনাই অবধারিত মনে হয়েছে। এর ঢের আগেই ঝুমরির বাপের। বাড়ি থেকেও খবর এসেছে সে সেখানেও যায়নি। তাহলে?
তাহলে মধু যাদব। একমাত্র সে ছাড়া কার আর এত বড় দুঃসাহস হতে পারে? হার চুরি দূরের কথা, আমার বদ্ধ ধারণা অনায়াসে ওই শয়তান মানুষও খুন করতে পারে। একটাও স্নায়ু কাপবে না, একটুও হাত কাঁপবে না। সে ভিন্ন বাড়ি ছাড়ার মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে এত বড় অঘটন ঘটে কি করে? এই পৃথিবীতে ঝুমরির ওপরেই তো সব থেকে বেশি রাগ তার। ওর জন্যেই পুলিস তাকে তিন দিন থানায় আটকে বেদম মার মেরেছে। সে-মারের এ-রকম প্রতিশোধ একমাত্র ওই লোকই নিতে পারে। তা ছাড়াও আমার স্থির বিশ্বাস ঝুমরিকে নিয়ে প্রথম থেকেই খারাপ মতলব ছিল ওর। ঝুমরি যদি সীতা দেবী হয়, ও তার হনুমান নয়। রাবণ। এ-কাজ ওর ছাড়া আর কারো নয়।
মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথায় আগুন জ্বলেছে। আবার অসহায় বোধ করেছি কেমন। ওই নৃশংস মানুষটার কবল থেকে ঝুমরির মুক্তির আশা দুরাশাই বুঝি।
..কিন্তু এ-সম্ভাবনার কথা কৃষ্ণকুমারের বাবা মায়ের মনে এলো না কেন? বিশেষ করে কৃষ্ণকুমারের মাথায় এলো না কেন? থানায় খবর দিয়ে মধুর নামে হুলিয়া বার করা হল না কেন? এখনো সময় আছে। কৃষ্ণকুমারের কাছে ছুটে এলাম আমি।
সন্দেহের কথা শুনে কৃষ্ণকুমার চুপচাপ মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিক। এতটুকু উত্তেজনার আভাস না পেয়ে উল্টে অবাক। একটু বাদে ও ক্লান্ত স্বরে জবাব দিল, তা নয়, ঝুমরি নিজের ইচ্ছেতে অন্য কারো সঙ্গে চলে গেছে।
অবিশ্বাসের সুরে আমি জোর দিয়ে বলে উঠলাম, তুমি কি করে জানলে? এ হতেই পারে না–আমি এক্ষুনি থানায় গিয়ে যা করার করে আসি।
কৃষ্ণকুমার আবার খানিক চুপ করে থেকে মাথা নাড়ল শুধু। অর্থাৎ আমাকে নিষেধ করল। তারপর আস্তে আস্তে যে কথাগুলো বলল, শুনে ভয়ানক দমে গেলাম আমি।…সেদিন সকালে কলেজ যাবার আগে পর্যন্ত ঝুমরি নাকি প্রায় সারাক্ষণ কৃষ্ণকুমারের কাছেই ছিল। এগারোটায় কলেজ, সকাল সাড়ে দশটা পর্যন্ত। তার সেবা যত্ন করেছে, নিয়ম করে ওষুধ-পত্র খাওয়া আর সময়ে ঘুমনোর ব্যাপারে পাকা গিন্নীর মতো উপদেশ দিয়েছে। বেলা সাড়ে দশটার সময় উঠে গিয়ে সামান্য কিছু নাকে মুখে গুঁজে কলেজ যাবার জন্য তৈরি হয়ে আবার ঘরে এসেছে। বলেছে, মাথাটা। একটু তোলো দেখি
কিছু না বুঝেই কৃষ্ণকুমার উঠে বসেছিল। বলা নেই কওয়া নেই ঝুমরি তার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে একটা প্রণাম সেরে নিল। অবাক হয়ে কৃষ্ণকুমার জিজ্ঞাসা করেছে, কি ব্যাপার রে, পরীক্ষা-টরীক্ষা কিছু নাকি?